Advertisement
০১ মে ২০২৪
Bagha Jatin Movie Review

বাঘা যতীন: ‘অজানা’ ইতিহাস এবং এক অভিনেতার জন্ম

এই ছবিতে ‘বাঘ’ মেরেছেন দেবও। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর অভিনয় নিয়ে চলা বাঘা বাঘা সমালোচনার মুখে থাপ্পড় কষিয়েছেন।

Review of Dev’s film Bagha Jatin directed by Arun Roy

বাঘা যতীনের চরিত্রে দেব। ছবি: সংগৃহীত।

রুদ্রদেব ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:০২
Share: Save:

বাঙালি বিপ্লবীর চরিত্রে দেব! সেই ছবি কেমন হবে, কেমন অভিনয় করবেন তারকা সাংসদ, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলছিল ছবির প্রথম ঝলক মুক্তির পর থেকেই। সেই সবে ইতি টানলেন দেব। প্লেটে সাজিয়ে দিলেন ছবি নিয়ে আলোচনার জায়গা। দক্ষ অভিনয়ে সমালোচনাকে পাঠিয়ে দিলেন এক্কেবারে গণ্ডির বাইরে।

বাঙালি বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে টানটান ছবি বানিয়েছেন পরিচালক অরুণ রায়। নামভূমিকায় অভিনয় করেছেন দেব। কথিত রয়েছে, বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ এক বার খালি হাতে বাঘ মেরেছিলেন, তাই তাঁর নাম হয়ে যায় বাঘা যতীন। সেই নামেই তিনি বেশি পরিচিত। সেই বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীন্দ্রনাথের সশস্ত্র বিপ্লব, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং আত্মত্যাগের ঘটনা নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘বাঘা যতীন’।

Review of Dev’s film Bagha Jatin

এই ছবিতে ‘বাঘ’ মেরেছেন দেবও। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু দর্শক ‘বাঘা যতীন’ কেন দেখবেন? ইতিহাস জানতে এবং বুঝতে। দেবের অভিনয় দেখতেও। ছবির গল্প যতই এগোচ্ছিল মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ক্ষুদিরামকে নিয়ে বাঙালির মধ্যে এত মাতামাতি থাকলেও বাঘা যতীনকে নিয়ে তেমনটা দেখা যায় না কেন? মনে হচ্ছিল, ছোটবেলায় বাঘা যতীনের কথা ইতিহাসে পড়েছিলাম তো! কই এমনটা তো পড়িনি। না কি পড়়েছিলাম, কিন্তু মনে নেই? এত্ত সাহসী, এত্ত বীর এক জন বঙ্গসন্তান! ব্রিটিশদের হয়ে চাকরি করার সময়ও গোরা পিটিয়েছিলেন তিনি। আবার সেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর আরও ধারালো হয়ে ব্রিটিশদের নাস্তানাবুদ করতে একের পর এক ছক কষে গিয়েছেন। বাংলায় বসেই ব্রিটিশ বিরোধী অন্য বিদেশি শক্তিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফেলেছিলেন। স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতা, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থান, সশস্ত্র বিপ্লবের।

এর আগেও স্বাধীনতা সংগ্রামী বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত এবং দীনেশ গুপ্তকে নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন অরুণ। কিন্তু ‘বাঘা যতীন’ সেই ছবির থেকে আলাদা। ‘বাঘা যতীন’ ছবি তৈরি করতে গিয়ে ইতিহাস খুঁড়ে বার করেছেন পরিচালক অরুণ। সেই ইতিহাসে রয়েছে বাঙালি বিপ্লবীদের ব্যক্তিগত জীবন, ঈর্ষা, মতবিরোধ, বিশ্বাসঘাতকতার গল্প। সেই সময় ব্রিটিশ বিরোধী গুপ্ত সংগঠনগুলিও যে একে অপরের সঙ্গে অনেক বিষয়েই মতপোষণ করতেন না এবং এড়িয়ে চলতেন, তা-ও ফুটে উঠেছে ছবির বিভিন্ন সংলাপের মাধ্যমে। ‘বাঘা যতীন’ দেখে ভারতীয়দের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে নতুন করে আগ্রহ জন্মাল। মনে হল, এই দেশে কতই না সংগ্রামী প্রচারের আলোকবৃত্তের বাইরেই রয়ে গিয়েছেন। তাঁদের কথাও তুলে ধরেছেন দেব এবং অরুণ।

Review of Dev’s film Bagha Jatin

দক্ষ অভিনয়ে সমালোচনাকে দেব পাঠিয়ে দিলেন এক্কেবারে গণ্ডির বাইরে। ছবি: সংগৃহীত।

এই ছবিতে ‘বাঘ’ মেরেছেন দেবও। দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর অভিনয় নিয়ে চলা বাঘা বাঘা সমালোচনার মুখে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছেন। ‘পাগলু’, ‘চ্যালেঞ্জ’-এর মতো ছবির ছায়া অনেক দিন আগেই মাড়িয়ে এসেছেন অভিনেতা। অভিনয়ের জন্য ‘টনিক’, ‘প্রজাপতি’র মতো ছবিকে বেছে নিয়েছেন। বেছে নিয়েছেন অনেক বেশি সাহসী চরিত্র। অভিনেতা হিসাবে যে দেবের মানোন্নয়ন হয়েছে তা বোঝা গিয়েছিল তাঁর আগের কয়েকটি ছবি দেখেই। ‘ব্যোমকেশ এবং দুর্গরহস্য’ ছবিতে তা আরও প্রকট হয়েছিল। ‘বাঘা যতীন’ আরও এক কাঠি সরেশ অভিনয় করেছেন দেব। এখন তিনি আর শুধু তারকা নন, তিনি অভিনেতা। বাঘা যতীনের মতো তিনিও বীর, তিনিও সাহসী। একের পর এক সাহসী চরিত্র বেছে নিয়েছেন তিনি। তাঁর অভিনয় দেখে মনে হল কেশপুরের ছোট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করা ছেলেটা এত দিনে আকাশ ছুঁয়েছেন। তারকা দেব থেকে অভিনেতা দেবের জন্ম হয়েছে।

তবে শুধু দেব নন, ‘বাঘা যতীন’ ছবিতে নজর কেড়েছেন প্রত্যেক অভিনেতা-অভিনেত্রী। ছবিতে বাঘা যতীনের দিদি বিনোদবালার চরিত্রে অভিনয় করেছেন সুদীপ্তা চক্রবর্তী। তিনি যে ভাল অভিনেত্রী, তা আলাদা করে বলার দরকার পড়ে না। বাঘা যতীনের স্ত্রী ইন্দুবালার চরিত্রে নবাগতা সৃজা দত্তের অভিনয়ও বেশ ভাল। ছবিতে খুব স্বল্প সময়ের জন্য ক্ষুদিরামের চরিত্রে অভিনয় করেছেন কিশোর অভিনেতা সমিউল আলম। কাঁচা বয়সেই যে তিনি পাকা অভিনেতা, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়াও বারিন ঘোষের চরিত্রে সন্দীপ ঘোষ, ব্রিটিশ পুলিশকর্তা চার্লস টেগার্টের চরিত্রে কার্ল অ্যান্ড্রু আর্তে, চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরীর চরিত্রে রোহন ভট্টাচার্যের অভিনয় প্রশংসনীয়।

Review of Dev’s film Bagha Jatin

শুধু দেব নন, ‘বাঘা যতীন’ ছবিতে নজর কেড়েছেন প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রী। ছবি: সংগৃহীত।

ছবির আবহসঙ্গীত তারিফ করার মতো। ছবির টানটান উত্তেজনা ধরে রাখার পিছনে ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোরের বড় অবদান রয়েছে। অরিজিৎ সিংহের কণ্ঠে ‘আবার আসব ফিরে’ গানটি মনে রাখার মতো। তবে ছবির সূত্রধরের ভূমিকায় মীরের কণ্ঠ আলাদা আমেজ তৈরি করেছে ছবিতে। ছবির কস্টিউম থেকে প্রোডাকশন ডিজ়াইন— সবই উচ্চ মানের। সব মিলিয়ে পরিচালক খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঔপনিবেশিক ভারতের সামগ্রিক ছবি।

তবে ছবির সব ভাল, তা বলা যাবে না। বাঘা যতীনের বাঘ মারার দৃশ্যে ভিএফএক্স-এর কাজ খরচসাপেক্ষ হলেও খানিক দুর্বল। ব্রিটিশ পুলিশের সঙ্গে বাঘা যতীনের মারধরের দৃশ্যও একটু অতিরঞ্জিত। সেই দৃশ্য পুরনো দেবের স্মৃতি উস্কে দেয়। তবে ছোটখাটো ভুলত্রুটি মাফ করাই যায়। কারণ, সপরিবার দেশের ‘অজানা’ ইতিহাস জানতে মন্দ লাগবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE