Advertisement
২০ মার্চ ২০২৩
Anirban Bhattacharya Jisshu Sengupta

মুভি রিভিউ ‘ঘরে বাইরে আজ’: নব্য দেশপ্রেমকে চিনতে শেখালেন অপর্ণা

এই প্রথম বৃন্দার জন্য এত মনখারাপ!

বৃন্দার চরিত্রে তুহিনা। ছবি-ইনস্টাগ্রাম।

বৃন্দার চরিত্রে তুহিনা। ছবি-ইনস্টাগ্রাম।

স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৯ ১৬:৪১
Share: Save:

Advertisement

মুভি রিভিউ ‘ঘরে বাইরে আজ’

পরিচালক: অপর্ণা সেন


অভিনয়ে: যিশু সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য,তুহিনা দাস, অঞ্জন দত্ত

Advertisement

এই প্রথম বৃন্দার জন্য এত মনখারাপ!
মনখারাপ অপর্ণা সেনের ‘ঘরে বাইরে আজ’দেখার পর।
মনে আসে না রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে বাইরে’বা সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’-কে নতুন প্রেক্ষাপটে দেখছি। বরং মনে হয় এ ছবির ঘরে বাইরে সব জুড়ে শুধুই পরিচালক অপর্ণা সেন। তাঁর রাজনৈতিক বোধ। ভালবাসার চেতনা। জোরালো সংলাপ আমাদের প্রায় সব কিছুতে চুপ করে থাকা ‘আমি’কে নাড়া দিয়ে যায়। প্রশ্ন আসে...
জাতীয়বাদের ধ্বজায়হিন্দু রাষ্ট্র নির্মাণের জোয়ারে কিগণতন্ত্রের অন্তর্জলি যাত্রা আসন্ন?
যে মানুষসংখ্যাগরিষ্ঠ মতের বিরুদ্ধে মাথা তুলবে তার কণ্ঠস্বর থামিয়ে দাও!এই কি রাজনীতি? সেই বিরুদ্ধ কণ্ঠস্বরের নাম গৌরী লংকেশ হতে পারে, আবার সে ‘ঘরে বাইরে আজ’-এর নিখিলেশও হতে পারে।
বাংলাদেশে ব্লগার খুন। কাশ্মীরে সাংবাদিকদের প্রশাসন বিরোধী সন্দেহে থানায় তুলে নিয়ে আসা। ‘মুসলমানরা পাকিস্তানে যাক’,এ সব ঘটনায় চোখ সয়ে যাওয়া আমাদের অপর্ণা সেন একবার বৃন্দা, নিখিলেশ আর সন্দীপের জটিল রসায়নের মধ্য দিয়ে কোথাও ঘা দিলেন। প্রযুক্তির চাঁদ ছোঁয়া সময়ে আমরা ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে মেতেছি। শুধুই কি বহিরঙ্গ?এই রাজনীতির কালো ছায়া নিখিলেশ আর বৃন্দার জীবনকেও কালো মেঘে ঢেকে দেয়। এই মেঘের নাম সন্দীপ!

সন্দীপের ভূমিকায় যিশু সেনগুপ্ত


এই প্রথম সন্দীপের জন্য মায়া হয়!এই মায়ার কারণ যিশু সেনগুপ্ত। সেক্স অ্যাপিল থেকে আত্মবিশ্বাসেরমেজাজ, তিনি সারা ছবি জুড়ে খেলেছেন।বৃন্দার উষ্ণতায় তাঁর শরীর থেকে ঠিকরে বেরোয় স্বেদবিন্দু। আবার ক্রুদ্ধতায় তাঁর চোখের অভিনয় মুগ্ধ করে। তবে সন্দীপের মুখোশ খুলে দেন পরিচালক নিজেই। নিজের আখের গোছাতে বৃন্দাকে ‘দলিত মেয়ে’বলে চিহ্নিত করতেও পিছপা হয় না সন্দীপ।অপর্ণা দেখিয়েছেন সন্দীপ প্রেমিক চেহারায়। কথনে। শরীরে। মনে নয়! তবে এত পরিণত যিশু। যৌন দৃশ্যে অনায়াসে নারী মনের আগল ভাঙতে পারা যিশু এ ছবির সম্পদ।

আরও পড়ুন-একটা সুযোগ দিয়ে দেখুন, ভাল লাগলে হাততালি দেবেন, না হলে গালাগালি: টোটা


এই প্রথম শুধুই নিখিলেশময় ‘ঘরে বাইরে আজ’নয়। মনে হয় না সন্দীপের কাছে শরীর-মনের দরজা খুলে দেওয়ায় বৃন্দা তার শাস্তিস্বরূপ নিখিলেশকে হারিয়েছে। বৃন্দাকে কাঠগড়ায় তোলেননি পরিচালক। এই শতকের বৃন্দা সে! সব অর্থেই স্বাধীন। যেমন নিখিলেশ স্ত্রীকে প্রিয় ল্যাপটপ বা সাধের পাইপের মতোই যে ‘পজেস’করে না!সেটা জানিয়েও দেয়। যে সব স্বামীআজও স্ত্রীর ব্লাউজের কাট থেকে মোবাইল আর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিজেদের মতামত আরোপ করে তারা একবার ছবিটা দেখলে ভাল হয়!
এ ছবিতে অনির্বাণ ভট্টাচার্য কলেজের চেহারা থেকে পরিণত বয়সে সমানভাবে আকর্ষণীয়। নিখিলেশ শ্রান্ত। বাইরে সেকুলার পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে, গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ঠান্ডা তেজ অনির্বাণে চোখের ভাষায় দৃপ্ত। শুধু তাঁর ইংরেজি অ্যাকসেন্ট কানে আঘাত করে। অক্সফোর্ড ফেরত এক নামী সংবাদমাধ্যমের এডিটর বলেই কি এই উচ্চারণ?

নিখিলেশের ভূমিকায় অনির্বাণ ভট্টাচার্য


এই প্রথম ঘরে বাইরের বৃন্দার মতো ব্যক্তিত্ব এত শক্তিময়ী! সে স্বচ্ছ! নিখিলেশকে বলতে পারে, সন্দীপকে তার ভাল লাগছে।তুহিনা দাস। অভিনয় সাজ রুচি, সব মিলিয়ে অপর্ণার ‘বিমলা’আর ছবির ‘বৃন্দা’হয়ে উঠেছেন।নিখিলেশময় জীবন তার। নিখিলেশ ছাড়া সে বাইরের পুরুষের আঁচ পায়নি।তাকে নিখিলেশ বলেছিল বাইরের পুরুষদের সঙ্গেমিশলে সে হয়তো অন্য পুরুষের প্রেমেও পড়তে পারত। স্বামীর এই বাক্য মিলে গেল বৃন্দার জীবনে। সন্দীপের শরীরী আকর্ষণে নদী হয়ে উঠল বৃন্দা। এতটাই মুগ্ধতা যে সন্দীপ তাকে টেনে নিয়ে গেল মন্দিরে। ভেঙে পড়ল নিখিলেশের সেকুলার ঘর। বৃন্দা মন্দিরে হাঁটা দিল মুগ্ধতার নেশায়। অন্য দিকে নিখিলেশ শূন্য। সেই শূন্যতার টানমনোময় ভট্টাচার্যের ‘ভরা ভাদর’গানেও। নীল দত্তের সঙ্গীত মানানসই।
সন্দীপের ‘বি’। ঝাঁকড়া চুলের বন্য বৃন্দার শরীরেও ঝড় থামল একদিন। সে তখন ঠান্ডা পাথর! এই বৈপরীত্য ফুটিয়ে তোলার অভিনয় তুহিনার পরবর্তী বাংলা ছবিতে কাজ পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে দিল।
পরিচালক অপর্ণা সেন ধরতে চাইলেন এক নব্য জাতীয়তাবাদকে।নবাগত দেশপ্রেম। যা মগজ ধোলাইয়ের মতো মানুষের মধ্যে জারিত হচ্ছে। এর শিকার হয়তো ছবির অমূল্য দত্ত ওরফে ঋতব্রত মুখোপাধ্যায়। প্রাণবন্ত অভিনয়ে নজর কাড়েন তিনি। উদারমনা অধ্যাপকের চরিত্রে অঞ্জন দত্ত অনবদ্য।
সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু নিখিলেশের মৃত্যু আসন্ন জেনেও সন্দীপ বলে, মেজরিটি যা চায় তাই হবে এ দেশে। এই সংখ্যগুরুদের জোরের কাছে যুক্তিবাদী মুক্তমনা উদারনীতির কোনও জায়গা নেই। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিখিলেশের মৃত্যুই না হয় হবে।তাতেই বা কী!
ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে ত্রিকোণ প্রেমের গল্প বলেননি অপর্ণা।ছবির পরিসরকে বিশ্বের মাঝে নিয়ে গিয়েছেন। প্রকৃতি আসার পর এসেছে ঈশ্বর...ঋগ্বেদে দর্শককে পৌঁছে দিচ্ছেন অপর্ণা।

আরও পড়ুন-‘সেক্স রিহ্যাবে যান’, #মিটু বিতর্কে আবারও অনু মালিককে এক হাত দিলেন সোনা


অপর্ণার এই ছবি সহজ করে বলা কঠিন বিষয়! আজকের উগ্র হিন্দুত্ববাদের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেছেন তিনি। আবার মুসলমানদের হাতে হিন্দুযাত্রীদের হত্যার কথা বলতেও ভোলেননি। কোনও পার্টি পলিটিক্সেই মানুষের হিত আর হবে না। নির্ভয়ে জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি!এ ছবিতে চিকিৎসক বিনায়ক সেনকে এনেছেন বিনয় সেনের আদলে। বস্তারের রুক্ষ জীবন এনে মাওবাদী সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন। নিখিলেশ, সন্দীপ আর বৃন্দাকে আধুনিক ভারতের প্রেক্ষিতে দেখিয়েছেন অপর্ণা। ভাল লাগে রবিরঞ্জন মৈত্র আর শমীক হালদারের কাজ।
বক্স অফিসের জন্য হিসেব করা ছবি নয় ‘ঘরে বাইরে আজ’। এই ছবি শুধুই এক ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নয়,জীবন আর সেলুলয়েডের বেড়া ভেঙে অপর্ণা সেনের নিরন্তর পরিক্রমার গল্পও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.