Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
S. P. Balasubrahmanyam

দিল সে না যাতি হ্যায় ইয়াদে তুমহারি

আশি-নব্বইয়ের সন্ধিক্ষণটাও এস পি-র কণ্ঠলাবণ্যে অনন্তযৌবনা। তিনি স্বর ছোঁয়ালে গান যেন জীবন পেয়ে জেগে উঠেছে।

চিরশ্রী মজুমদার
শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০১:৩১
Share: Save:

একটা সময়ে সলমন খান আর এস পি বালসুব্রহ্মণ্যম যেন সমার্থক ছিলেন। বলা হত, সলমনের রোম্যান্টিক ইমেেজর সব ম্যাজিক শিল্পীর কণ্ঠজাদুর জোরে। তবে এস পি-র দ্যুতি সলমন-কণ্ঠের পরিধি ছাড়িয়ে বহুদূর বিস্তৃত। তার প্রমাণ, শিল্পীর ১৬টি ভাষায় গাওয়া চল্লিশ হাজারের বেশি গান।

নেল্লোরের শিল্পী পরিবারে জন্মালেও এস পি-র সঙ্গীতের প্রথাগত তালিম ছিল না। কিশোরকুমার স্টাইলের ঈশ্বরদত্ত খোলা গলার জমজমাট গায়কি তাঁর। গানকে জীবন, মহম্মদ রফিকে ভগবান মানতেন। সত্তরের দশকে যখন কিশোর এবং আর ডি বর্মণ হিন্দি ফিল্মসঙ্গীত শাসন করছেন, তখন দক্ষিণ ভারত তাদের আদরের ‘বালু’-তে বুঁদ। কমল হাসন, রজনীকান্ত, চিরঞ্জীবীরা সেখানে নবীন নায়ক। তাঁদের ইমেজের সঙ্গে বালুর হাই পিচের স্বতঃস্ফূর্ত গায়কি অদ্ভুত মানাত! সঙ্গে ইলাইয়ারাজার নৈসর্গিক সুর। সে সব গান শুনলে দক্ষিণের জলপ্রপাত, সবুজ পশ্চিমঘাট, কফিখেত যেন চোখে ভেসে ওঠে।

কে বালচন্দর যখন তাঁর সুপারহিট তেলুগু ছবিটি হিন্দি রিমেকের প্রস্তাব পেলেন, শর্ত দিলেন নায়কের গলায় কিন্তু আসল সিনেমার মতো বালুরই ব্যারিটোন চাই। লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল নিমরাজি হলেন। কিন্তু রেকর্ডিং রুমে তাঁরা তাজ্জব। কমল আর এসপি যেন একে অপরে মিশে গিয়ে তৈরি করেছিলেন ১৯৮১-র ‘এক দুজে কে লিয়ে’-র বাসু-কে। ‘আই ডোন্ট নো হোয়াট ইউ সে’-র দুষ্টুমি, কথোপকথনের ভঙ্গিতে গানে (‘মেরে জীবনসাথী’) যে গলার খেল বালু দেখালেন, তাতে কমল হাসনের ডায়ালগ ডাব করতেও তাঁরই ডাক পড়তে লাগল। কিশোরকুমার তখন অসুস্থ, মেজাজি। এই সময়ে বালুর গানের ‘বডি ল্যাঙ্গোয়েজ’-এ অভিভূত নৌশাদ, আনন্দ-মিলিন্দও প্রচুর ব্যবহার করলেন তাঁকে। মাল্টি-হিরো সিনেমায় কিশোরকে সঙ্গত দেওয়ার ভয়েস পেয়ে গেল বলিউড। আর ডি বর্মণ বাংলায় আনলেন এসপি-কে। ‘না, না, কাছে এসো না’।

আশির শেষে শূন্যতা থমথম করছিল বলিউডে। অমিতাভ রাজনীতিতে ব্যস্ত, কিশোর প্রয়াত। রোম্যান্সের টাইফুন এসে সেই শূন্যতা কোথায় ভাসিয়ে দিল। নতুন প্রজন্মের নবীন নায়কদের জন্য ইমেজ-মাফিক কণ্ঠস্বর প্রয়োজন হল। চকলেটি আমিরের জন্য উদিতের মিষ্টি স্বর, স্মার্ট শাহরুখের জন্য ছটফটে অভিজিৎ আর মাচো সলমনের জন্য বালসুব্রহ্মণ্যমের দরাজকণ্ঠ। সলমনের জন্য গলার বয়স কুড়ি বছর কমিয়ে দিলেন শিল্পী। প্যাশন আর অভিনয় ঢাললেন গানে। ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’-র প্রতিটা গান চরিত্রে আলাদা। ‘মেরে রং মে’-র শিহরন, লতা-র সঙ্গে ‘দিল দিওয়ানা’-য় আকাশছোঁয়া পারফরম্যান্স, বা ‘আ জা শাম হোনে’র মধ্যে ‘ধ্যাত্তেরিকি’-র চমকদার ইমপ্রোভাইজ়েশন।

আশি-নব্বইয়ের সন্ধিক্ষণটাও এস পি-র কণ্ঠলাবণ্যে অনন্তযৌবনা। তিনি স্বর ছোঁয়ালে গান যেন জীবন পেয়ে জেগে উঠেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন হয়ে ছুঁয়ে যেত ‘তুমসে মিলনে কী তমন্না’, ‘রূপ সুহানা লগতা হ্যায়’, ‘সুন বেলিয়া’। ‘হম আপকে...’ তো ইতিহাস। সলমনের সিনেমাগুলিকে তাঁর জাদুকণ্ঠ বক্স অফিসে বাড়তি সুবিধে দিয়েছে।

এস পি-চিত্রা দক্ষিণে কোন অপার্থিব মায়া তৈরি করেন, তার আঁচ মিলেছিল ‘রোজা’-য়। ‘রোজা জানেমন’-এ হৃদয়ের রক্ত গড়িয়েছে, পঞ্চেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে গিয়েছে ‘ইয়ে হসিঁ বাদিয়াঁ’-য়। এ আর রহমান না কি জনান্তিকে বলতেন, তাঁকে আর বালু-চিত্রার জুটি নিয়ে বলিউডে ঘোর আপত্তি। বালুর মতো করে গানে দরদ ঢেলে দেন বলে হরিহরণের পথও মসৃণ নয়।

নাদিম-শ্রাবণের জেদে ‘এক নায়কের এক গায়ক’ প্রথার অবসান হয়। সলমনেরও আর তাঁর কণ্ঠ প্রয়োজন হয়নি। এস পি-র খেদ ছিল না। তিনি একবারও বলেননি ‘সাথিয়া তুনে কেয়া কিয়া’। তিনি তখন আন্তর্জাতিক কিংবদন্তি। বলিউড তাঁর কাছে শেষ কথা ছিল না।

তামিলনাড়ুতে তাঁর নাম ‘পাড়ুম নীলা’ বা চাঁদের গান। সত্যিই মেঘের ও পার থেকে গান শোনাতেন। কোভিডের সঙ্গে মাসাধিক যুদ্ধ শেষে ২৫ সেপ্টেম্বর সেই মেঘের দেশেই ফিরে গেলেন। তবে শ্রোতার অনুভবে ‘আতে-যাতে হাসতে-গাতে’ চির দিন থাকবেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE