বিনা আলাপেই শ্রীদেবী যে কখন আমার কাছে শ্রীদেবীজি হয়ে উঠলেন বুঝতেই পারিনি।
তখনও শ্রীদেবী আমার কাছে শ্রীদেবীই। ম্যাডাম হয়ে ওঠেননি। ওঁর ছবি দেখলে বা ওঁকে সামনাসামনি দেখলে আর পাঁচটা পুরুষের মতো আমার বুকটাও ধকধক করে উঠত। ১৯৮৫ সাল। 'নাগিনা'র সেটে শ্রীদেবীকে প্রথম বার দেখলাম। ওই বড় টেবিল ফ্যানের হাওয়াতে যখন ওঁর চুলগুলো উড়ত, খেলা করত হাওয়ায়, সত্যি কোন জগতে যে হারিয়ে যেতাম... তবে ওঁর ব্যক্তিত্বটাই এমন ছিল, ড্যাব ড্যাব করে মুখের দিকে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতেও ভয় হত। তাতে কী? মেকআপ রুমের এত আয়না, আড়ালে ঠিকই দেখে ফেলতাম।
আমি তখন এক সার দিয়ে সেটে সহ অভিনেতা-অভিনেত্রীদের একের পর এক মেকআপ করে যেতাম। যেটা করতে 'নাগিনা'র সেটে যাওয়া। তখনও শ্রীদেবী কিন্তু নিজের মেকআপ নিজেই করতেন। এই কথাটা হয়তো অনেকেরই অজানা। শ্রীদেবী নিজে কিন্তু একজন বড়মাপের মেকআপ আর্টিস্ট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিখুঁত ভাবে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতেন শ্রীদেবী। আর সে রকমই একজন জাঁদরেল মেকআপ আর্টিস্টকে মেকআপ করানোটা যতটা চাপের, ততটাই চ্যালেঞ্জিং। তার পর হাজার একটা ফিল্মের সেটে, কয়েকশো ইভেন্টে শ্রীদেবীকে দেখেছি। একদিনের জন্যও সাহস করে কথা বলতে পারিনি। দেখতাম আর কী রকম যেন বোবা হয়ে যেতাম। বোকা বনে যেতাম। তবে এই কয়েক দিনে বিনা আলাপেই শ্রীদেবী যে কখন আমার কাছে শ্রীদেবীজি হয়ে উঠলেন বুঝতেই পারিনি।
সুযোগটা এল বেশ কিছু দিন পরে। ১৯৯৩ সালে 'আর্মি'র সেটে। শাহরুখ খানের মেকআপের জন্য প্রোডাকশন থেকে আমাকে ডেকেছিল। শাহরুখ তখন উঠতি অভিনেতা। আর শ্রীদেবী তো স্টার। আমার সঙ্গে শ্রীদেবীজির প্রথম আলাপটাও করিয়ে দিয়েছিলেন শাহরুখ স্যার। এখনও মনে আছে উনি কিছুটা মজার ছলেই বলেছিলেন, ‘‘শ্রীদেবীজি, রাজেশ আপকি বহুত বড়ি ফ্যান হ্যয়। আজকাল জবরদস্ত মেকআপ কর রহা হ্যয় রাজেশ। লেকিন, আপ সে বাত করনে কে লিয়ে শরমা রহি হ্যয় বহুত।’’
মেক আপের এক্কেবারে পরেই ম্যাডামের সঙ্গে দুবাইয়ের এক হোটেলে।
আমি তো কোথায় পালাব, সেই রাস্তা খুঁজে বেড়াচ্ছি। মানে, শাহরুখ স্যারকে প্রায়ই শ্রীদেবীজির কথা বলতাম। ঘ্যানঘ্যানও করতাম ওঁর কানের কাছে। কিন্তু উনি যে এমন কাণ্ড ঘটিয়ে বসবেন সে আর কে জানত? তা যাই হোক, শ্রীদেবীজি হাসতে হাসতেই আমার দিকে জাস্ট একটা লুক দিলেন। ব্যাস! তখন আর আমায় পায় কে! আমি তখন রাজা। বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই হিরোগিরি চালু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কলার তুলে নানান হেয়ার স্টাইল আর কেতবাজি করেই বেশির ভাগ সময় কেটে যেত। তখন এত ঘনঘন সিনেমাও হত না। আর আমরা কাজও এত ঘনঘন পেতাম না। মাঝেমধ্যেই আমাদের বিয়েবাড়ির কাজ ধরতে হত। আমি কাজে যাচ্ছি না, এত সাজগোজ, এসব বেগতিক দেখে বাবা তার কিছু দিনের মধ্যেই আমার বিয়ে দিয়ে দেন। ব্যাস আর কী! তত দিনে শ্রীদেবী নামের ওই হ্যালোজেনের আলো আমার বুকের ভিতরে টুনি বাল্বের মতোই টিমটিম করে জ্বলতে আরম্ভ করে দিয়েছে।
এ ভাবেই টিমটিম করে কেটে যাচ্ছিল দিনকাল। ফিল্মের কাজ, মেগা সিরিয়াল, ইভেন্টের কাজ, বিয়ে, টুকটাক কাজও আসছিল। কিন্তু পাকাপাকি ভাবে কাজ ধরছিলাম না। কারণ আমাদের লাইনে পাকাপাকি ভাবে স্থায়ী কাজ করাটা এক প্রকার বোকামি। তাতে রোজগারে ভাঁটা পড়ে, রোজগারের রাস্তাগুলোও বন্ধ হয়ে যাওয়ার হাজার একটা সম্ভাবনা থাকে। তাই ওই রাস্তায় হাঁটিনি।
আরও পড়ুন: শ্রীদেবী আমার জীবনের এক অধ্যায়
হঠাৎই এক দিন একটা ফোন। ’৯৬ সালের কথা বলছি। শ্রীদেবীজির অফিস থেকে এসেছিল ফোনটা। ওঁর ম্যানেজার ফোনে কাজের কথা বলছিলেন। কী কাজ? না, শ্রীদেবীজির মেকআপ করতে হবে। কোনও ফিল্মের জন্য নয়, সব সময়ের জন্য শ্রীদেবীজিকে সাজাতে হবে। কোনও অনুষ্ঠান, ইভেন্ট, অ্যাওয়ার্ড ফাংশান, বাইরে বা আর যেখানে যেতে হলে ওঁকে সাজতে হত, সে সব জায়গাতেই ওঁকে সাজানো আমার কাজ হবে। ওই তখন থেকেই শ্রীদেবীজি আমার ‘ম্যাডাম’ হয়ে উঠলেন। যেখানেই ম্যাডাম যাবেন, যখনই ম্যাডামের কোনও অনুষ্ঠান থাকবে, আমার কাছে ফোন চলে আসত। যে কাজই থাকুক না কেন, সব ফেলে ছুটে যেতাম।
ম্যাডাম যেখানেই যেতেন, বনি কপূর থাকবেনই।
তবে তাঁর মেক-আপ করলে কী হবে? এক দিনের জন্যও মজা করে ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলব, মাথাতেও আসত না। সাজতে সাজতে উনি দু-এক কথা ইয়ার্কির ছলে বলে ফেললেও, আমি নৈব নৈব চ! আসলে ম্যাডামের ব্যক্তিত্বটাই এমন ছিল যে কথা বলতেই সাহস হত না। ইয়ার্কি-ঠাট্টা তো অনেক দূরের কথা! আগেই বললাম, ম্যাডাম নিজেই মেকআপ দুর্দান্ত করতেন। মেকআপ এক চুল এ দিক ও দিক হলেই আমাকে বলতেন, ‘‘রাজেশজি এই জায়গাটা। রাজেশজি এখানটা একটু।’’ তবে আমাদের প্রতি উনি খুব যত্নশীল ছিলেন। বাইরে যে কোনও জায়গায় ইভেন্ট থাকলেই ম্যাডাম আমাদের যত্ন সহকারে দেখভাল করতেন। খাওয়া-দাওয়া থেকে ঘুম সব ঠিকঠাক হয়েছে কি না, সে সবের খোঁজ নিতেন। সে সময় ম্যাডামের জন্য বহু সিনেমার আমি কাজ পেয়েছি। অনেকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন, অনেককে আমার কাজের কথা বলেছেন। তাঁরাই পরবর্তীকালে কাজে ডেকেছেন।
‘মম’ ছবিতে শ্রীদেবীর লুক।
যদিও ম্যাডামকে ফিল্মের জন্য সাজানোর অভিজ্ঞতা আমার খুবই কম। কেবল ‘মম’ ছবিতে আমি ওঁকে সাজিয়েছি। তাও মেকআপের কাজ শুরু করেছিলেন সুভাষ শিণ্ডে, আমি শেষ করেছিলাম। কারণ, সুভাষের ডেট নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল। তখন ম্যাডাম আর সুভাষ দু’জনেই জোর করাতে আমি শেষে রাজি হয়েছিলাম। কারণ, সিনেমার মেকআপ সম্পূর্ণ আলাদা। শেষের দিকে ঢুকলে মেক-আপ করতেও অসুবিধা হয়। আর ম্যাডামের কথায় ‘না’ করতেও পারতাম না। তাই কাজটা করতেই হয়েছিল শেষমেশ।
আরও পড়ুন: শ্রীর মৃত্যুর রাতেও ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল, বললেন মণীশ
আরেকটা ফোন। আচমকাই। সেই ফোন, যে ফোন এই ইন্ডাস্ট্রির অনেকের কাছে আজও একটা নাইটমেয়ার। ২৪ ফেব্রুয়ারির রাতে আমার কাছেও যখন ফোনটা এল, থমকে গিয়েছিলাম। ফোনের ওপারে যিনি ছিলেন, খানিক ধমকেই তাঁকে বলেছিলাম, মিথ্যা কথা বলছ। তত ক্ষণে গোটা মুম্বই প্রায় জেনে গিয়েছে। আর আমি সারা রাত ঘর আর বারান্দা করছিলাম। কী এক অদ্ভুত অস্থিরতা সে সময়ে কাজ করছিল, তা বলার নয়। সকাল হতে হতে সব একদম জলের মতো পরিষ্কার, শ্রীদেবী আর নেই। ধরেই নিলাম, ম্যাডামের অফিস থেকে কোনও দিন আর ফোন আসবে না।
গত বছর ম্যাডামের জন্মদিনে প্রায় গোটা বলিউডই হাজির হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আবার ফোন এল। ফোন করলেন সেই ম্যাডামের ম্যানেজারই। ঠিক করেই ফেলেছিলাম যাঁর কাছে এতদিন ধরে কাজ করছি, সাজগোজ করতেই যাঁর আমাকে প্রয়োজন হত, তাঁর নিথর দেহের সামনে আমি দাঁড়াব না। তা-ও ফোন এল। ম্যাডামের মরদেহ মুম্বইতে ঢুকতে না ঢুকতেই ফোন এল। তা আমাকে কী করতে হবে? কপূর পরিবারের সকলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, শেষ যাত্রাতেও ম্যাডামকে সাজানো হবে। এক্কেবারে সিনেমার মতোই। সেই রাতেই আমি ছুটলাম অনিল কপূরের বাড়ি। সেখানেই ম্যাডামের নিথর দেহ শায়িত ছিল। তবে আমি যাওয়ার পর ঠিক হল যে, পর দিন সকালে একদম ফ্রেশ ভাবে ম্যাডামকে সাজানো হবে। আর বাড়ি ফিরে আমার সারা রাতটা এই ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল, কী করে সাজাব? এত স্মৃতি, এত কথা, এত কিছু...
আরও পড়ুন: দুঃখ নিয়ে মারা গিয়েছেন, চাঞ্চল্যকর তথ্য দিলেন শ্রীদেবীর মামা
সকালে গিয়ে শ্রীদেবীজির ঘরের দিকে হাঁটছি, সামনে দেখি রানি মুখোপাধ্যায়। রানি ম্যাডামের সঙ্গেও পরিচয় বহু দিনের। আমাকে দেখতেই রানিজি বলে উঠলেন, ‘‘ক্যায়সে করেগা ভাউ?’’ আমি বললাম, “আপনি আমাকে একটু সাহায্য করুন।” কোনও রকমে মেকআপ শুরু করলাম। হাতও সে দিন থরথর করে কাঁপছিল। রানিজি সে দিন খুব সাহায্য করেছিলেন। আমাকে আগেই বলে দেওয়া হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব মেকআপ করে ফেলতে হবে। যত দ্রুতই করি না কেন, মুখটা তো দেখতেই পাচ্ছিলাম। আর বার বার যেন মনে হচ্ছিল, এখনই ম্যাডাম উঠে পড়বেন আর আমাকে বলবেন, “রাজেশজি ইঁয়াহা থোড়া ঠিক কর দিজিয়ে।” মনে হচ্ছিল, এখনই যেন বলে উঠবেন, ‘‘আইলাইনার কো থোড়াসা ঠিক কর দিজিয়ে রাজেশজি।’’ কোনও রকমে সাজিয়েই আমি সেখান থেকে বাড়ি চলে আসি। গাড়িতে আসতে আসতে বার বারই মনে হচ্ছিল, ওই বাড়িটা থেকে, ম্যাডামের অফিস থেকে আর বোধ হয় কখনও ফোন আসবে না। আর সামনে শুধুই মুখটা ভেসে উঠছিল বার বার। আর ভাবছিলাম শেষ দিনের স্মৃতিটা কী করে মুছে ফেলা যায়?
ফোনটা যদিও আবার এল। ম্যাডামের অফিস থেকে আবার তাঁর ম্যানেজারই ফোন করলেন। তবে এ বার ফোনের কারণটা আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। ঠিকই ধরেছেন, জাহ্ণবী...।
অণুলিখন: সায়ন্তন মুখোপাধ্যায়
ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy