Advertisement
E-Paper

সে দিন চৈত্র সেল

আজ চৈত্র সেলের শেষ দিন। অনেকের মতো সেই ফুটপথে একা হাঁটতে হাঁটতে জিয়া নস্টাল হল শ্রীজাত-র।দিব্যি মনে পড়ছে, “দেখলে হবে? খরচা আছে” নামক প্রবাদটি আমি প্রথম শুনেছিলাম গড়িয়া মোড়ে, ভরপুর সেলের বাজারে। তখন কথাটা নতুন নতুন মার্কেটে পড়েছে, দেদার পপুলারিটি। তবে চিরকালীন হয়ে ওঠার পথে এত দ্রুত ট্র্যাভেল করবে, সেটা তখনও বুঝিনি।

শেষ আপডেট: ১৪ এপ্রিল ২০১৪ ০০:০০
অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য।

দিব্যি মনে পড়ছে, “দেখলে হবে? খরচা আছে” নামক প্রবাদটি আমি প্রথম শুনেছিলাম গড়িয়া মোড়ে, ভরপুর সেলের বাজারে। তখন কথাটা নতুন নতুন মার্কেটে পড়েছে, দেদার পপুলারিটি। তবে চিরকালীন হয়ে ওঠার পথে এত দ্রুত ট্র্যাভেল করবে, সেটা তখনও বুঝিনি। উন্মাদ হয়ে যাওয়ার মতো ভিড়, কে কোন দিকে কেন হনহন করে চলেছে তার কোনও ব্যাখ্যা কোথাও নেই। হুড়ুদ্দুম গরম, দুপুরের কালাহারিকে এনি মোমেন্ট এক হাত নিতে পারে....তার মধ্যে বাঙালির এই অত্যাশ্চর্য উতলাপনা।

সেই বোম্বাস্টিক ভিড় ভেদ করে আকাশের দিকে উঠেছে চিরে যাওয়া কণ্ঠের আওয়াজ ‘দেখলে হবে? খরচা আছে!’ এবং যে দিক থেকে কথাটা শোনা যাচ্ছে, সে দিকে উন্নততর ভিড়। ঠেলেঠুলে পৌঁছে দেখা গেল, সিড়িঙ্গিমার্কা প্যাঁচালো একটা লোক এন্তার ফটাশ জল বিক্রি করছে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এই পৃথিবীকে অনেক দিয়েছে। তার মধ্যে প্রধান গিফট্ এই ফটাশ জল। স্বাদের ব্যাপারটা পরে আসছে, কোল্ড ড্রিংকের বাতিল বোতলে পুরে রাখা এই সুস্বাদু এবং অবশ্যম্ভাবী অপরিষ্কার জলকে ক্রেতার কাছে পেশ করার ভঙ্গিটাই একটা আর্ট। এবং ছিপি খোলার সময় যে আওয়াজ হয়ে থাকে তারই নামে এই আবিষ্কারের নামকরণ। সেলে অন্য কিছু বিকোক না বিকোক, মারকাটারি গরমের সন্ধেবেলা ফটাশ জলের মার নেই। যিনি দু’হাত ভরে কিনে বাড়ি ফিরছেন, তিনি তৃপ্ত মুখে ফটাশ জল পান করছেন, যিনি কিছুতেই দোকানদারদের সঙ্গে দরদামে এঁটে উঠতে পারেননি, তিনিও চালাচ্ছেন। কিন্তু এ হেন অমৃতবারি বিক্রির ক্যাচলাইন যে কেন ‘দেখলে হবে? খরচা আছে’, তা বোঝা মুশকিল। কিন্তু যাহা সাকসেসফুল, তাহা অকোয়েশ্চেনীয়। সুতরাং ফটাশ জল জিন্দাবাদ।

চৈত্রসেল। সে যে কী বস্তু যে না দেখেছে, তাকে বোঝানোর সাধ্যি নেই। অন্য কোনও জাত হলে যে-গরমে ফ্যামিলি নিয়ে ফ্রিজে ঢোকার নাছোড় চেষ্টা চালাত, ঠিক সেই হাড়জ্বালানি গরমে বাঙালি সগৌরব নতুন বছরের কেনাকাটা সারতে বেরোয়। স্টেডি দোকান তফাত যাও। ফুটপাথ বুকে আও। এই রকম একটা দরদী মনোভাব নিয়ে যখন রাস্তা-কে-রাস্তা সেজেগুজে ঝলমল করে ওঠে, গরমের অহঙ্কারী বেলুনকে টোকায় চুপসে দিয়ে এই একটি জাতই পারে গায়ে গা লাগিয়ে ঢল নামাতে। চৈত্রসেল মানেই ফুটপাথের অপেরা। মেন রোডের গঙ্গাসাগর। টেপ জামা থেকে হাতাখুন্তি, চিরুনি থেকে খেলনা বন্দুক, লুঙ্গি থেকে টুথপিক। বিষয়বৈচিত্রে সেরা, স্বপ্ন দিয়ে তৈরি, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। গ্রীষ্মে টাইট খেয়ে মশারাও যেখানে দূরে দূরে উড়ছে পারতপক্ষে গায়ে গা লাগাচ্ছে না, সেখানে বাঙালির গায়ে তখন নিজের চেয়ে অন্যের ঘামই বেশি। সেল সমুদ্রে জীবনবোট ভাসিয়ে সে তখন মহানন্দে মাখোমাখো। এই অবস্থাকেই একজ্যাক্টলি শাস্ত্রে বলেছে তুরীয়। সঙ্গে ভেলপুরিও।

আমাদের ছোটবেলায় এমন ঘামসন্ধে নেহাত কম আসেনি। খেলেধুলে বাড়ি ফিরে পা ধুয়েটুয়ে পড়তে বসব প্রায়, এমন সময় মা ভাল জামা পরে নিতে বলেছেন। ব্যস্ এক লাফ। নির্ঘাত সেল দেখতে নিয়ে যাবে। বাবা বলতেন, সেলে যাওয়ার চেয়ে জেলে যাওয়া ভাল। কিন্তু মা দিন দুয়েক অন্তত গড়িয়ামোড়ে হানা দিতেনই আমার হাত ধরে। যত দূর চোখ যায় বাঙালির তীক্ষ মাথা গিজগিজ। অটোফটো সাইড হয়ে গিয়েছে। কোনও কারণে ট্যাঙ্ক এসে দাঁড়ালেও ঢোকার রিস্ক নেবে না এমনই ভিড়। সবাই যে কিনছে খুব এমনটা না। কিন্তু এই যে রাস্তা জুড়ে কেনাকাটার একটা জমজমাট যামিনী, তাতেই বা কম আহ্লাদ কীসের? তার ওপর দরদামও একটা শিল্প, সেও তো বাঙালি বৌদিরাই প্রথম প্রমাণ করলেন। একটা শিরশিরে ম্যাক্সির দাম যদি দোকানি বলেন, ‘কিলিমাঞ্জারো’, বউদি সটান শুরু করবেন শিলিগুড়ি দিয়ে। ওই উচ্চতা থেকে এক ঝটকায় এই গভীরতায় চ্যালেঞ্জের কারিগরি বাঙালি বউদিদের হাতের পাঁচ। শেষমেশ চরম কাঁচুমাচু টানাপড়েন, বৌদির ‘রাখো তোমার ম্যাক্সি’ বলে অভিমানী মুখ ঘুরিয়ে চলে যাওয়া, পরমুহূর্তে সন্ধের বাড়ি যাওয়া আশা পারেখের প্রতি রাজেশ খন্নার ডাকের মতো একটা আওয়াজ। ম্যাক্সি-মাম লস খেয়ে শুধু সেই বৌদির জন্য এই দামে দোকানীর রাজি হওয়া, যা কিনা সে আগের বৌদির জন্যও হতে বাধ্য হয়েছে।

সেলের রাজা হল গড়িয়াহাট। দৈবাত্‌ কোনও বছরে গড়িয়াহাটে যাওয়ার সুযোগ হলে হাতে চাঁদ পেতাম। টানা পাঁচ বছর দিঘার পর গোয়া নিয়ে গেলে যা হয়। ফ্লাইওভারহীনতায় এক সময় বাঁচতে চাইত গড়িয়াহাট। সেই আদিম গড়িয়াহাটের শেষ চৈত্রের সন্ধে যাঁদের স্মৃতিতে রয়েছে তাঁরা জানেন ডাইনোসর-ফাইনোসর কোনও ব্যাপার না। স্পিলবার্গকে একবার গড়িয়াহাট সেলের বাজারে এনে ফেলতে পারলে তিনি শিওর শট ‘উন্নাসিক পার্ক’ নামে ছবি বানাতেন। সারা পৃথিবী এক দিকে, গড়িয়াহাট এক দিকে। ব্রিগেডকে বলে ‘পকেটে থাক’, বইমেলাকে বলে ‘চেপে যা।’

গড়িয়ায় ফটাশ জল তো গড়িয়াহাটে রোল। বিশেষ করে এগরোল, যা আমাদের ছোটবেলায় দুর্দান্ত জনপ্রিয় ছিল। ওই গরমে হাঁই হাঁই করে রোল খেয়ে আবার ভিড়ে ডুব দিতেও একমাত্র বাঙালিই পারে। সেলের দমকা হাওয়ায় কবিতার টুকরোও কি উড়ত না? ওই গড়িয়াহাটের ভিড়েই শুনেছিলাম অসামান্য উচ্চারণ ‘সস্তা আছে টেরেলিন/কেড়ে লিন মেরে লিন।’ এমন বিচক্ষণ অন্তমিলযুক্ত দ্বিপদীর এ হেন বাণিজ্যিক ব্যবহার সেও বোধ হয় একমাত্র বাঙালির পক্ষেই সম্ভব।

এখন প্রশ্ন, সেই বাঙালির, সেই বাংলারই বা কী হল? ফুলের বনে হা হা করে ফিরে গেল ফাগুন। চৈত্রের রাজপথেও পায়ের ছাপ নেই বড় একটা। দোকানিরা পশরা নিয়ে বসেননি তা নয়, কিন্তু উদ্যাপনের রাজকীয়তা নেই। বরং কোথাও যেন একটা অভ্যেসের দায় চলে এসেছে। ট্র্যাফিক বয়ে চলেছে নিশ্চিন্তে। চৈত্র সেলের চোখরাঙানির সামনে তাকে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে না।

এ কেমন দিন এল? ঝলমলের মধ্যবিত্ত বানান ভেঙে কেবল মলটুকু নিয়েই কি তবে খুশি থাকল কলকাতা? যেখানে সারা বছর কোনও না কোনও মিহি বাহানায় চলতে থাকে সেল। চৈত্র লাগে না। গরমও লাগে না অবশ্য। ঠান্ডা ঘেরাটোপে ফুরফুরে অবস্থায় দিনভর ঘুরে বেছে নেওয়া যায় মনের মতো জিনিস। দরদামের শিল্পও এখন প্রায় জাদুঘরে। বিক্রির খাতিরে বুক নিংড়ে ‘বৌদি’ বলে ডেকে ওঠা সেই সব রোগা অন্ধকার দোকানিরাও কোথায় যেন গা ঢাকা দিয়েছে। ট্যাগেই লেখা আছে কোন জিনিসে কত পারসেন্ট ছাড়, ম্যাডাম নিশ্চয়ই পড়ে নেবেন।

তবে চৈত্রসেলের সেই রমরমা হয়তো এখনও জারি, একটু মফস্সলের দিকে। খোদ কলকাতার বুকে সে টিকে আছে টিমটিম করে। হয়তো গড়িয়াহাটে। হয়তো হাতিবাগানে। কিন্তু তার অহঙ্কারের ফিটন এখন লঝঝড়ে সাইকেল। বেশির ভাগ বাঙালিই সেল ছেড়েছে। সেলফি ধরেছে। ভিড়ে মিশে যাওয়ার বদলে নিজের ভিড়ে মিশিয়ে দিতে চাইছে বাকিদের। প্রহরশেষের রাঙা আলোয় নিজের চোখেই সে নিজের সর্বনাশ দিব্যি দেখতে পাচ্ছে।

সে দিন চৈত্র-সেল ছিল। আজ চৈত্র-পার্সেল হয়ে গেছে। কেনার সময় পার। এখন তো বেচার দিন, বিক্রি হয়ে যাওয়ার মরসুম। নিজেকে সস্তায়, যত অভিনব কায়দায় পেশ করা যাবে বাজারে, খদ্দের জুটে যাবে ততই। ফুটপাথের অপেরা নিবে আসবে একে একে...কেউ তার কথা মনেও রাখবে না!

choitra sale srijato
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy