Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

এই তো জীবন কালীদা

নিকটাত্মীয় অসুস্থ। হাসপাতালে। সব সময় মন খারাপ। সে সব মানিয়ে নিয়ে কেমন করে মন দিচ্ছেন শ্যুটিংয়ে? হায়দরাবাদে রামোজি রাও স্টুডিয়োয় বসে ব্লগ লিখলেন কোয়েল মল্লিক। নিকটাত্মীয় অসুস্থ। হাসপাতালে। সব সময় মন খারাপ। সে সব মানিয়ে নিয়ে কেমন করে মন দিচ্ছেন শ্যুটিংয়ে? হায়দরাবাদে রামোজি রাও স্টুডিয়োয় বসে ব্লগ লিখলেন কোয়েল মল্লিক।

শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

‘সুস্বাগতম’। তেলুগু ভাষায় লেখা। গেট দিয়ে ঢুকতেই আমার অভিনীত সিনেমার কিছু স্মৃতি ফ্ল্যাশকাট-এ মনে পড়তে লাগল। ডিরেক্টরের শাসন থেকে প্রচণ্ড ঠান্ডায় বৃষ্টির সিন, অনেক ভাল লাগা, খারাপ লাগার দিন কাটিয়েছি এই হায়দরাবাদ রামোজি ফিল্ম সিটি-তে। এখানে এখন সাঙ্ঘাতিক গরম। স্ক্রিপ্ট মুখস্থ বা শ্যুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকেই বাড়ি থেকে ফোন— ‘কোয়েল ডাবের জল বা নুন-চিনির শরবত বা ইলেক্ট্রল কিন্তু মাস্ট।’ লো-প্রেসারের টেন্ডেন্সি। তাই মাথাঘোরাটা মাঝেমধ্যেই হয়। হয়েছিল কয়েকবার শ্যুটিংয়েও। ছোটবেলায় সিনেমায় যখন এমন দৃশ্য দেখতাম, চারিদিকটা যেন নাগরদোলার মতো দুলছে, ভাবতাম কী মজার ব্যাপার! পরবর্তী সময়ে নিজের যখন হল, তখন আবার সেই মজাই জানলা দিয়ে ফুড়ুৎ।
একবার দার্জিলিং-এর পাহাড়ের শেষ মাথায় একটা শট দিচ্ছিলাম। পাশেই খাদ। হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য একদম অন্ধকার। ব্ল্যাক আউট যাকে বলে। যখন হুঁশ এল, টের পেলাম আমি কারও কোলে (পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্টের)। দৌড়ে সামনের এক হোটেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
যাকগে সে সব কথা। এত গরম সত্ত্বেও এখানে টিমের এনার্জি কিন্তু তুঙ্গে। ভারী লাইটস বা ক্যামেরার সরঞ্জাম নিয়ে ছুটছে সবাই দ্রুত, যেন পায়ের চাকায় স্পিডোমিটার ফিক্স করা। এদিকে আমার হেয়ারড্রেসারের চোখ কিন্তু চুলের বাউন্সের ওপর। প্রত্যেক শটের মাঝে সে রোলার লাগায়। লকস যেন হাওয়ায় ঠিক পরিমাণে খেলে, তার চেষ্টা। তেমনই আমার মেক আপ আর্টিস্টের সর্বক্ষণ টাচ আপ। এত গরমে কি আর মেক আপ থাকে! সে তো ঘেমে ‘ঘ’। না, তা চলবে না। হিরোইন তো সে! সব সময় ফুরফুরে হাওয়ার মতো ফ্রেশ লাগা দরকার। প্রফেশনের কী সাঙ্ঘাতিক আবদার— জ্বর, মাথা ধরা, শরীর বা মন খারাপ সে যাই হোক। দর্শককে বুঝতে দিলে চলবে না। লাগতে হবে সব সময় পারফেক্ট!

‘মেরা নাম জোকার’ ছবির একটি দৃশ্যে রাজ কপূর

সবাইকে ফাঁকি মারা গেলেও ক্যামেরাকে ফাঁকি মারা যায় না। এখানে কোনও অজুহাত চলে না। শুধুই ডেলিভারি। আবেগের বিভিন্ন স্তরের তীব্রতা অনুভব করলেও প্রকাশ করলে হবে না।

পরিবারের এক অতি নিকট সদস্যের শরীর খারাপের ফলে বেশ কিছু দিন তাঁকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে। অজস্র ওষুধ, ইঞ্জেকশন, স্যালাইনে ভর্তি ছিল জীবন। এখানে আসার সময় যা-ও বা তিনি একটু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন, এসে শুনলাম আবার তিনি হাসপাতালে। তাই শ্যুটিংয়ে থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই মন পড়ে থাকত ওখানে। বারেবারে অন্যমনস্ক হয়ে পড়তাম তিনি কেমন আছেন ভেবে। কাজের ফাঁকে ভারি আড্ডা হয় রাজাদা (পরিচালক রাজা চন্দ) আর জিতের (অভিনেতা) সঙ্গে। হয় হইচই, বিভিন্ন বিষয়ে অনেক আলোচনা। একদিন অভিনেতা আশিস বিদ্যার্থী একটা মজার গল্প শুনিয়ে ভ্যানিলা আইসক্রিমের সঙ্গে হিমায়িত আম খাওয়ালো। এতই খাদ্যরসিক যে কলকাতার রাধুবাবুর মামলেট বা উত্তর কলকাতার চিত্তরঞ্জন মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মধুপর্ক থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন কোনায় কী কী প্রখ্যাত খাবার পাওয়া যায় সবই তাঁর নখদর্পণে। খুব গল্প চলছে। হঠাৎ— ‘ওঁর ওষুধ ঠিক মতো পড়ছে তো? ডাক্তার কী বললেন? আর ক’দিন পর বাড়ি ফিরবেন?’ উঠে গেলাম ফোন করতে। কিছু বছর আগেও এমনই এক মনখারাপের দিনে কলকাতায় শ্যুটিং। মা-বাবাকে শক্ত ‘আমি’টাকে দেখিয়ে কোনও রকমে কান্না চেপে উঠে পড়েছিলাম গাড়িতে। উঠতেই ভেঙে পড়লাম। হঠাৎ মনে পড়ল এ কী, এখনই তো ঢুকে পড়ব স্টুডিয়োতে। তাড়াতাড়ি লুকিং গ্লাস দেখে চোখ মুছতে শুরু করলাম। শ্যুটে ফোলা ফোলা চোখ থাকলে তো চলবে না। খুব খারাপ লাগবে। সবাইকে ফাঁকি মারা গেলেও ক্যামেরাকে ফাঁকি মারা যায় না। এখানে কোনও অজুহাত চলে না। শুধুই ডেলিভারি। আবেগের বিভিন্ন স্তরের তীব্রতা অনুভব করলেও প্রকাশ করলে হবে না। পরিচালকের ‘অ্যাকশন’ থেকে ‘কাট’ বলার সময়টুকুতে চারিদিকের পৃথিবী নিমেষে সুইচড্ অফ।

‘‘আরে না, না। ফ্লুরোসেন্ট গ্রিন কস্টিউম তো সুইৎজারল্যান্ডের গ্রিনারিতে হারিয়ে যাবে। হলুদ জমতে পারে’’— ফোন সেরে আবার ফিরলাম অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে পরের দৃশ্যের আলোচনায়।

‘এই তো জীবন কালীদা। এই তো জীবন।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE