দুর্নীতি, জাল টাকা আটকাতে ২৮ বছর আগে দেশটা ডিমনেটাইজেশন করে পুরনো টাকা তুলে নিল। নতুন টাকা বেরোল বাজারে। তবু সমস্যা মিটল না। গরিবগুর্বোরা সেই তিমিরেই থেকে গেল। টাকা বাতিলের দেশে এসে এমনই সব গল্প শোনাল আর এক দেশের টাকা বাতিলের ছবি।
কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে এ বার দেখানো হল তাইওয়ানের পরিচালক মিডি জেড-এর ‘দ্য রোড টু ম্যান্ডালে।’ মিডির জন্ম মায়ানমারে, কিন্তু সে দেশের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করে এখন তাইওয়ানেই থাকেন তিনি। কলকাতার উৎসবে আসার আগেই তাঁর ছবিটি মায়ানমারে দেখানো হয়েছে। মিডি সেটিকে ঐতিহাসিক মুহূর্ত বলে মনে করেন।
এ বছরই তৈরি হওয়া ‘রোড টু ম্যান্ডেলে’ মায়ানমার থেকে কাজের খোঁজে তাইল্যান্ডে আসা বেআইনি অভিবাসী শ্রমিকদের জীবনের গল্প বলে। দালাল ধরে মায়ানমারের লোকেরা যখন সীমান্ত পেরিয়ে তাইল্যান্ডে ঢুকলেই, দালালেরা পরিষ্কার বলে দেয়, ‘তাই ভাট দাও। চ্যাট (মায়ানমারের মুদ্রা) নয়। ওর কোনও দাম নেই।’
দেশ জুড়ে যখন একই কারণে নগদ-সঙ্কট, তখন এ ছবি মনে করাল এ মহাদেশে সব চেয়ে ঘন ঘন ডিমনেটাইজেশন হয়েছে মায়ানমারে। ব্রিটিশ আমলে সেখানে চলত ভারতীয় ‘রুপি’। স্বাধীনতার পরে, ১৯৫২ সালে এল নতুন মুদ্রা ‘চ্যাট’। ১৯৫৮ সালে এল ৫০ ও ১০০ চ্যাট। কিন্তু ১৯৬৪ সালে সেগুলি আবার তুলেও নেওয়া হল।
তার পরে শুধুই হুড়ুমতাল। ১৯৮৫ সালে বাজারে এল ৭৫ চ্যাট। মায়ানমারের সামরিক শাসক নে উইনের সে বার ৭৫ বছর পূর্তি। বেরোলো ১৫, ২৫ ও ৩৫ চ্যাটের নোটও।
কোনও আগাম ঘোষণা ছাড়া এক বছরের মধ্যে সেই ২৫, ৩৫–এর চ্যাটগুলি আবার বাতিলও করে দেওয়া হল। দেশের ৭৫ শতাংশ মুদ্রাই তখন অর্থহীন। সেই বছরেই আবার বেরোলো ৪৫ ও ৯০ চ্যাটের মুদ্রা। এ রকম আজব সংখ্যা কেন? কারণ ৯ হল জেনারেল নে উইনের প্রিয় সংখ্যা।
১৯৮৯ সালে এই ৯-এর চক্কর থেকে বেরোলো মায়ানমার। ৪৫, ৯০ চ্যাটের মুদ্রা উঠিয়ে বেরোলো ২০, ৫০, ১০০ চ্যাটের নোট। ২০০৪ সালে বাজারে এল ১০০০ চ্যাট। পাঁচ বছর পরে এল আরও বড় অঙ্ক। মায়ানমারের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক বাজারে নিয়ে এল ৫০০০ চ্যাটের নোট। চার বছর আগে, ২০১২ সালে বোরিয়েছে নতুন ১০ হাজার চ্যাট। মায়ানমারের মতো এত ঘন ঘন টাকা বদল খুব কম দেশেই হয়েছে।
তবু দেশটার দারিদ্র ঘুচল না। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মতে ঘোচার কথাও ছিল না। কয়েক বছর আগে মায়ানমার গিয়ে তিনি দেখেছিলেন, সে দেশের উত্তর প্রান্তে চ্যাটের পাশাপাশি সমান তালে চলে চিনের মুদ্রা আরএমবি। ‘‘শুধু ডিমনেটাইজ করলেই হয় না। দেশটায় গণতন্ত্র নেই, অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি হয়নি। এই সমস্যাগুলির দিকে তখন ওরা নজর দেয়নি,’’ বলছিলেন তিনি।
হাজারের বদলে পাঁচ, দশ হাজারের মুদ্রা এনেও তো অর্থনীতি সেই তিমিরে। এখনও এক ডলারের মূল্য ৮১৮ চ্যাট। ব্যাঙ্কের বদলে ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারদের কাছে গেলে সেটি প্রায় ১২০০। দরিদ্র মায়ানমারের সঙ্কট আজও কাটেনি। মিডির ছবিতে বেআইনি অভিবাসীরা তাই শুধু তাইল্যান্ডে এসেই ক্ষান্ত দেন না, তাইওয়ান যাওযারও স্বপ্ন দেখেন। ‘‘এখানে আচমকা ডিমনেটাইজেশন করে কী হল? কালো টাকা উদ্ধারের দরকার অবশ্যই আছে। কিন্তু কোনও রকম প্রস্তুতি বা চিন্তা-ভাবনা না নিয়ে সেটি করতে গেলে লোকের হয়রানিই বাড়ে,’’ বলছিলেন অভিরূপবাবু।