Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
আনন্দপ্লাস ব্লগ

সময় পেলে অজয়ের কাছে ঠুংরি শিখতাম

অজয় চক্রবর্তীর মান্নাদার গান যে ভাবে পরিবেশন করতেন সেটা তাঁর পছন্দ ছিল না যদিও অজয় চক্রবর্তীর প্রতি মান্না দে-র অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী গানটা মান্নাদার খুবই পছন্দ হল। যেমন লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, তেমনই সুর করেছেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক করলেন সেবারের পুজোতে গানটা গাইবেন। কিন্তু বাদ সাধলেন সহধর্মিণী সুলোচনা দেবী। মান্নাদাকে কিছুতেই সে-গান তিনি গাইতে দেবেন না।

শেষ আপডেট: ১৭ মার্চ ২০১৬ ০০:৪৮
Share: Save:

গানটা মান্নাদার খুবই পছন্দ হল। যেমন লিখেছেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, তেমনই সুর করেছেন মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠিক করলেন সেবারের পুজোতে গানটা গাইবেন। কিন্তু বাদ সাধলেন সহধর্মিণী সুলোচনা দেবী। মান্নাদাকে কিছুতেই সে-গান তিনি গাইতে দেবেন না। গানের কথা এ রকম—‘তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে/ আমার মরণ-যাত্রা যেদিন যাবে/ তুমি, বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থেকো/ শেষ দেখাটা দেখতে পাবে।’ স্বামী তার প্রাণের থেকেও প্রিয়। এ-গানে নিজের মৃত্যুর কথা সরাসরি লেখা। মান্নাদাকে বললেন, ‘তুমি এ গান গেও না।’ মান্নাদা আর কী করেন! বৌদির কথা তো আর ফেলতে পারেন না। মান্নাদার কাছে ‘আমার একদিকে শুধু তুমি, পৃথিবী অন্য দিকে।’ বৌদির আশঙ্কাকে সম্মান জানিয়ে মান্নাদা গাইলেন না সে-গানটা। নিয়তির কী পরিহাস দেখুন। তখন পরিচালক মনোজ ঘোষ তৈরি করছেন ‘তুমি কত সুন্দর’ ছবিটি। গান বাঁধছেন পুলক-মৃণাল। মনোজবাবু তো গানটা শুনেই লুফে নিলেন। বললেন, ‘যেমন কথা তেমন সুর, এই গানটা আমি ছবিতে লাগাব। মান্নাদা যখন গাইবেন না, কিশোরকুমারকে দিয়ে গাওয়াব’। এখানে মৃণালদার কাছে শোনা একটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। মনোজদা আর মৃণালদা বোম্বে গেছেন কিশোরকুমারকে দিয়ে গানটা গাওয়াতে। পুলকবাবু কলকাতায়। গান শুনে কিশোরকুমারের খুব পছন্দ হল। কিন্তু গানের ভিতর ‘বারান্দা’ শব্দটায় তার খুব আপত্তি। বললেন, ‘বারান্দা দিয়ে আবার গান হয় নাকি! পুলককে বলো কথাটা পাল্টে দিতে, নইলে আমি গাইব না।’ বড় বিপদ। পুলকদাকে কিছুতেই ধরা যাচ্ছে না। তখন তো মোবাইলের চল হয়নি। সবাই প্রমাদ গুনল। তীরে এসে বোধহয় তরী ডুবল। কিশোরকুমার বলেছিলেন ‘বারান্দা’ পাল্টে ‘অলিন্দ’ করে দাও। কিন্তু পুলকদাকে জিগ্যেস না করে পরিবর্তনটা করতে কেউ সাহস পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে রেকর্ডিঙের দিন এসে গেল। কিশোরকুমার গাইতে শুরু করলেন, মৃণালদা আর মনোজদা তো চোখ বুজে ঈশ্বরের নাম জপ করছেন। এবারই তো আসবে ‘বারান্দা’ কথাটা। কিশোরদা সেই অসাধারণ আবেগ দিয়ে গেয়ে গেলেন ‘বারান্দাতে দাঁড়িয়ে থেকো....। কাউকে কিছু বললেন না। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু সেই মর্মান্তিক ঘটনাটাই ঘটল। গানের মধ্যে একটা কু-ডাক আছে বলে সুলোচনা দেবী মান্নাদাকে এই গান গাইতে দেননি। যদি গানের কথা সত্যি হয়! কিশোরকুমার গানটা গাইলেন। দিব্যি সুস্থ মানুষ। হঠাৎ গানের পৃথিবীকে হতবাক করে দিয়ে অল্পকাল পরেই তিনি চলে গেলেন। আমরা ঝাপসা চোখে শুধু ‘শেষ দেখা’টা দেখলাম।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি গানের কথা মনে পড়ছে। ১৯৯৮। ‘মা আমার মা’ অ্যালবামের অনেক কথা আগে লিখেছি। একটু অন্য কথা বলি। পুলকবাবু একটা গান লিখেছিলেন—‘যখন মনে হয় জীবনটা ব্যর্থ আবর্জনা..., পরের কথা ছিল ‘গঙ্গায় ঝাঁপ দি, রেলের লাইনে মাথা রাখি’। গানের কথা পড়ে মান্নাদা যৎপরোনাস্তি বিরক্ত। ‘এ সব কী ধরনের কথা? আবর্জনা...গঙ্গায় ঝাঁপ দি...রেলের লাইনে মাথা রাখি’। যাই হোক, অনেক অনুরোধ উপরোধে মান্নাদা সে গান তো গাইলেন, জনপ্রিয়তায় অ্যালবামটি সমস্ত রেকর্ড ভেঙে দিল। কিন্তু এখানেও গানের কথা সত্যি হল। কিছু দিন পরে সত্যি সত্যি গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে পুলকবাবু হারিয়ে গেলেন চিরকালের জন্য। পরে মান্নাদা খুব আফশোস করতেন, ‘একবারও যদি বুঝতে পারতাম পুলক নিজের কথা ভেবে গানটা লিখেছিল, আমি ওকে বোঝাতাম। সে সুযোগ আর পেলাম না।’

মান্নাদা যখন যে-গান গাইতেন, সে গানকেই ভাবতেন প্রথম গান। সেই একই একাগ্রতা, একই রকম ইনভলভমেন্ট। দীনেন গুপ্তের ছবি, সুরকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। মান্নাদা গানটা শুনলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ছবিতে কে গানটায় লিপ দেবে? মনোজ মিত্রের কথা শুনে বললেন, ‘ওনার সঙ্গে একটু আলাপ করা যাক’। অতএব মনোজবাবু স্টুডিয়োতে এলেন। মান্নাদা তখন গান ছেড়ে মনোজবাবুর সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করতে শুরু করলেন। সেই গল্প চলল বেশ কিছু সময়। মান্নাদারও কাজের কাজটা হয়ে গেল। মনোজবাবুর হাবভাব, কথা বলার ভঙ্গি, ম্যানারিজম, সব রপ্ত করে নিলেন। মান্নাদা গানটা গাইলেন। ছবিতে মনোজ মিত্র লিপ দিলেন। তাকে বেশি কিছু করতে হল না। করার প্রয়োজনই বা কী? যা করার তা মান্নদাই তো করে দিয়েছেন।

গানটাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে— মান্নাদার লক্ষ্য ছিল এটাই। ৯১ বছর বয়স পর্যন্ত নতুন গানের রেকর্ড করেছেন। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গলার রেঞ্জ কমে আসবে, এটাই স্বাভাবিক। মান্নাদা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতেন সেই রেঞ্জ এবং লয়ে গানটা গাইতে, যা গানটা চাইছে। ১৯৮৩ সালে মান্নাদা গেয়েছিলেন ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই’। তখন মান্নাদার বয়স ৬৪। ‘কফি হাউসে’র দ্বিতীয় পর্ব মান্নাদা রেকর্ড করেন ২০০২ সালে ৮৩ বছর বয়সে। বয়সের কথা চিন্তা করে গানটা একটু ধীর লয়ে বাঁধা হল। কিন্তু গায়কের নাম তো মান্না দে। এই লয়ে গানটা তো খুলছে না। হাতের ইশারা করছেন লয় বাড়াবার জন্য। তারপর এমন জায়গায় লয়টা স্থির করলেন যে দেখা গেল, আগের কফি হাউস আর এই দ্বিতীয় পর্ব একই মাত্রায় দাঁড়িয়ে আছে। গানটাও প্রাণ পেল, মান্নাদা এবং বাকি সবাই তৃপ্ত হলেন।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, মান্নাদার জন্য তাবড় তাবড় গুণী মানুষেরও শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। মান্নাদার ওপর লেখা একটা বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। মান্নাদার একান্ত ইচ্ছা বইটির উদ্বোধন হোক পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর হাত দিয়ে। অজয়বাবু তো এক কথায় রাজি। পরস্পরের উপর পরস্পরের শ্রদ্ধা ছিল অসীম। একবার এক ঘরোয়া আড্ডায় মান্নাবাবু যখন অজয় চক্রবর্তীর খুব প্রশংসা করছেন, তখন একজন বলল, ‘মান্নাদা, এমন ক্ল্যাসিকাল তো আপনিও গাইতে পারেন।’ সে কথা শুনে মান্নাদা বললেন, ‘এটা আপনাদের ভুল ধারণা। আমি হয়তো টেনেটুনে এক ঘণ্টা ইমন বা ভৈরবী (মান্নাদার প্রিয় দুটি রাগ) গাইতে পারব, কিন্তু অজয়বাবুকে বলুন, সারা দিন ধরে উনি গেয়ে দেবেন।’ এখানে খুবই কিন্তু কিন্তু করে একটা কথা বলি। অজয়বাবুর প্রতি মান্নাদার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল ঠিকই, কিন্তু তিনি মান্নাদার গান যেভাবে পরিবেশন করতেন, সেটা মান্নাদার একদমই পছন্দ ছিল না। মান্নাদা ঠুমরি চালে শুরু করেছিলেন, ‘ও ললিতা ওকে আজ চলে যেতে বল না’। সেই গানটা অজয়বাবু তান-বিস্তার-সরগম করে অনুষ্ঠানে যেমন করে গাইতেন, সেটা মান্নাদার একেবারেই না-পসন্দ ছিল। মান্নাদা বলতেন, ‘এটা তো একটা মিষ্টি রোম্যান্টিক গান। এখানে রাগ ও তালকে ব্যবহার করেছি গানের মানেটাকে ঠিকমতো প্রকাশ করার জন্য। ও ভাবে গাইলে তো গানটার কোনও অর্থই থাকে না। যদি প্রয়োজন হত গানটাতে ওই সব কাজ কি আমি করতে পারতাম না?’ মান্নাদা যত গান রেকর্ড করেছিলেন, তার সব গানই ছিল ইম্প্রোভাইজেশনের শেষ কথা। সঙ্গীত শাস্ত্রে বা শুধু শ্রবণে তার বেশি আর কিছু হয় না। লক্ষ করবেন, মান্নাদা অনুষ্ঠানে একই রকম ভাবে রেকর্ডের গানগুলো গাইলেও দর্শকরা সমান ভাবে চার্জড হতেন। অন্য কোনও শিল্পী একটু এদিক ওদিক করে মান্নাদার গান গাওয়ার চেষ্টা করলে শ্রোতারা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

মান্নাদার বই প্রকাশের এক অনুষ্ঠানের কথা বলছিলাম। যে দিন এই অনুষ্ঠান, ঠিক সেই দিনেই রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠানের জন্য আমন্ত্রণ পেলেন অজয় চক্রবর্তী এবং আমজাদ আলি। অত্যন্ত সম্মানজনক এক অনুষ্ঠান। কিন্তু অজয়বাবুর কাছে অগ্রাধিকার পেল মান্নাদার বই প্রকাশের অনুষ্ঠান। তিনি সবিনয় প্রত্যাখ্যান করলেন রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণ। কথাটা মান্নাদার কানে গেল। অত্যন্ত বিব্রত হয়ে মান্নাদা বললেন, ‘এটা কী করলেন অজয়বাবু? এই সামান্য একটা অনুষ্ঠানের জন্য আপনি অত বড় একটা অনুষ্ঠান মিস করলেন? অজয়বাবু পরম তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, ‘রাষ্ট্রপতি তো মাত্র ৫ বছরের জন্য, আর আপনি আমার সারা জীবনের’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

manna de blog song kishor kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE