Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
আনন্দplus এক্সক্লুসিভ

শহরের মঞ্চে শরীরী মিলন

নগ্ন ‘ওথেলো’ নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। আবারও আলোড়ন হতে পারে। কেন? চার মাস পর মঞ্চস্থ হবে মণীশ মিত্র-র নতুন নাটক ‘রক্তভূমি: প্রেম পরব কথা’। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।বারো ফুট বাই দশ ফুট ঘর। লাল মেঝে। তবে তা অন্ধকারের চাদরে ঢাকা। আলো বলতে ঘরে শুধু তখন তিনটে মোমবাতির শিখা। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর। আর সেই আলো-আঁধারি পরিবেশে মিলিত হচ্ছে দুই পুরুষের শরীর। তৈরি হচ্ছে এক কাব্যিক মূর্ছনা।

‘রক্তভূমি: প্রেম পরব কথা’র মহড়া।

‘রক্তভূমি: প্রেম পরব কথা’র মহড়া।

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০১৪ ২৩:৫৯
Share: Save:

বারো ফুট বাই দশ ফুট ঘর। লাল মেঝে। তবে তা অন্ধকারের চাদরে ঢাকা।

আলো বলতে ঘরে শুধু তখন তিনটে মোমবাতির শিখা। দূর থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর। আর সেই আলো-আঁধারি পরিবেশে মিলিত হচ্ছে দুই পুরুষের শরীর। তৈরি হচ্ছে এক কাব্যিক মূর্ছনা।

এ ভাবেই রোজ সন্ধেবেলা নানা দৃশ্যের মহড়া দিচ্ছেন রাজু বেরা, চন্দ্রমৌলি বাগচি, প্রীতম চক্রবর্তী, মেরি আচার্য, সৌম্যজিত্‌ অধিকারী, মুনমুন চট্টোপাধ্যায়, তাপস চট্টোপাধ্যায়রা। নাট্যদল অর্ঘ-র জন্মদিন ৫ সেপ্টেম্বর নামতে চলেছে মণীশ মিত্রর নতুন প্রযোজনা। নাম ‘রক্তভূমি : প্রেম পরব কথা’। মণীশের দলের আঠারো জন নাট্যকর্মী মেতে উঠবেন ভালবাসার উদযাপনে। স্লাইড প্রোজেকশন থেকে একদম গ্রাফিক শারীরিক মিলন সবই থাকবে এই প্রযোজনার অঙ্গ হিসেবে!

কেন এমন একটা প্রযোজনা? মণীশের নিশ্চয় অজানা নয় যে এই সমাজের একাংশ তো সাততাড়াতাড়ি এমন নাটককে অপসংস্কৃতি বলে বিতর্ক তৈরি করতেই পারে। কেউ বা কটাক্ষ করে বলতে পারেন যে এটা মণীশের চমক দেওয়ার নতুন উদ্যোগ। এর আগে ‘ওথেলো’ নাটকে শেক্সপিয়রের একটা ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে কম বিতর্ক তৈরি হয়নি মণীশের প্রযোজনা ঘিরে। নগ্ন ওথেলোকে মঞ্চে দেখে নানা ধরনের মন্তব্য ভেসে এসেছে। বিতর্কের ঝড় এত দূর গড়িয়েছিল যে সে নাটক কিছু দিন বন্ধ রাখতে বাধ্য হন পরিচালক। কারণ? পরিচালকের বক্তব্য, সমাজের কিছু সংখ্যক অসহিষ্ণু মানুষের কটাক্ষ থেকে তাঁর অভিনেতাদের রক্ষা করার জন্যই তাঁকে নিতে হয়েছিল এমন পদক্ষেপ।

মহড়ার আর এক মুহূর্ত।

এত সব কাণ্ডের পর কীসের টানে এই নাট্যদল যেতে চাইছে আর এক বিতর্কিত প্রযোজনা?

“মানুষের শরীর তার রক্তমাংস, শিরা, ধমনি, স্নায়ু, ভাব-আবেগ, সব নিয়ে রহস্যময় সুন্দর। শরীরের সঙ্গে শরীরের প্রেমের মিলনও ততটাই সুন্দর। মঞ্চে অভিনেতার শরীর যে কেবল অসামান্য দৃশ্যকাব্য রচনা করে তা আমরা শেক্সপিয়র প্রোডাকশনে এক নগ্ন শরীর দিয়ে এক নিদারুণ করুণার কাব্য স্থাপন করে প্রমাণ করেছি। ‘উরুভঙ্গম’য়ের প্রোডাকশান ডিজাইনটাও তাই। শেক্সপিয়র প্রোডাকশনে নগ্ন শরীর দিয়ে এক মহাকাব্যকে ধরা হয়েছে। তারই শরীরের ভাবগত ও বস্তুগত প্রয়োগে কাব্যের মঞ্চায়ন। এবার আমরা সেলিব্রেট করব ভালবাসা,” বলছেন পরিচালক।

কথা বলতে বলতেই আরও এক দৃশ্যের মহড়া শুরু হয়ে যায়....

দেওয়ালের এক কোণে ঠেস দিয়ে বসে আছেন মেরি। এক ঢাল অন্ধকারের মতো ঘন কালো চুল ঢেকে দেয় তাঁর মুখ। উল্টো দিক থেকে এগিয়ে আসেন প্রীতম। মেরির পা তুলে নেন তাঁর হাতে। ঠোঁট দিয়ে আলতো করে আদর করতে শুরু করেন তাঁর পায়ের নখ। মেরির পা বেয়ে ওঠে তাঁর ঠোঁট। সামনে ধুনুচিতে রাখা জ্বলন্ত কর্পূর শিখা। ঘরে পাখা বন্ধ। বিন্দু বিন্দু ঘামে চকচক করে ওঠে তাঁর চিবুক...

ভালবাসার অভিব্যক্তি তো অন্য ভাবেও ধরা যেতে পারত? মঞ্চে লাইভ লাভমেকিং না দেখিয়ে কি সেটা বোঝানো যেত না? উত্তরে মণীশ জানান, “এই নাটকে শরীর এবং প্রেম, হিংসা আর ধ্বংসের বিপ্রতীকের ছবি। মৃত্যু ও ধ্বংসের যে তীব্রতা প্রেমের সেলিব্রেশিনেও সেটা থাকা চাই। যখন আমি স্লাইডে হিরোশিমা দেখাচ্ছি তখন তার এগেনস্টে চকোলেট হিরোর প্রেম-প্রেম খেলা দেখানোটা আমার দর্শনের সঙ্গে মেলে না। যখন পুরুষের দৃষ্টি তার শরীর ভালবেসে নারীর শরীরে সর্পিল যাত্রা করে তখন সেই যাত্রা প্রকৃতই সুন্দর, কাব্যময়। আর সেই দৃশ্যের সঠিক সুন্দর প্রদর্শন মানুষের অনেক ভানভণিতা, অনেক লোভ, অনেক সুপ্ত কামনাকে ব্যঙ্গ করে। কাব্যিক ব্যঙ্গ বিপণন নয়। শরীর হয়ে ওঠে স্পন্দনময়, হয়ে ওঠে জীবন্ত কবিতা।”

“ঘন চুম্বনের দৃশ্যে চুম্বন তো প্রয়োজন হবেই। তখন চুলের আড়ালে বনলতা সেন আওড়ালে হবে না”

মণীশ মিত্র

এ নাটকটা দলের এক সমবেত প্রয়াসে লেখা হচ্ছে। তিনটি স্তরের মধ্যে দিয়ে হবে নাটকের উপস্থাপনা। নাটকে সে অর্থে কোনও গল্প থাকছে না। সবটাই ছেঁড়া ছেঁড়া প্রেমের দৃশ্য। কখনও কড়ে আঙুলটা স্পশর্র্ না-করে প্রেমের অভিব্যক্তি থাকছে। কখনও বা সঙ্গম দৃশ্য। প্রযোজনা শুরু হবে ‘বেরি মাই হার্ট অ্যাট উন্ডেড নি’ উপন্যাসের ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যায়নের মধ্যে দিয়ে। তারপর জেনোসাইডের ভয়ঙ্কর চিত্র অঙ্কিত হবে ‘ব্লাড অ্যান্ড সয়েল’ আর ‘ব্লাডল্যান্ড’ বই দু’টির আধারে। থাকবে স্লাইড প্রোজেকশন। আর খানিকটা স্টেজ অ্যাক্টিং। মাঝে মাঝে ভেসে আসবে ভয়ঙ্কর হিংসার চিত্র। “হিটলার কী ভাবে মানুষ খুন করেছেন, সেটা নিয়ে কথা হয়। তবে স্ট্যালিনও তো মানুষ হত্যা করেছেন। সে চিত্র আমরা এ নাটকে তুলে ধরব। ভয়ঙ্কর সব হিংসার ছবি, যুদ্ধের ছবি, হত্যার ছবি। আর তারই সমান্তরালে থাকবে প্রেমের ছবি। যেখানে দেখাব পার্টিশনের ফলে জমি থেকে উত্‌খাত হওয়া মানুষের সঙ্গে ভূমির প্রেম... দেখাব এক কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থাকা এক মহিলার বান রুটি লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া... অন্য কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে থাকা প্রেমিকের জন্য। আর এ সবের সঙ্গে থাকবে ‘লাইভ’ লাভমেকিংয়ের দৃশ্য!” বলছেন রাজু।

এর আগে বাংলার মঞ্চে শান্তনু বসুর পরিচালনায় ‘রোদ্দুরওয়ালা গলি’ বলে এক নাটকে শরীরী মিলনের আভাস দেখানো হয়েছিল। “কিন্তু ‘রক্তভূমি: প্রেম পরব কথা’তে যে ভাবে লাভমেকিংটা আসছে তার প্রেক্ষিতটা সম্পূর্ণ আলাদা। ধুপ করে এক চাদরের তলায় নারী-পুরুষ হুটোপাটি করবে না আমাদের এই প্রযোজনায়। শুধু ফোরপ্লে নয়, একদম প্রপার লাভমেকিং দেখাব স্টেজে। আমি বিশ্বাস করি না যে আলো দিয়ে ‘চিট’ করে এই লাভমেকিংটা দেখানো উচিত। তবে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে এই দৃশ্য করা হবে কি না সেটা এখনও ঠিক করিনি। সব সময় ভাবছি, প্রযোজনা যেন ভালগার না হয়ে যায়,” বলছেন পরিচালক।

‘ওথেলো’র সেই দৃশ্য।

এখনও চার মাসের বেশি বাকি প্রযোজনা নামাতে। প্রীতম আর মেরি-র দাবি, তত দিনে তাঁরা স্বচ্ছন্দ হয়ে যাবেন সেই দৃশ্যে অভিনয় করতে। “মানসিকভাবে আমরা তৈরি। ‘লেডি ম্যাকবেথ’ করার সময় আমার অনেক ক’টা চুম্বন দৃশ্য ছিল,” বলছেন মেরি। তবে লাভমেকিং দৃশ্যে অভিনয় করতে গেলে একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তাঁকে যেতে হবে। তার জন্য সময় আর রিহার্সালের প্রয়োজন। মেরি, প্রীতম, রাজুরা অবশ্য জানাচ্ছেন, “সেপ্টেম্বরে আশা করছি আমরা ওই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়ে সাবলীলভাবে অভিনয় করতে পারব।”

ঘন চুম্বন বা মঞ্চে নগ্ন হয়ে অভিনয় করা এক জিনিস, আর অন স্টেজ লাভমেকিং একদম আলাদা বিষয়। বিদেশের রঙ্গমঞ্চে শারীরিক মিলনের দৃশ্য দেখানোটা নতুন নয়। সেই ১৯৬৯ সালে ব্রিটিশ নাট্যসমালোচক কেনেথ টাইনান রচনা করেছিলেন ‘ওহ! ক্যালকাটা’ বলে যৌনতা নিয়ে একটা বিতর্কিত রেঁভ্যু (একাধিক অঙ্কের জনপ্রিয় থিয়েটার যাতে গান, নাচ ও স্কেচ থাকে)। সেই প্রযোজনা যতটা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল, ততটাই নিন্দার মুখেও পড়েছিল। নাটকটির ‘রিভাইভ্যাল শো’ যত বাড়তে থাকে, ততটাই সরব হন সমালোচকরা। কেউ প্রযোজনাকে বলেন ‘আ মোস্ট ইনোসেন্ট ডার্টি শো’, কেউবা বলেন যে, ওটা তৈরি হয়েছে ‘টু গিভ পর্নোগ্রাফি আ ডার্টি নেম’!

বাংলায় ‘ওথেলো’র সময় কম ঝামেলা হয়নি। আরও সাহসী হতে ভয় হচ্ছে না? “সারা বিশ্বের নাটক অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আজকে বাস্তব আর সত্যের মাঝের দেওয়ালটা ভেঙে গিয়েছে। আমার মনে হয়, শরীরী প্রেম যখন দেখানো হয়, তখন শরীরকেই ব্যবহার করতে হবে। তবে তার দৃশ্যায়নের মধ্যে কাব্য থাকবে। ঘন চুম্বনের দৃশ্যে চুম্বন তো প্রয়োজন হবেই। তখন কালোচুলের আড়ালে বনলতা সেন আওড়ালে হবে না। শরীরী প্রেম তো প্রেমের অংশ। সেটা বাদ দিয়ে প্রেমের সেলিব্রেশন পূর্ণ হয় না। তবে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার সোশাল এসথেটিক্স মাথায় রেখেই সেই সেলিব্রেশন করব,” বলছেন মণীশ।

বিদেশি মঞ্চে

• ক্যাচ ২২

• জিওমেট্রি অব ফায়ার

• ব্লাস্টেড

• স্প্রিং অ্যাওয়েকেনিং

নগ্ন ‘ওথেলো’য়ে অভিনয় করার সময় তো তাপসের কাছে ফোন এসেছিল তাঁর ‘রেট’ জানতে চেয়ে। সে সময় বিজ্ঞাপন দিয়ে মণীশ জানিয়েছিলেন, শো বন্ধ করছেন।

আর তা দেখে অনেকেরই মনে হয়েছিল যে, এই ঘোষণার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে ছিল প্রচারের খিদে। নগ্নতা নিয়ে প্রযোজনা করতে গেলে এরকম বাধা বা মন্তব্য আসাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। সেখানে অভিমান করে বিজ্ঞাপন দিয়ে শো বন্ধ করার পদক্ষেপ অনেকের কাছেই গিমিক মনে হয়েছিল। এর উত্তরে মণীশ বলছেন, “হয়তো আমরা ও ভাবে রই্যাক্ট নাও করতে পারতাম। তবে শো বন্ধ করিনি। থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। আর এই থমকে দাঁড়ানোর পরে পাল্টা একটা মত তৈরি হয়েছিল। সারা দেশে এই নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। প্রমাণ হয়েছিল ওই দৃশ্যায়নে কোনও রুচির ওপর আক্রমণ ঘটাচ্ছে না।”

এ বার যদি রাজু, মেরি, তাপস, প্রীতমেরা আরও কঠোর সমালোচনার মধ্যে পড়েন? তখন কী করবেন? অভিমান করে আবার বন্ধ করবেন প্রযোজনা? নাকি আত্মবিশ্বাসে অটল থেকে স্লেজিং সহ্য করে ব্যাটিং করে যাবেন? “আমি ‘ওথেলো’ করেছি। এই নাটকেও আছি।

আমার কোনও সমস্যা হবে না,” জোর দিয়ে বলছেন তাপস। আর তাঁর কথার রেশ ধরেই প্রীতম জানাচ্ছেন, “তাপসের কাজটা আমাকে সাহস জুগিয়েছে। আমার বাড়ির সব্বাই নাটকটা দেখতে এসেছিলেন। এক সময় মনে হয়েছিল কেন তাপসের ওই রোলে আমি অভিনয় করিনি! মেরি আমার বোনের মতো। ওর সঙ্গে এই দৃশ্যে অভিনয় করতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বাড়ির কোনও আপত্তি নেই। কেউ যদি কিছু বলে তাতে আমার কিছু এসে যাবে না।”

এখন প্রতীক্ষা চার মাসের এই টানা মহড়ার পরে প্রেম পর্ব কোন মাত্রায় পৌঁছায় তা দেখার।

ছবি: কৌশিক সরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE