Advertisement
E-Paper

তুমি আছ...আমি আছি...পাশাপাশি

অভিমানে-ক্রোধে চোদ্দো বছর আগে ফোটোশ্যুট থেকে বেরিয়ে যাওয়া। দেড় বছর আগে রাতের গোপন মিটিং। আপাতত লস অ্যাঞ্জেলিস রিলিজ। ‘প্রাক্তন’-য়ের অজানা কাহিনি শোনাচ্ছেন মনোজিৎ সরকারশুক্রবার ২৭ মে গোটা দিনের প্ল্যানিং করে ফেলেছেন প্রভাত রায়। ‘‘সকাল সকাল লর্ডসের মোড় থেকে মাছ কিনে আনব। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে বিকেলে ‘প্রাক্তন’ দেখতে যাব। এত দিন পর বুম্বা-ঋতু একসঙ্গে। দেখতে আমাকে হবেই,’’ বলছিলেন প্রভাতবাবু।

শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৬ ০০:২২
প্রসেনজিতের নতুন বাড়ি সে দিনই প্রথম দেখলেন নায়িকা। এরপর নায়ক নিজে লুচি পরিবেশন করে খাওয়ালেন ঋতুকে। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

প্রসেনজিতের নতুন বাড়ি সে দিনই প্রথম দেখলেন নায়িকা। এরপর নায়ক নিজে লুচি পরিবেশন করে খাওয়ালেন ঋতুকে। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

শুক্রবার ২৭ মে গোটা দিনের প্ল্যানিং করে ফেলেছেন প্রভাত রায়।

‘‘সকাল সকাল লর্ডসের মোড় থেকে মাছ কিনে আনব। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে বিকেলে ‘প্রাক্তন’ দেখতে যাব। এত দিন পর বুম্বা-ঋতু একসঙ্গে। দেখতে আমাকে হবেই,’’ বলছিলেন প্রভাতবাবু।

একই কথা হরনাথ চক্রবর্তীর গলায়। ‘‘সে দিন তাড়াতাড়ি বাড়িতে পুজোটা সেরে ফেলতে হবে। আরে, আমার ‘দায়দায়িত্ব’, ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’‌য়ের জুটির কামব্যাক হচ্ছে। দেখব না মানে!’’ নিজস্ব ভঙ্গিতে বলেন হরনাথবাবু।

হ্যাঁ, ২৭ তারিখ মুক্তি পাচ্ছে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায় পরিচালিত ‘প্রাক্তন’। ১৪ বছর পর আবার বাংলা সিনেমায় সেই জুটির প্রত্যাবর্তন হতে চলেছে।

প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা।

শহরের রাজপথে ছেয়ে গিয়েছে পোস্টার। কিন্তু সব পোস্টারের পিছন থেকে যেন ব্যাকগ্রাউন্ডে শোনা যাচ্ছে সেই গান, ‘সেই তো আবার কাছে এলে’।

কিন্তু ‘প্রাক্তন’দের নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, একটু সময়ের কাঁটা পিছনে ফেরাতেই হয়।

সেপ্টেম্বর মাস। সালটা ২০০১। পুজোর ঠিক আগে আগে। শনিবারের ‘পত্রিকা’র পুজোর বিশেষ ফোটোশ্যুট করতে আমরা হাজির পার্ক হোটেলের তিন তলার ঘরে।

মডেল? কে আবার। প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।

সে দিন সকাল সকাল দু’জনেই হাজির। সাড়ে ন’টায় ফোটোশ্যুট শুরু। ন’টার মধ্যেই দু’জনে মেক আপে বসে গিয়েছেন।

বাংলা সিনেমার পোস্টারে যেমন নায়ক-নায়িকা পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসে, অনেকটা সে ভাবেই বসে আছেন ওঁরা দু’জনে। কানে ফোন।

প্রথমে আমরা কেউই বুঝতে পারিনি যে, ওঁরা একে অপরের সঙ্গেই ফোনে কথা বলছেন। আমরা ভাবছিলাম দু’জনে বোধহয় আলাদা আলাদা কাউকে ফোন করছেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখলাম, প্রসেনজিতের ফোনের স্ক্রিনে ঋতুর নাম। এবং উল্টোটা।

তখনই মনে কী রকম একটা শঙ্কা হয়েছিল। সব ঠিক আছে তো? একই ঘরে দু’জনে কেন ফোনে কথা বলবেন একে অন্যের সঙ্গে?

এই ভাবতে ভাবতেই শুরু হল ফোটোশ্যুট। প্রথম চেঞ্জ ডান। একটু মেক আপ পাল্টে দ্বিতীয় চে়ঞ্জও শেষ হল। কিন্তু একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম দু’জনের মধ্যে টেনশন যেন ক্রমশ বাড়ছে। ফোনে কথাও একটু কম হচ্ছিল।

তৃতীয় চেঞ্জটার সময় দেখলাম দু’জনেই যথেষ্ট আড়ষ্ট। একটা সাঙ্ঘাতিক ছাড়া ছাড়া ভাব দু’জনের মধ্যেই। তৃতীয় সেটের ফোটোশ্যুট শেষ হতেই আর দাঁড়ালেন না প্রসেনজিৎ।

হনহন করে দরজা খুলে হাঁটতে থাকলেন পার্ক হোটেলের করিডর দিয়ে। লিফটের তোয়াক্কা না করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন তখন তিনি। পিছনে প্রায় ছুটতে ছুটতে দৌড়চ্ছেন ঋতুপর্ণা ‘বুম্বাদা, বুম্বাদা’ বলে।

ঠিক পিছনে আমি। একবারের জন্যও পিছনে ফিরে না তাকিয়ে সোজা পার্ক হোটেলের সেই পুরনো রিসেপশনের সামনে এসে দাঁড়ালেন প্রসেনজিৎ। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘‘মনোজিৎ, আমাকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দে তো!’’ আমি বললাম, ‘‘বুম্বাদা, আমাদের অফিসের গাড়ি রয়েছে...’’ আমার কথা থামিয়ে দিয়ে শুধু বললেন, ‘‘না, ট্যাক্সি ডেকে দে।’’

আমি ট্যাক্সি ডাকলাম। জাস্ট ট্যাক্সিতে ওঠার আগে আমার দিকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বেরিয়ে গেলেন প্রসেনজিৎ।

ফিরে এসে দেখলাম ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। ঋতু বাকি দু’টো চে়ঞ্জ ছেড়ে পনেরো মিনিটের মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন। এর পর থেকে আর কোনও দিন কোনও ছবিতে তাঁদের দেখা যায়নি।

তারপর শুধুই তাঁদের দেখা গিয়েছে ‘পত্রিকা’র পাওয়ার লিস্ট ও পুজোর ফোটোশ্যুটে। তাও এই ঘটনার সাত বছর পর।

কাট টু - গত বছর নভেম্বর মাস।

শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘প্রাক্তন’‌য়ের শ্যুটিংয়ের একটি দিন। সে দিন আবার ঋতুপর্ণার জন্মদিন।

দেখলাম তাঁরা দু’জনে আবার একসঙ্গে। শট দিচ্ছেন, স্টিল ফোটোগ্রাফারের আব্দার মেটাচ্ছেন। দেখতে দেখতে ২০০১-এর সেই দিনটা খুব মনে পড়ছিল।

সত্যি, এই পৃথিবীতে ‘চেঞ্জ ইজ দ্য ওনলি কন্সট্যান্ট’।

অনেক বছর পরে ঋতু আর প্রসেনজিৎকে আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছিল সেই ফোটোশ্যুটের দিন?

এসি টু টায়ারের নীচের বাঙ্কে বসে গম্ভীরভাবে ঋতু বলেছিলেন, ‘‘আমি বুম্বাদাকে বলেছিলাম আমাদের দু’জনেরই বয়স হচ্ছে। আমাদের নতুন নতুন হিরো বা হিরোইনদের সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমারও কমবয়সি হিরোদের সঙ্গে কাজ করা উচিত। তোমারও কমবয়সি নায়িকাদের সঙ্গে আরও ফিল্ম করা উচিত। এটা নাকি বুম্বাদার অপমানজনক লেগেছিল। বুম্বাদা কিছুতেই চায়নি আমার সঙ্গ ছাড়তে।’’

পরে প্রসেনজিৎকে বাড়িতে একই প্রশ্ন করেছিলাম। তাঁর দোতলার ঘরে চা খেতে খেতে বলেছিলেন, ‘‘সে দিন আমাকে যথেষ্ট অপমান করেছিল ঋতু। একজন সিনিয়র অ্যাক্টরের যে রেসপেক্ট প্রাপ্য সেটা পাইনি ওর কাছ থেকে। সেই জন্যই সে দিন ফোটোশ্যুট ছেড়ে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরে চলে এসেছিলাম।’’

পরে প্রসেনজিতের সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম, ২০০৮-এর ‘পত্রিকা’র পাওয়ার লিস্টের গল্ফ ক্লাবের ফোটোশ্যুটটাই ছিল তাঁদের প্রত্যাবর্তনের প্রথম ধাপ। সে দিন ফোটোশ্যুট চলাকালীন ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের দুই কর্ণধার বলাবলি করছিলেন, ‘‘এদের দু’জনকেই একসঙ্গে ফিল্মে আনা উচিত। দে শুড ডু মোর ফিল্মস।’’ কিন্তু তখনও দিল্লি বহুত দূর। পরের বছরের পুজোর শ্যুটেও তাঁদের একসঙ্গে আনে শনিবারের ‘পত্রিকা’। বালিগঞ্জের বাড়িতে দু’জনেরই এক বন্ধু তাঁদের আলাদা একটা ড্রয়িং রুমে বসান একসঙ্গে কাজ নিয়ে কথা বলানোর জন্য। কিন্তু যে বাড়িতে ফোটোশ্যুট হচ্ছে সেই পরিবারের এক আত্মীয় প্রসেনজিৎ আর ঋতুপর্ণার সঙ্গে ছবি তুলবেন বলে হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়েন। মিটিং আর হয় না। থমথমে মুখে দু’জন দু’দিকে চলে যান সে দিন।

এর পরেও সৃজিত মুখোপাধ্যায় পরিচালিত পত্রিকা-র পুজোশ্যুটে তাঁদের একসঙ্গে দেখা যায়। তত দিনে আগের মতো হিমশীতল ছিল না সম্পর্ক। একটু আধটু কথাও বলছিলেন তাঁরা সেই ফোটোশ্যুটে।

এর প্রায় দেড় বছর বাদে তাঁদের কমন বন্ধু সাংবাদিকের বাড়িতে মিটিং কাম দু’জনের প্রথম সাক্ষাতের ব্যবস্থা হয়। দু’জনে আলাদা আলাদা আসেন। সেই আড্ডা হাফ টাইম গড়াচ্ছে, এমন সময় ঢোকেন শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, যিনি কাছাকাছিই অপেক্ষা করছিলেন।

ওঁদের দু’জনের সঙ্গে কাজ করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন শিবু। দু’জনেই মৌখিক সম্মতি দেন। ঋতুপর্ণা সবসময় শিবপ্রসাদকে পরিচালক হিসেবে ভরসা করতেন। ‘মুক্তধারা’ দেখে প্রসেনজিতেরও তত দিনে শিবুর কাজ পছন্দ হয়েছে।

সে দিন দু’জন যেমন আলাদা আলাদা এসেছিলেন, তেমন আলাদা আলাদা বেরিয়েও যান। কিন্তু গভীর রাতের সল্ট লেকে বাংলা সিনেমার মোড় ঘোরানো এক মিটিং হয়ে যায় নিঃশব্দে। তার পরেও ঝামেলার শেষ ছিল না। প্রযোজক কে হবেন, সেটা নিয়ে মতবিরোধের জন্য ছবি শুরু হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।

কিন্তু তত দিনে বরফ অনেকটাই গলে গিয়েছে। নিন্দুকেরা বলেন, মুম্বই বা লখনৌতে ইতিউতি দেখাও করেছেন প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা।

‘‘আমি শিবুকে কনগ্র্যাচুলেট করছি। ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’‌য়ের মতো অত বড় হিটের পর আমি কত চেয়েছিলাম বুম্বাদা আর ঋতুকে আবার ফেরানোর। সেটা শিবু করে দেখাল। হ্যাটস অফ ওকে,’’ বলছিলেন হরনাথ। হরনাথের মতোই শিবুকে বাহবা দিচ্ছেন প্রভাত রায়ও। তার সঙ্গে তিনি অবশ্য বলছেন ওই জুটির দুর্দান্ত কেমিস্ট্রির কথা। ‘‘ঋতু আর বুম্বা ইজ ম্যাজিক অন স্ক্রিন। ও রকম রসায়ন আমি দেখিনি,’’ বলেন প্রভাত রায়।

কারও কারও আবার মনে হচ্ছে, দু’টো জেনারেশন পেরিয়ে যাওয়ার পর আদৌ কাজ করবে ওঁদের কেমিস্ট্রি?

নতুন যুগে সেই রসায়নের পরীক্ষা দেখার জন্য আগ্রহী গোটা টলিউড। গোটা ইন্ডাস্ট্রিতে এখন ‘প্রাক্তন’-‌য়ের প্রিমিয়ারের পাস পাওয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।

Prasenjit Chakraborty Rituparna Sengupta Tollywood praktan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy