Advertisement
০১ মে ২০২৪
Laapataa Ladies Review

উচ্চকিত বার্তা নয়, সারল্যই মন জিতে নেয়

এ ছবি উত্তরণেরও। সামাজিক-মানসিক বাধা কাটিয়ে কেউ স্বপ্নপূরণের পথে এগোয়, কেউ নিজের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেয়, কেউ প্রথম রোজগারের স্বাদ পায়।

Laapataa Ladies

‘লাপতা লেডিজ়’ ছবির একটি দৃশ্য। ছবি: সংগৃহীত।

দীপান্বিতা মুখোপাধ্যায় ঘোষ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০২৪ ০৬:২৮
Share: Save:

সাম্প্রতিক হিন্দি ছবিতে থ্রিলার, অ্যাকশন, প্রতিশোধ ড্রামার গুঁতোগুঁতি। সেই ভিড়ে কিরণ রাওয়ের ‘লাপতা লেডিজ়’ যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, বাসু চট্টোপাধ্যায়ের ছবির মধ্যে যে সরলতা থাকত, বহু দিন পর সেই সারল্যের সঙ্গে পরিচয় করালেন কিরণ। জোর করে গিলিয়ে দেওয়া বার্তা নেই, অনাবশ্যক ড্রামা নেই... আছে মন ভাল করে দেওয়া একটা নিটোল গল্প। ‘লাপতা লেডিজ়’-এর মূল কাহিনি কলকাতার ছেলে বিপ্লব গোস্বামীর লেখা। সিনেমার উপযুক্ত করে বিপ্লবের সঙ্গে এ কাহিনি গড়েপিটে নিয়েছেন দিব্যানিধি শর্মা ও স্নেহা দেশাই। তার সঙ্গে মিশেছে কিরণ রাওয়ের তুলির সূক্ষ্ম আঁচড়।

ছবির স্থান, কাল, পাত্র কাল্পনিক হলেও, চরিত্রের মধ্যকার আবেগ অচেনা নয়। ২০০১ সালের নির্মল প্রদেশ নামের এক এলাকার গল্প ‘লাপতা লেডিজ়’, যেখানে নব্য বিবাহিতা তার স্বামীর নাম মুখে আনতে পারে না। শ্বশুরবাড়ি কোথায় সেটাও ঠিক মতো মনে রাখার তাগিদ নেই। বিয়ে হয়ে গিয়েছে মানে সে এখন বরের সম্পত্তি। নিজের আলাদা কোনও অস্তিত্ব থাকতে পারে সেই বোধটাই নেই। দীপকের (স্পর্শ শ্রীবাস্তব) বিয়ে হয় ফুলের (নিতাংশী গোয়েল) সঙ্গে। ফুলের গ্রাম এতটাই প্রত্যন্ত যে, কোনও রেল স্টেশনও নেই। মাঝপথে ট্রেন দাঁড় করিয়ে তাতে উঠে পড়াটাই দস্তুর। স্ত্রীকে নিয়ে দীপক রওনা দেয় তাদের সূর্যমুখী গাঁয়ের উদ্দেশে। ট্রেনের কামরায় আরও কয়েক জোড়া নবদম্পতি। সকলের পরনে একই রকমের সুট আর শাড়ি। ট্রেন মধ্যরাতে স্টেশনে পৌঁছলে ঘুমচোখে একগলা ঘোমটা দেওয়া বৌকে ডেকে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় দীপক। বাড়ি পৌঁছে ঘোমটা খুলতেই দেখা যায় বৌ বদলে গিয়েছে। ফুলের বদলে কোনও এক পুষ্পা রানিকে (প্রতিভা রন্তা) সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে দীপক। এ বার কী হয়? রেল স্টেশনে বরকে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে ফুল। দীপকও স্ত্রীর বিরহে কাতর। পুষ্পার হেলদোল বরং কম। বাড়ি ফেরার কোনও তাগিদ নেই তার। সেটাই বা কেন? এটুকু রহস্য বরং থাক।

কিরণ প্রধান চরিত্রে আনকোরা মুখ নিয়েছেন। সেটাই ছবির অন্যতম জোরের জায়গা। স্পর্শ, প্রতিভা, নিতাংশী তাঁদের সারল্যের জোরে ভীষণ ভাবে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছেন। ছবির সেরা পারফরম্যান্স রবি কিষণের। ধূর্ত, ঘুষখোর পুলিশের চরিত্রে তিনি দুর্দান্ত। মুচমুচে সব সংলাপ তাঁর মুখেই রয়েছে। হিন্দি ছবির দুর্বলতা হল, কিছু চরিত্র আচমকাই ভোল বদলে ফেলে। রবি কিষণের চরিত্রেও মোচড় আছে তবে অতিরঞ্জন নেই।

ছবির বাহুল্যবর্জিত ছোট ছোট দৃশ্যগুলোয় ভারত-দর্শন হয়ে যায়। ট্রেনের কামরায় প্রতিযোগিতা চলে কে কত পণ আদায় করতে পেরেছে তার ফিরিস্তি দেওয়ার। যে ছেলে বড় দাঁও মারতে পারেনি, তার নিশ্চয়ই খুঁত আছে। ‘লাপতা লেডিজ়’ সোশ্যাল স্যাটায়ার, যেখানে রাজনীতি আছে আবার নারীবাদও আছে। সঙ্গে আছে মিষ্টি প্রেমের গল্প। বলিউডের নারী স্বাধীনতা কিংবা সামাজিক বার্তাবাহী ছবিগুলো যতটা উচ্চকিত হয়, কিরণের ছবি ততটাই মোলায়েম। ‘‘যত বার নতুন সরকার আসে, তত বার আমাদের গ্রামের নাম বদলে যায়,’’ সংলাপের অন্তর্নিহিত খোঁচা স্পষ্ট। মনে থেকে যাওয়ার মতো আরও একটা চরিত্র রেল স্টেশনের চায়ের দোকানি মঞ্জু মাই (ছায়া কদম), যে সহজ করে বুঝিয়ে দেয় পুরুষজাতির ‘ভাঁওতাবাজি’তে কেমন করে মেয়েমানুষেরা ঠকে। দীপকের মা যেমন ভাবতেই পারে না, মেয়েমানুষের নিজের পছন্দের রান্না করাটা কোনও গর্হিত কাজ নয়!

এ ছবি উত্তরণেরও। সামাজিক-মানসিক বাধা কাটিয়ে কেউ স্বপ্নপূরণের পথে এগোয়, কেউ নিজের প্রতিভাকে স্বীকৃতি দেয়, কেউ প্রথম রোজগারের স্বাদ পায়। কেউ বা লজ্জার আগল ভেঙে স্বামীর নাম ধরে ডাকতে পারে... কাহিনির মেজাজের সঙ্গে দৃশ্যায়ন, আবহ সব কিছুই সুন্দর ভাবে সঙ্গত করেছে। ঢাক পিটিয়ে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার যুগে সূক্ষ্ম রসবোধ যেন হারিয়ে গিয়েছে। সংলাপের আস্ফালন না করেও যে কঠিন সত্যি বলে দেওয়া যায়, তা কিরণ রাওয়ের ‘লাপতা লেডিজ়’ দেখিয়ে দিয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Movie Review Film Review Review
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE