প্রশ্ন: থিয়েটার করছেন বহু বছর। পর্দায় অভিনয়ও। কোনটা বেশি কাছের?
রজতাভ: দুটোর তুলনা করা মুশকিল। মায়ের কাছে দুই সন্তানের মতো অনেকটা। এটুকু বলতে পারি, থিয়েটারের জন্য ছবি বা ছবির জন্য থিয়েটার, কোনওটাই ছেড়ে দেব না। দুটোই আমায় করতে হবে।
প্রশ্ন: ধারাবাহিকে কাজ করতেন এক সময়ে। ছবির জন্যই কি ছেড়ে দিলেন?
রজতাভ: বড় পর্দায় আমি সেই ১৯৯৫ সাল থেকেই কাজ করছি। পাশাপাশি ধারাবাহিকও করতাম। কিন্তু একটা সময়ে দেখলাম, ধারাবাহিকে কাজের পরিমাণ বা তাতে ব্যস্ত থাকার সময়টা এত বাড়ছে যে ছবির শ্যুটিং করতে গিয়ে অসুবিধেয় পড়তে হবে। তাই সচেতন ভাবেই ধারাবাহিক করা বন্ধ করে দিই। পরবর্তীতে অল্প সময়ের কাজ বা ক্যামিও চরিত্রের ডাক এসেছে ছোট পর্দা থেকে। কিন্তু তত দিনে মনে হয়েছে, আমি যে ধরনের ধারাবাহিকে কাজ করে অভ্যস্ত, ছোট পর্দার ধরন তার চেয়ে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। ফলে আগের মতো আনন্দ হয়তো আর পাব না। ছোট পর্দার কাজ কখনও করব না তো বলিনি। ভবিষ্যতে যদি মনে হয় ছবিতে আমার দিন ফুরিয়েছে, তা হলে গ্রাসাচ্ছদনের প্রয়োজনে হয়তো আবার ধারাবাহিকে কাজ করব। কারণ মেগা সিরিয়াল অনেক দিন ধরে চলে। নিরাপদ রোজগার। কিন্তু ফিরতে হলে এক্সক্লুসিভ হয়েই ফিরব। দু’জায়গায় একসঙ্গে কাজ করব না।
প্রশ্ন: আর গান? আপনাদের তো ব্যান্ডও ছিল।
রজতাভ: গানের সঙ্গে সম্পর্ক বহু যুগ হল শেষ। আমাদের ব্যান্ড ‘কুইনাইন’ সাড়ে তিন বছর টিকে ছিল। তার পরে আর গান লেখা, ভাবা কোনওটাই হয়ে ওঠেনি। ছড়ার গান লিখতাম, সে সবও আর হয়নি। আসলে থিয়েটার করতে গিয়ে উঁচু স্বরে সংলাপ বলা, বিভিন্ন চরিত্রে নানা ধরনের কণ্ঠস্বরে কথা বলা— বছরের পর বছর করতে গিয়ে ভোকাল কর্ডে চাপ পড়েছে যথেষ্টই। গান গাইতে হলে গলায় যে পেলবতা, যে মসৃণতা প্রয়োজন, সেটা আর সম্ভব হয় না। আমার গান তাই এখন ইতিহাস হয়ে গিয়েছে। এক সময়ে যে গান শিখেছি, নিয়মিত তালিম নিয়েছি, সে সব আর মনে পড়ে না!
প্রশ্ন: জনপ্রিয় রিয়্যালিটি শো-এর বিচারক ছিলেন। সে অভিজ্ঞতা কতটা আলাদা?
রজতাভ: ওই শো-টায় টানা দশ বছর বিচারক ছিলাম। এক-একটা সিজন মানে অনেকখানি অক্সিজেনের মতো। অপেক্ষা করে থাকতাম আমরা সকলেই। মজা করতাম, পাগলামি করতাম। কিন্তু আস্তে আস্তে শো-টার চরিত্র পাল্টে গেল। বাংলা চ্যানেলের অনুষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ চলে গেল মুম্বইয়ের হাতে। সেখানকার লোকেরা চাইলেন, হিন্দি শো-এর বাংলা সংস্করণ হয়ে উঠুক এখানকার শো-টা। বাংলার একটা নিজস্ব রসবোধ, নিজস্ব একটা মজা আছে। হিন্দির অনুকরণ করলে সেই স্বাদ কি আর আসে! তা ছাড়া, ইদানীং অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তুতে, ছবির বিষয়বস্তুতে বিজ্ঞাপন জড়িয়ে ফেলার যে প্রবণতাটা হয়েছে, সেটাও খুব বিপজ্জনক। হিন্দি বিজ্ঞাপনের কুৎসিত অনুবাদের সব ট্যাগলাইন ভুলভাল বাংলায় আমাকেও বলতে হত। চ্যানেলের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী। শো-এর মান নেমে গেল তাতেও। কর্পোরেট-রাক্ষসের তা বোঝার দায় নেই। কিন্তু যে বাংলা নিয়ে নিজে চিরকাল হাসাহাসি করেছি, সেটা নিজেকেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হলে বেশি দিন ভাল লাগার কথা নয়। ইদানীং তো দেখি যা জনপ্রিয় হচ্ছে, তাকেই শিল্প ভেবে নেওয়া হচ্ছে। এটাও তো ক্রমশ সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: এখানকার ইন্ডাস্ট্রি যদি ঘুরে দাঁড়িয়ে এই পরিস্থিতির প্রতিবাদ করে?
রজতাভ: কখনওই হবে না। এটা অলীক কল্পনা। আসলে কর্পোরেট পরিসর নিজে যদি সংস্কৃতির এই ক্ষতিটা উপলব্ধি না করে, শিল্পের ক্ষমতা নেই ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করার। শিল্প অভিমান করতে পারে, দুঃখ পেতে পারে, কিন্তু কর্পোরেটের সঙ্গে যুদ্ধে নামতে পারে না।
প্রশ্ন: এতগুলো বছরে অজস্র ছবিতে অভিনয় করেছেন। পরিচালক হতে ইচ্ছে করেনি?
রজতাভ: ১৮০-র বেশি ছবিতে কাজ করেছি। কিন্তু পরিচালক হতে গেলে অনেক বেশি নির্মম হতে হয়। কম্যান্ড লাগে। আমি সেই তুলনায় নরম মানুষ। সবাইকে বকেঝকে এক জায়গায় নিয়ে আসা আমার দ্বারা হবে না! বলিউডে পরিচালক নিজের কাজ করেন আর বাকি সবটা সামলান ফ্লোর ডিরেক্টর। বাংলায় সীমিত বাজেটে সেই সুযোগ নেই। ফলে মাথা ঠিক রাখা শক্ত। তা ছাড়া শুধু ছবি বানানোই নয়, এখন ছবি বিক্রি বা প্রচারটাও পরিচালকের ঘাড়ে চেপে যায়। অভিনেতারও। যদিও তার কোনও যৌক্তিকতা খুঁজে পাই না। আমি অভিনেতা, চরিত্রটাকে রক্তমাংসের করে ফুটিয়ে তুলব। ছবিটা লোকে কেন দেখবে, কতটা আলাদা, সেটা বলা তো আমার কাজ হতে পারে না! অথচ সেই প্রশ্নগুলোরই উত্তর দিতে হয় সবচেয়ে বেশি। মনে হয় গুঁড়ো সাবান বেচছি! ভাল জিনিস তো লোকে এমনিই দেখবেন, সেটা কত ভাল সেটা আলাদা করে মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে কেন! আজকাল আবার নেটমাধ্যমে ক’জন ফলোয়ার দেখে অভিনেতা বাছাই করা হয়। যাতে তাঁরা ছবির প্রচারে সাহায্য করতে পারেন! কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা তো নানা ভাবে হতে পারে। কারও ছাতার তলায় থেকে, কারও নামে কুৎসার ঘটনায়, রাজনীতির ময়দানে— তার সঙ্গে অভিনয় ক্ষমতার যোগ কোথায়!
প্রশ্ন: আপনি নেটমাধ্যমে নেই?
রজতাভ: শুধুমাত্র হোয়াটসঅ্যাপ। তাতেই এত গুড মর্নিং, গুডনাইট, ফুল-পাতা-কবিতার পাহাড়ের নীচে জরুরি মেসেজ চাপা পড়ে যায় প্রায়ই! ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারে থাকলে আরও কঠিন অবস্থা হবে! ফেসবুকে আমার নামে পেজ দেখা যায়, তবে সেগুলো সব ভুয়ো। তার উপর এটা একটা ফাঁদ। কারণ ফলোয়ার বেশি মানে টাকা রোজগারের সুযোগ। তখন মনে হবে রোজ নিজের কিছু না কিছু খবর তৈরি করি! এমনিই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় কে কী পোস্ট করলেন, কে কার সম্পর্কে কী খারাপ কথা বললেন, কাকে কার সঙ্গে দেখা যাচ্ছে বা যাচ্ছে না, তা নিয়েই চর্চা বেশি। দর্শক নাকি সেটাই বেশি করে জানতে চান আজকাল। তা হলে কি যে কাজ করি, যার জন্য আমার পরিচয়, মানুষের আগ্রহ সেটা নিয়েই সবচেয়ে কম? অভিনেতা হিসেবে কীসে কাজ করেছি, কেমন কাজ করছি, কোন চরিত্রে অভিনয়ের ইচ্ছে, কত দিন অবধি কাজ করতে চাই, সেগুলো বোধ হয় কেউ জানতে চান না।