ভারতীয় পপ মিউজিককে নতুন করে গড়েছিলেন তিনি।
লেসলি লুইস।
মনে পড়ে ‘পরী হুঁ ম্যয়’, ‘ইয়ারোঁ দোস্তি’, ‘জনম সমঝা করো’ গানগুলোর কথা? এ ছাড়া আরও কত কত হিট গান। ভারতের পপ-সম্রাজ্ঞী আশা ভোঁশলের গাওয়া প্রথম রিমিক্স অ্যালবাম ‘রাহুল অ্যান্ড আই’-এর স্রষ্টাও স্বয়ং লেসলি। এমনকী তাঁর হাতেই জন্ম হয়েছিল কোক স্টুডিয়ো@এমটিভি-র। সঙ্গীত-রসিকদের বেশির ভাগই তাঁকে চেনেন ক্ল্যাসিকাল পপ ব্যান্ড ‘কলোনিয়াল কাজিনস’-এর অন্যতম সদস্য হিসেবেই।
তিন দশকেরও বেশি সময়ের কেরিয়ারে লেসলি তাঁর শ্রোতাদের মুগ্ধ করেছেন একের পর এক নতুন সৃষ্টিতে। নতুন ধরনের সুর, গান তৈরিতে বরাবরই তাঁর জুড়ি মেলা ভার। সমালোচক থেকে শ্রোতা— লেসলির এই নতুন ধারার গান প্রশংসা পেয়েছে সবার। এত কিছুর পরেও লেসলি কিন্তু নিজের মতো। খুব সাধারণ। বলছিলেন, ‘‘আমি বলতে পারেন একজন মিউজিক্যাল ফকির।’’ খুব শিগগির মুক্তি পেতে চলেছে তাঁর সিঙ্গল। সেই প্রসঙ্গে বললেন, ‘‘আমার মিউজিক্যাল অবতার-টা আবারও বদলে নিয়েছি। সেই ১৮ বছর বয়সে যা করতাম, সেটাই করছি এখন,’’ খুব উত্তেজিত শোনায় তাঁকে। আরও বলেন, ‘‘আমি আমার প্রত্যেকটা সৃষ্টিতেই নতুন করে আবিষ্কার করি নিজেকে। একটা ধারা শুরু করি। সেই ধারাটায় আমার নিজস্বতাটাই পুরোপুরি থাকে। তার পর আবার এগিয়ে যাই।’’ কিন্তু নিজেকে বারবার এ ভাবে আবিষ্কার করার তাগিদটা পান কোথা থেকে? তাঁর মতে শ্রোতারা এখন যে গানগুলো শুনছেন, সবটাই ব্র্যান্ডেড মিউজিক। ‘‘‘লুঙ্গি ডান্স’-এর মতো গানও চার্টে টপ করছে স্রেফ প্রোমোশন আর মার্কেটিংয়ের জোরে। আমি বলছি না গানগুলোতে কিছু নেই। কিন্তু বলুন তো, ওই সব অতিরিক্ত জিনিসগুলো বাদ দিলে গানটার কি সত্যিই কিছু থাকে?’’ পাল্টা প্রশ্ন লেসলির।
লেসলির মতে ভারতে গান একটা বিশাল ব্যবসা। ‘‘হলিউডও জানে ভারতীয় ছবি মানে তাতে নাচ-গান থাকবেই। সত্যি বলতে এত লোক! আর সবার তো আর বিশাল প্রতিভা নেই। চাইলেই লতা, আশা, কিশোর হতে পারবে না। গানের কথার মান-ও তো সাঙ্ঘাতিক নেমে যাচ্ছে। এতে তো শ্রোতাদের রুচির মান-টাও পড়ে যাচ্ছে। গান নয়, পুরোটাই কেমন যেন ‘নয়েজ’, কোলাহল,’’ চিন্তিত শোনায় লেসলিকে। আর তাই তো ফিরে যাচ্ছেন সভ্যতার সেই শুরুর দিকটায়। যখন প্রযুক্তি গলার স্বরকে বদলে দিতে পারত না। গানের সুরের ওপর থাবা বসাতে পারত না।
লেসলির নতুন এই সিঙ্গল বিনা খরচে ডাউনলোড করে শোনা যাবে আইটিউনস আর অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে। বললেন, ‘‘আজকাল গান শোনা মানেই ডাউনলোড করা। অ্যালবাম আর কেউ চায় না। কাজেই এক-একবারে এক-একটা গান শোনার সুযোগ করে দেব আমার শ্রোতাদের। অ্যালবামের মতো নয়, যে ভাল না লাগলেও সব গানই শুনতে হবে,’’ খুব রিল্যাক্সড ভাবে উত্তর দেন লেসলি। শুধু গানই নয়, এই গানের সঙ্গের ভিডিয়োটাও তাঁর তৈরি। খুব শিগগির সেটা আপলোড করে দেবেন ইউটিউবে। ‘‘দেখুন খুব বেশি টাকা খরচ করতে পারব না। আর খুব বেশি টাকাও পাব না। সে কারণেই চাই শ্রোতারা ফ্রি-তেই গানগুলো শুনুক। তবে আমি মিডলম্যানদের থেকে দূরে থাকতে চাই। শ্রোতারা কোন গান শুনতে পছন্দ করবে তা নিয়ে মতামত দেওয়া সবজান্তা এই লোকগুলোর থেকে দূরে থাকতে চাই। আমি চাই নিরপেক্ষ ভাবেই শ্রোতাদের কাছে আমার গানটা পৌঁছক,’’ বলেন লেসলি।
গানের ক্ষেত্রে দেশের অনেকগুলো নামী পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে। আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাঁর গানগুলো যে হিট হবেই, সে ব্যাপারে খুব আত্মবিশ্বাসী লেসলি। ‘‘আমার আগের গানগুলোও শ্রোতারা দারুণ ভাবে নিয়েছেন। গান তৈরির সময় আমি নিজের সত্তাটাকে বাইরে রেখে অন্যদের কথা চিন্তা করেই লিখি। এ বারের অ্যাসাইনমেন্টটা সম্পূর্ণ আমার নিজস্ব। নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করেছি নতুন এক লেসলি লুইস হয়ে ওঠার। হিন্দি গানকে আবারও আমি আন্তর্জাতিক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। ‘কলোনিয়াল কাজিনস’-এ থাকার সময় ঠিক যেমনটা করতাম,’’ লেসলির গলা আত্মবিশ্বাসে ভরপুর।
হরিহরনের সঙ্গে যোগাযোগটা তা হলে কী ভাবে থাকছে? ‘‘দেখুন, আমরা ব্যান্ডে যেমন পারফর্ম করতাম, সে রকমই করছি। শো করছি। এটাও সে রকমই একটা উদ্যোগ। তফাত শুধু একটাই। এ বার যেটা করছি, সেটা সম্পূর্ণ আমার নিজের। ‘লেসলি লুইস’-কে এই প্রথম প্রোমোট করছি আমি। ও বেচারা বহু দিন ধরে চেয়েছে ওর জন্য আমি গান লিখি,’’ হাসতে হাসতে বলেন লেসলি।
ইতিমধ্যেই ৪০-টা গান লিখে ফেলেছেন। সেগুলো শ্রোতাদের সঙ্গে শেয়ার করতেও তৈরি তিনি। কিছু কিছু গান তো সেই সত্তর দশকের। বান্দ্রার এক অনুষ্ঠানে ৬ অগস্ট রিলিজ করবেন তাঁর নতুন সিঙ্গল ‘দিল চাহে দেশি গার্ল’। ‘‘কোনও লঞ্চ পার্টি হচ্ছে না। তাই আপনি ভাবলেন ব্যাক টু ব্যাক আমার গান শুনবেন, সেটা কিন্তু হবে না।’’ এ-ও জানালেন মাটির খুব কাছাকাছি, খুব নিজস্ব সেই গান। মাল্টিট্র্যাক রেকর্ডিং আসার আগের গান এগুলো। এই গানগুলোয় কোনও টাচ-আপ নেই, ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় বানানো নয়, এক টেক-এ লাইভ রেকর্ডিংয়ের এই গানগুলো ঠিক আমি স্টেজে পারফর্ম করলে যেমন শোনায়, তেমনই। অন্যান্য ধারার গানও রাখছি। কিছু গান বেশ হইচইয়ের। এমনকী গজলও লিখছি। আমি ট্রু আমেরিকান ব্লু-জ স্টাইলে গজল গাই। ইন্ডি মিউজিককে পরবর্তী উচ্চতায় নিয়ে যাব, এটাই আমার স্বপ্ন । কোক স্টুডিয়ো শুরু করার মুহূর্তটায় ঠিক এমন অনুভূতি হয়েছিল আমার,’’ উত্তেজনা স্পষ্ট লেসলির গলায়।
গানের এই সুবিশাল কর্মযজ্ঞ একাই সামলাচ্ছেন লেসলি। ঠিক এক উঠতি গায়কের মতোই তাঁর এই উত্তেজনা ছড়িয়ে দিতে চান তাঁর ফ্যানেদের মধ্যে। যেখানে যেখানে নিজের গান ফেরি করে বেড়ান তিনি, সেই সব জায়গায়। বললেন, ‘‘আমি এখন ৫৫। খুব উত্তেজিত আমি। আমি চাই আমার এই গান শ্রোতারা শুনুক। এ ধরনের গান আগে এ দেশে হয়নি। আমি যখন কোক স্টুডিয়োর আইডিয়াটা দিয়েছিলাম, ওরা দু’বছর নিয়েছিল ‘হ্যাঁ’ বলতে। দেখুন, কতটা জনপ্রিয় হয়েছে সেই কনসেপ্ট! মানুষ এবার পারফর্মার লেসলিকে দেখবেন। বেঁচে থাকতে থাকতে আমি আমার গানগুলো এ ভাবেই ছড়িয়ে দিতে চাই মানুষের মধ্যে।’’
আর নতুন প্রজন্মের গায়করা? তাঁরাও তো যথেষ্ট প্রতিভাবান। সেই প্রসঙ্গ খানিকটা এড়িয়ে গিয়ে লেসলি বলেন, ‘‘দেখুন সবারই প্রতিভা আছে। নতুনরা তাদের নিজেদের অ্যাপিল নিয়ে আসছে। কিন্তু গানের সেই নিজস্বতাটা কোথায়? একটা অন্য জায়গা তো আছে। আর সেই জায়গাতেই আমি কাজ করতে চাই। নতুন মাওয়ালি প্রিন্স কিন্ত আমি নিজেই। আর আমার গানও সেই একই ধারার,’’ হেসে জানান তিনি। আর যদি সমালোচনা হয়? ‘‘দেখুন অনেক সমালোচকই বলেছেন আমি যখন রিমিক্স করতে শুরু করি, তখন নাকি আমাদের দেশের সনাতন গানের ধারাটাকে নষ্ট করে দিয়েছিলাম। সেই আমিই কিন্তু ‘কুছ তো লোগ কহেঙ্গে...’র সুর গুনগুন করি প্রায়ই,’’ হাসেন লেসলি।
আর বলিউডে গান গাওয়ার ব্যাপারেই বা কী ভাবছেন এই সঙ্গীতশিল্পী? ‘‘দেখুন সিনেমার গান সব সময় ভাল হওয়া দরকার। ইচ্ছে মতো যে কোনও গান সেখানে দেওয়া যাবে না। বলা হয় ভারতের মতো সুরেলা এক দেশে রেডিয়োতে কখনও কোনও ইন্ডিপেন্ডেন্ট গান বাজানো হয় না। আর পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি সিনেমার গান কেউ শোনে না। আমি তো বলি গানকে কথা বলতে দিন। আমি মধ্য ভারতে নিজের গান ছড়িয়ে দিতে পেরে বেশ খুশি,’’ হেসে বলেন লেসলি।
খ্যাতনামা ফোটোগ্রাফার পিএল রাজ লেসলির বাবা। রাজ ‘শোলে’, ‘সরগম’ সিনেমাগুলোর কোরিওগ্র্যাফি করেছিলেন। কল্যাণজি-আনন্দজি, লক্ষ্মীকান্ত প্যারেলাল, আরডি বর্মনের মতো খ্যাতনামা লোকেদের সান্নিধ্যে তাঁর বেড়ে ওঠা। এবং পরে তাঁদের সঙ্গে কাজ করা। ‘‘কী জানেন তো, আমি আমার এই পাওনাগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাই না। যা করতে ভালবাসি, নিজের সবটুকু দিয়েই সেটা করছি। বিখ্যাত মানুষদের থেকে শিখেছি কী ভাবে ফোকাস করতে হয়। আর কী ভাবে সবাইকে প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে হয়। আমার ওয়ার্ক এথিক্সটাও ওদের থেকেই শেখা। আমার মনে হয় সুর, লয়ের মধ্যেই ঈশ্বরের বাস,’’ কথা শেষ করেন লেসলি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy