Advertisement
E-Paper

এত বেশি মহরত যে বিশ্বকর্মা পুজো বলে মনে হত! পয়লা বৈশাখের স্মৃতিচারণে কলম ধরলেন খরাজ

চৈত্র মাস জুড়ে বাড়িতে চড়কের জন্য ভিক্ষুক এবং বহুরূপীরা আসতেন। তাঁদের সঙ্গে থাকত ঢোল। ওই আওয়াজ শুনে বুঝে যেতাম, নতুন বছর আসছে।

Image of Bengali actor Kharaj Mukherjee

খরাজ মুখোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।

খরাজ মুখোপাধ্যায়

খরাজ মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০১
Share
Save

সময়ের সঙ্গে সমাজ, রীতিনীতি— সব কিছুই বদলে যায়। সেটাই কালের নিয়ম। তাই নববর্ষের প্রসঙ্গ উঠলেই আমার মনে আগে ভিড় করে একরাশ স্মৃতিমেদুরতা। বার বার ছেলেবেলার দিনগুলোয় ফিরে যাই।

আমার বাবা ছিলেন ইনকাম ট্যাক্সের আইনজীবী। ছেলেবেলায় পয়লা বৈশাখের দিন মনে আছে, বাড়িতে প্যাকেট প্যাকেট লাড্ডু আসত। পরবর্তী কয়েক দিন সেই লাড্ডু বাড়ির সকলে মিলে যেমন খাওয়া হত, তেমনই প্রচুর লোককে দেওয়াও হত। আমার বাড়ি ল্যান্সডাউনের পদ্মপুকুরের কাছে। চৈত্র মাস জুড়ে বাড়িতে চড়কের জন্য ভিক্ষুক এবং বহুরূপীরা আসতেন। তাঁদের সঙ্গে থাকত ঢোল। ওই আওয়াজ শুনে বুঝে যেতাম, নতুন বছর আসছে। বাড়ির বড়রা তাঁদের খাবার দিতেন। কখনও টাকা দিতেন। আর ল্যান্সডাউন পার্কে চৈত্র মাসের শেষ দিনে বসত চড়কের আসর। আগুন ঝাঁপ, বঁটি ঝাঁপ— এই সব দেখতে যেতাম। আর ভাবতাম যে, ওঁরা কী ভাবে এগুলো করেন। তার সঙ্গে চলত চড়কের প্রসাদ আর ফলমূল বিতরণ।

এই প্রসঙ্গেই একটা ছোট্ট স্মৃতি মনে পড়ে গেল। আমাদের প্রজন্মের যাঁরা, আমি নিশ্চিত, তাঁরা মিল খুঁজে পাবেন। পাড়ায় এক মাস ধরে চড়কের মেলা বসত। মফস্‌সল থেকে বিক্রেতারা আসতেন। সাত দিন বেচাকেনা করতে হবে। পুতুল, ফার্নিচার, হাতের তৈরি জিনিস— অনেক কিছু নিয়ে আসতেন ওঁরা। খাবার বিক্রি হলে রান্নার সরঞ্জাম থাকত। তাই ওঁরা করতেন কী, রাতে জিনিসপত্র আমাদের বাড়িতে রাখার জন্য অনুরোধ করতেন। বাবা-মা রাজি হয়ে যেতেন। কিন্তু আমরা ছোটরা রাজি হতাম না। আমি বায়না করতাম, রাখতে দেব, কিন্তু তার আগে একটা পুতুল দিতে হবে। ওই ঘাড়নাড়া দাড়িওয়ালা মাটির পুতুলগুলো আমার খুব পছন্দের ছিল। ওঁরা বলতেন, ‘‘বাবু, রাখতে দাও। তোমাকে ঠিক পুতুল দেব।’’ আর আমি প্রতিদিন জোর করতাম যে, দিতেই হবে, আজই দিতে হবে। তার পর চলে যাওয়ার দিন সত্যিই আমার হাতে একটা পুতুল ওঁরা দিয়ে যেতেন। তবে পরের দিন বাড়ির নীচতলা খালি হয়ে গেলে একটু হলেও কিন্তু আমার মনখারাপ হত।

পরবর্তী জীবনে যখন অভিনয়ে এলাম, তখন পয়লা বৈশাখের দিন স্টুডিয়োপাড়ার মহরতে ডাক পড়ত। তখন নববর্ষে ফ্লোরে ফ্লোরে মহরত হত। পয়লা বৈশাখে মহরত মানে ছবির জন্য শুভ, এমনটাই ভাবতেন প্রযোজকেরা। যে ছবিতে আমি রয়েছি, সেখানে তো যেতামই, আবার যাঁদের ছবিতে আমি নেই, সেখান থেকেও আমন্ত্রণ আসত। এত বেশি মহরত হত যে, বিশ্বকর্মা পুজো বলে মনে হত। কখন কখন কার মহরতে যাব, সেই সময় বার করতেই বেগ পেতে হত। মহরতে নতুন ছবির ক্ল্যাপস্টিক দেওয়া হত। নতুন পোশাক পরে সকলে মিলে ফ্লোরে আসতেন। বড় প্যান্ডেল বাঁধা হত। পাত পেড়ে খাওয়াদাওয়া আর দেদার আড্ডা। সে সব সোনালি দিনগুলো আজকে খুব মনে পড়ে। এখন তো সবই বদলে গিয়েছে। সারা বছরই ছবির মহরত হচ্ছে। সবটাই প্রযোজনা সংস্থার অফিসে সীমাবদ্ধ।

Image of Bengali actor Kharaj Mukherjee

খরাজ মুখোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

এখন তো বলা হয়, বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালি নাকি কোণঠাসা। আমাদের মধ্যে থেকে বাঙালিয়ানা হারিয়ে যাচ্ছে। খুব একটা ভুল নয়। বাঙালিদের পোশাক, বেশভূষা সবই বদলে গিয়েছে। নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ তো বাংলা বলতে বা লিখতে পারে না। আমার ভাইঝি সে দিন আমাকে প্রশ্ন করল, ‘‘ওষ্ঠ মানে কী?’’ এখন, মুশকিল হচ্ছে, আমরা শুধুই অভিযোগ করে চলেছি। কিন্তু নিজেদের দোষ দেখছি না। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব তো আমাদেরই।

আমাদের ছেলেবেলায় পাড়ায় পাড়ায় ছোটদের মধ্যে রবীন্দ্রজয়ন্তী বা নজরুলজয়ন্তী পালনের একটা রেওয়াজ ছিল। আমি নিজেও এ রকম বহু অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠ করেছি, গান গেয়েছি। সব থেকে বড় কথা, পাড়ার প্রত্যেকেই ছোটদের এই ধরনের প্রয়াসে উৎসাহ দিতেন। আজকে তো পাড়া বদলে হয়ে গিয়েছে ফ্ল্যাট। তার মধ্যেই আত্মকেন্দ্রিক, প্রতিযোগিতাপূর্ণ জীবন, আর রয়েছে মোবাইল এবং সমাজমাধ্যম! এখন রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিন সকালে হয়তো মাইকে গান বাজিয়ে দেওয়া হল। ব্যস, দায়িত্ব শেষ! খারাপ লাগে, দুঃখ হয়। আর ভাবতে থাকি, আগামী দিনে আর কী কী দেখতে হবে! এ সব দেখেই তো ‘হায় বাঙালি হায়’ গানটি ভেবেছিলাম।

শহর কলকাতা বদলে গিয়েছে। বাঙালিয়ানার সঙ্গেও ক্রমশ যেন শহরটার দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু আমি গ্রামেগঞ্জে শো করতে গিয়ে দেখেছি, এখনও কিন্তু সেখানে বাঙালিয়ানা বেঁচে রয়েছে। সহজ জীবনে আধুনিকতার হাতছানি নেই। সারা বছর বাংলার নিজস্ব উৎসব, পরব থেকে শুরু করে নবান্ন বা পিঠেপুলির চৈত্র সংক্রান্তি, সবই পালিত হয়। আসলে সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে হয়। এখন দেখি মফস্‌সলেও জীবন বদলাচ্ছে। আমি পরিবর্তনের বিরোধী নই। কিন্তু আমরা যেন সেটা করতে গিয়ে নিজের শিকড়কে ভুলে না যাই। বাঙালি পারে না, এ রকম কোনও কাজ তো নেই। ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে। তাই এখনও আমার মধ্যে আশা বেঁচে রয়েছে।

Kharaj Mukherjee Bengali Actor Tollywood Actor poila baisakh Poila Baisakh 2024 Bengali New Year Memory nostalgic Celebration of Bangaliana Bengali Culture

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।