Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Cinema

বহু দিন পরে এত পরিপূর্ণ একটা ছবি বাঙালি উপহার পেল

ইন্দ্র এবং তার মা সাথীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, টানাপড়েনকে কেন্দ্র করে ‘অব্যক্ত’র গল্প।

ইন্দ্রদত্তা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০২:৩৭
Share: Save:

অব্যক্ত
পরিচালনা: অর্জুন দত্ত
অভিনয়: অর্পিতা, আদিল, অনুভব, অনির্বাণ
৭/১০

‘‘স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা’’— অর্জুন দত্তের ‘অব্যক্ত’ এমনই এক দেশ তৈরি করল স্মৃতি আর মায়া দিয়ে জড়িয়ে, যেখানে স্থান ও কাল বিভিন্ন স্তরে একে অন্যের সঙ্গে মিশে যায়, ফ্রেমের পর ফ্রেমে পৃথক পৃথক সময়ের গতিপথ মিলিয়ে যায় কবিতা হয়ে, স্মৃতি ও স্বপ্নের মধ্যের সরলরেখা ফিকে হয়ে যেতে যেতে, এক সময় বিলীন হয়ে যায়। এই সরলরেখা ধরে, ‘অব্যক্ত’ মা ও ছেলের এক অদ্ভুত যাত্রা, যার সঙ্গে লতাপাতার মতো জড়িয়ে যায় অন্দরমহলের নানান গল্প, পুরনো দেরাজের খোপে আটকানো স্মৃতি, মিঞা মল্লারের আলাপ, অব্যক্ত বৃষ্টি— যে যাত্রার শেষে প্রেক্ষাগৃহের অনেকেরই চোখের কোণে জল। মনে হল, দেড় ঘণ্টা ধরে সিনেমা দেখিনি, দেখেছি একটা আশ্চর্য কবিতা।

ইন্দ্র এবং তার মা সাথীর মধ্যে দ্বন্দ্ব, টানাপড়েনকে কেন্দ্র করে ‘অব্যক্ত’র গল্প। দিল্লিতে চাকুরিরত ইন্দ্র পাঁচ বছর পর ফিরে আসে বিধবা মায়ের কাছে, কলকাতায়। নিজের পুরনো বাড়ির অন্দরমহল ও বাহিরমহলের প্রতি খোপে ইন্দ্রের ছোটবেলার স্মৃতি আটকে রয়েছে। যে স্মৃতিগুলো থেকে সে বরাবর পালিয়ে আসতে চেয়েও পারেনি। কারণ, তারা ফিরে আসে স্বপ্নে। আর এই প্রত্যাগমনে সেই সব স্মৃতির এক অদ্ভুত পাকদণ্ডীতে হারিয়ে যায় ইন্দ্র। যার প্রতি বাঁকে সে সম্মুখীন হয় অতীতে ফেলে আসা দুঃসময়, ভয়, রাগ, ঘেন্নার। এই পাকদণ্ডীর রাস্তায় দিল্লিতে সেটল্‌ড ইন্দ্রের মুখোমুখি হয় তার শৈশব, যে শৈশব মায়ের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে নারীর বসনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার অপরাধে নির্যাতিত, ডল হাউস ও রান্নাবাটি খেলতে চাওয়ার দোষে অপমানিত, দিনের পর দিন— কারণ, দিনের শেষে সে পুরুষ লিঙ্গ।

কী ভাবে সময়ের এক একটা ফ্রেম, কখনও একটা পুরনো কাঠের বাক্সে, কখনও গুরুজনের অতীতচারণায়, অথবা কখনও এক অ্যালঝাইমার্স রোগীর স্মৃতিতে আটকে থাকে নিপাট ভাবে, অর্জুন দত্ত আমাদের খুব যত্ন নিয়ে তা ধরিয়ে দেন। এই ছবিতে টাইম ও স্পেস ভীষণ অদ্ভুত ভাবে বার বার গণ্ডিরেখা পেরিয়ে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। সময়ের রৈখিক গতিপথ ধরে বিভিন্ন ‘কাট’-এর মাধ্যমে ক্যামেরার অনায়াস চলাচলে ক্যামেরা নিজেই একটি চরিত্র হয়ে উঠেছে, যে ইতিহাস থেকে সমকালের মধ্যে এক সহজ সেতু তৈরি করে দেয়। বিরতির আগের দৃশ্যের অসামান্য এডিটিং অতীত-বর্তমান-স্বপ্ন-বাস্তব-স্মৃতির এক আশ্চর্য সহাবস্থানে অদ্ভুত অনুভূতি সঞ্চার করে। প্রতিটা দৃশ্যপটের সংমিশ্রণে মিশে যায় বাবার মৃতদেহ এনে রাখার স্মৃতি, রুদ্রকাকুর মুখ, বিধবা সাথীর নিঃসঙ্গ রাতের চাপা অশান্তি, ইতিহাস, বর্তমান, পুরাতন, কাছের অতীত, দূরের অতীত, দোলের দিন মায়ের থেকে হারিয়ে যাওয়ার ভয়াবহ স্মৃতি, দোলের রঙ— এবং ক্যামেরায় ধরা প্রত্যেকটা স্টিল ফ্রেম, সময় থমকে দাঁড়ানোর প্রতীক হয়ে ওঠে, যা চরম উচ্চতায় পৌঁছায় বিরতির আগের শেষ ফ্রেমে। অন্দরমহলের বারান্দার দুই প্রান্তে রেলিংয়ে ঝুঁকে থাকা ন্যুব্জ মা ও ছেলের অবয়ব ধরা এই একটি ফ্রেমে, পরিচালক সাথী ও ইন্দ্রের মানসিক এবং ভৌগোলিক দূরত্ব দেখিয়ে দিয়েছেন অনবদ্য ভাবে।

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায় সাথীর প্রতিটা আবেগ-অনুভূতি ফুটিয়ে তুলেছেন খুব যত্ন নিয়ে। এত বড় অভিজাত অট্টালিকায় একা থাকা সাথীর একাকী মুহূর্তযাপন এবং দীর্ঘ প্রাপ্ত অবহেলার ক্লান্তি নিখুঁত ভাবে ফুটে উঠেছে তার ছেলের উদ্দেশে প্রশ্নে— ‘‘আমার যখন দিদার মতো বয়স হয়ে যাবে তখন তুই আসবি আমায় দেখতে?’’ ইন্দ্র এই ছবির এক মূল চরিত্র, তাই অভিনেতা হিসেবে অনুভব কাঞ্জিলালের দায়িত্ব ছিল অনেক বেশি। সে দিক থেকে মনে হল যেন, তাঁর অভিনয় আরও জোরদার হওয়ার দাবি রেখেছিল, বিশেষ করে কিছু অংশে অর্পিতার শক্তিশালী অভিনয়ের পাশে তাকে একটু ম্রিয়মানই লাগে। কৌশিক তথা ইন্দ্রের বাবার চরিত্রে অনির্বাণ ঘোষ যথাযথ। তবে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখেন আদিল হুসেন, যিনি অভিনয় করেছেন কৌশিকের বন্ধু রুদ্রের চরিত্রে। তাঁর ইংরেজি উচ্চারণে ওথেলো বা ম্যাকবেথের সংলাপ মুগ্ধ করে। যেমন মুগ্ধ করে তার পরিমিত অথচ সূক্ষ্ম অভিনয় ক্ষমতা।

আরও পড়ুন: নেতাজি গুমনামী হতে পারেন না, বললেন কবীর খান

এই ছবিতে আর এক জন বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখেন, তিনি সৌম্য ঋত, ‘অব্যক্ত’-র সঙ্গীত পরিচালক। তার হিন্দুস্তানী রাগের সচেতন ব্যবহার ও প্রয়োগ, এক একটি দৃশ্যের অর্থের অন্য মাত্রা যোগ করে। বিশেষত সেতারে মিঞা মল্লারের গৎ দিয়ে এক একটি দৃশ্যনির্মাণ অসাধারণ। তবে, তাঁকে ধন্যবাদ আর একটি কারণেও, কোনও যন্ত্রানুসঙ্গ ছাড়া কেবল তানপুরায় ‘‘কাঁদালে তুমি মোরে...’’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটির ব্যবহার— এই দৃশ্য মনে করিয়ে দেয় ‘‘পারমিতার একদিন’’-এর ‘‘হৃদয় আমার প্রকাশ হল...’’কে।

আরও পড়ুন: সাতপাকে বাঁধা পড়লেন ‘ত্রিনয়নীর’-র সুধা, প্রকাশ্যে এল ছবি

সিনেমাটোগ্রাফি ও এডিটিং অনবদ্য। সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম, প্রতিটি মুহূর্ত কবিতার মতো দেখতে লেগেছে পর্দায়। কখনও আলোর বিপরীতে ছায়ার সিল্যুয়েট, কখনো স্লো মোশন, কখনও অপ্রত্যাশিত বেশ কিছু কাট ব্যবহার করে বাস্তব ও পরাবাস্তবের মধ্যে একটা সংযোগ তৈরি হয়েছে। বহু দিন পরে, অর্জুন দত্তের হাত ধরে বাংলা সিনেমা জগৎ, ফর্ম ও কন্টেন্ট— দু’দিক থেকেই এত পরিপূর্ণ একটি ছবি উপহার পেল। ‌ছবিতে ক্লাইম্যাক্সে পরিচালক এক মারাত্মক টুইস্ট রেখেছেন, যা অব্যক্ত অনেক কথাই ব্যক্ত করে।

এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ‘অব্যক্ত’ ভীষণ জরুরি একটা সিনেমা এবং অতি অবশ্যই হলে গিয়ে দেখে আসার দাবি রাখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cinema Abyakto Arpita Chatterjee Adil Hussain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE