‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’ ছবির পোস্টার
মাস দুই আগের কথা। জেমস বন্ড সিরিজের নয়া ছবি ‘স্পেক্টর’-এর দীর্ঘ চুম্বনদৃশ্যটা ভারতীয় সেন্সর বোর্ড কেন কেটেছেঁটে কয়েক সেকেন্ডে নামিয়ে আনল, জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁর কাছে।
সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন (চলতি কথায় তা-ই ‘সেন্সর বোর্ড’) প্রধান পহলাজ নিহালনি বলেছিলেন, ‘‘তার মানে আপনি নিজের বাড়ির দরজা খুলে রেখে সঙ্গম করতে চান। সকলকে দেখাতে চান, কী ভাবে আপনি কাজটা করেন!’’
২০১৬-র মধ্য জানুয়ারিতে সেই পহলাজের কথা তুলতেই রসিক (এবং অবশ্যই ফিল্মরসিক) এক বাঙালি গুনগুনিয়ে উঠলেন উত্তমকুমারের পুরনো ছবির গান, ‘‘তুমি কি সে তুমি নও?’’
এক ‘ড্যানিশ ললনা’ কোন জাদু করলেন পহলাজ নেতৃত্বাধীন বোর্ডকে? বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত পহলাজের বিরুদ্ধে সেন্সর বোর্ডের গৈরিকীকরণের অভিযোগ উঠেছে একাধিক বার। তাঁদের কাঁচি থেকে রেহাই পাননি কোয়েন্তিন তারান্তিনো থেকে বেন অ্যাফ্লেক, লিওনার্দো দি’ক্যাপ্রিও থেকে ড্যানিয়েল ক্রেগ-মনিকা বেলুচ্চি। সেই বোর্ডের হাত থেকেই সম্পূর্ণ অক্ষত দেহে শুধু একটি ‘এ’ সার্টিফিকেট বাগিয়ে গত শুক্রবার ভারতের পর্দায় মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’।
টম হুপার পরিচালিত এই ছবির মিনিটখানেক জুড়ে রয়েছে সামনে থেকে তোলা একটি সম্পূর্ণ নগ্ন দৃশ্য। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিগত কম্পিউটারে ডাউনলোড করা ছবি নয়, মাল্টিপ্লেক্সের পর্দায়
দর্শকেরা গত দু’দিন ধরে দেখতে পাচ্ছেন অভিনেতা এডি রেডমায়নের সেই ‘ফুল ফ্রন্টাল’ নগ্নতা।
কী রকম সেই দৃশ্য?
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নগ্ন এক পুরুষ কাঁধদু’টো ভাঁজ করে নিজের মসৃণ বুকে তৈরি করতে চাইছে বিভাজিকা। পায়ের আড়ালে যৌনাঙ্গ চেপে দেখতে চাইছে, কেমন লাগবে মেয়ে হলে! এক রূপান্তরকামীর জীবন নিয়ে এই ছবি। অস্ত্রোপচার করে পুরুষ থেকে মহিলা হয়ে ওঠা প্রথম যে ক’জন মানুষের কথা শোনা যায়, তাঁদের অন্যতম ছিলেন ডেনমার্কের শিল্পী এইনার ওয়েগেনার। বিবাহিত এই পুরুষ ১৯৩০ থেকে পরপর কয়েকটি অস্ত্রোপচারের পর হয়ে ওঠেন লিলি এলবে।
সেই চরিত্রটিতেই অভিনয় করেছেন রেডমায়নে। আর পহলাজ-রাজত্বে তাঁর সাহসী দৃশ্যগুলোকে কোনও ছুরি-কাঁচির মুখে পড়তে হয়নি!
প্রসঙ্গটা তুলতেই সেন্সর-প্রধান বলছেন, ‘‘এ হল লোকের ধারণাটা বদলানোর চেষ্টা। অনেকেই বলে, বোর্ড নাকি অযথা কাটাছেঁড়া করে। আমরা মোটেও অন্ধের মতো ছবি সেন্সর করি না।’’ পহলাজ জানালেন, গত বছর ‘এনএইচ ১০’ এবং ‘বদলাপুর’ ছবি দু’টিকে কোনও কাঁচি ছাড়াই ‘এ’ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন তাঁরা।
কিন্তু ওই দু’টি বলিউডি ছবিতে বিতর্কটা ছিল নৃশংস দৃশ্য নিয়ে, যৌনতা নিয়ে নয়। মনে রাখতে হবে, পহলাজের আমলেই ভারতে রুপোলি পর্দা দর্শন হয়নি অ্যানাস্টাশিয়া স্টিলের। ডাকসাইটে এই অভিনেত্রীর শয্যাদৃশ্যে ঠাসা ছবি ‘ফিফটি শেডস অব গ্রে’ মুক্তিই পায়নি এ দেশে। বেন অ্যাফ্লেকের ছবি ‘গন গার্ল’ ছাড়পত্র পেয়েছিল রোজামুন্ড পাইক এবং নিল প্যাট্রিক হ্যারিসের শয্যাদৃশ্যটি পুরোপুরি বাদ দিয়ে। লিওনার্দো অভিনীত ‘দ্য উল্ফ অব ওয়াল স্ট্রিট’-এও নেমেছিল ‘টিম পহলাজ’-এর কাঁচি। এমনকী একই শুক্রবারে মুক্তি পাওয়া তারান্তিনোর ‘দ্য হেটফুল এইট’-কেই সেন্সরের পাহাড় ডিঙোতে হয়েছে বেশ কিছু নগ্ন দৃশ্য, মুখমৈথুন ও গালিগালাজের ছবি-শব্দ বাদ দিয়ে।
তা হলে ‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’-এর কপালে শিকে ছিঁড়ল কী করে?
পহলাজের যুক্তি, ‘‘আমাদের মনে হয়নি ‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’-এ কোথাও নগ্নতা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয়েছে। ওই দৃশ্যটা গল্পের সঙ্গে খুব সুন্দর ভাবে মিশে গিয়েছে। তাই আমরা কোনও ‘কাট’ বা ‘ব্লার’ (অস্পষ্ট করে দেওয়া) ছাড়াই ‘এ’ সার্টিফিকেট দিয়েছি।’’ আর তারান্তিনো? পহলাজ বলছেন, ‘‘ওই ছবিতে মহিলাদের প্রতি হিংসার দৃশ্য রয়েছে।’’
ঠিক এই কারণেই ‘সংস্কারী’ টিম-পহলাজের ‘মানসিক পরিবর্তন’ ঘটেছে বলে মানতে নারাজ সোশ্যাল মিডিয়ার একাংশ। তবে টালিগঞ্জের অনেকে আশাবাদী। যেমন পাওলি দাম। ‘ছত্রাক’ ছবিতে তাঁর নগ্নতা নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। পাওলি বললেন, ‘‘আমি খুবই খুশি। এক একটা ছবির এক একটা ভাষা থাকে। সিনেমার ক্ষেত্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতাটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।’’
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক সম্প্রতি একটি বিশেষ কমিটি তৈরির ভার দিয়েছে পরিচালক শ্যাম বেনেগালকে। বিভিন্ন ছবির ‘রেটিং’ (‘ইউ’, ‘এ’, ‘ইউ/এ’ ইত্যাদি) নির্ধারণ করবে ওই কমিটি। বেনেগাল আসায় খুশি অনেকেই। পরিচালক কিউ বললেন, ‘‘অবাধ যৌনতার দৃশ্য তৈরিটাই পরিচালকদের একমাত্র কাজ নয়। সব পরিচালকেরই একটা নির্দিষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধ থাকে। সেটা মাথায় রাখা হলে সিনেমার ক্ষেত্রটাই বদলে যাবে।’’
এ দিন যদিও বেনেগালের ফোন আগাগোড়াই ছিল বন্ধ। মন্তব্য করতে চাননি জাভেদ আখতার থেকে বোর্ডের প্রাক্তন প্রধান শর্মিলা ঠাকুর। যা শুনে অনেকের সন্দেহ, চলচ্চিত্র জগতের দিকপালরা সম্ভবত কেন্দ্রের বিরাগভাজন হতে চান না।
কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী অরুণ জেটলি অবশ্য বলেছেন, ‘‘সরকার কখনওই অসহিষ্ণু নয়। সেন্সর বোর্ডের ব্যাপারেও কেন্দ্র নাক গলায় না। বোর্ডের বিশেষজ্ঞরাই যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy