Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

অরুন্ধতী রায় হব

সার্থক সাহিত্য রচনা মাতৃভাষাতেই হয়, অনেকের ধারণা। কিন্তু কোন ভাষাকে লেখক নিজের ভাবনার বাহন করবেন, সে স্বাধীনতায় অন্যরা নাক গলায় কী করে? ভদ্রজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় স্বপ্ন দেখেন, সেটাই তাঁর মাতৃভাষা। ইতরজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় গালাগাল দেন, মাতৃভাষা সেটাই। বাঙালি ফ্যাতাড়ু-শিরোমণি গোপাল ভাঁড় ‘শঁড়া অন্ধা’র রিফ্লেক্স অ্যাকশনে এ থিয়োরি মানিয়ে ছেড়েছেন। কাজেই, গোধূলি লগ্নে কর্পোরেট কিউবিক্ল থেকে জানলার কাচ ভেদ করে স্বপ্নবিহ্বল দৃষ্টিতে যে বঙ্গনাগরিক হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো অস্তাচলগামী সূর্যটিকে দেখে ‘ওয়াও’ বলে উঠছেন, তিনি নির্দ্বিধায় ‘অবাঙালি’।

সুস্নাত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

ভদ্রজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় স্বপ্ন দেখেন, সেটাই তাঁর মাতৃভাষা। ইতরজনে বলেন, যিনি যে ভাষায় গালাগাল দেন, মাতৃভাষা সেটাই। বাঙালি ফ্যাতাড়ু-শিরোমণি গোপাল ভাঁড় ‘শঁড়া অন্ধা’র রিফ্লেক্স অ্যাকশনে এ থিয়োরি মানিয়ে ছেড়েছেন। কাজেই, গোধূলি লগ্নে কর্পোরেট কিউবিক্ল থেকে জানলার কাচ ভেদ করে স্বপ্নবিহ্বল দৃষ্টিতে যে বঙ্গনাগরিক হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো অস্তাচলগামী সূর্যটিকে দেখে ‘ওয়াও’ বলে উঠছেন, তিনি নির্দ্বিধায় ‘অবাঙালি’। গোবরে পা পড়লে তাই তিনি ‘ধুস শালা’ বলেন না, রিফ্লেক্সেই ‘শিট’ বলেন। এখন ব্যাপার হল, এই অবিচল অবাঙালিয়ানা নিয়ে তাঁর জীবনে ফোঁটামাত্র চাপ নেই; যত চাপ আমাদের, একদা ভাষা-শহিদ বাঙালির। মুখ ভেংচে আমরা এঁকে ‘ট্যাঁশ’ বলব, ‘টুইংকল টুইংকল লিটল স্টার’ বলব।

এক দিন শ্রী মধুসূদন দত্তকেও যে কথা শুনতে হয়েছিল ‘মাইকেল’ হওয়ার ফলস্বরূপ। ইংরেজি সাহিত্যে তেমন কলকে পেলে তিনিও দাসকে মনে রাখার জন্য মায়ের কাছে কত দূর মিনতি করতেন, বলা মুশকিল! বঙ্কিমচন্দ্রও তাঁর কেরিয়ার শুরু করেছিলেন ইংরেজিতেই, ‘Rajmohan’s Wife’ দিয়ে। সত্যজিৎ রায়ের লেখা প্রথম দুটি গল্পই তো ছিল ইংরেজিতে। ‘Abstraction’ ও ‘Shades of Grey’। অতঃপর ফিরে আসা... কিন্তু সেই ফিরে আসাটুকু ছিল তাঁদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। স্বাধীনতা। তাঁরা ফিরে না এলে বাংলায় কলম না ধরে ইংরেজিতেই চালিয়ে গেলে, সেটাও হত তাঁদেরই স্বাধীন সিদ্ধান্ত। কে কোন ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টি করবে, সে স্বাধীনতা তো সেই সাহিত্যিকেরই থাকবে। সে তার বাই ডিফল্ট মাতৃভাষাকে অস্বীকার করে বাই চয়েস অন্য কোনও ভাষার চৌকাঠ মাড়ালে, তাকে হাড়িকাঠ টু ফাঁসিকাঠ টানাহ্যাঁচড়া করা কি নিছক ভাষাতান্ত্রিক মৌলবাদ মাত্র নয়! আসল কথা হল, সেই লেখাটি আদৌ ‘লেখা’ পদবাচ্য হচ্ছে কি না, ঠিকঠাক উতরোচ্ছে কি না, তা তিনি যে ভাষাতেই খুশি লিখুন না কেন।

আবার উলটোটাও আছে। কিছুতেই আমরা মেনে নেব না অমিতাভ ঘোষ ‘ইংরেজ’। স্বীকার করব না ঝুম্পা লাহিড়ির ‘মাতৃভাষা’ বাংলা নয়। কিন্তু বেলজিয়ামের ফাদার দ্যতিয়েন ফরাসি ছেড়ে ছাঁকা বাংলায় রম্যরচনা লিখলে আমরা তাঁকে ‘বাঙালি’ বলেই মেনে নেওয়ার দাবি জানাই। উইলিয়াম কেরি থেকে উইলিয়াম রাদিচে তাঁরা গুণী ও শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি বটেই, কিন্তু তাঁদের দিকে তাকানোর সময় তাঁদের যোগ্যতা ব্যতিরেকেই এক ‘বাঙালি ইংরেজ’-এর সান্নিধ্য লাভের গর্ববোধই আমাদের মধ্যে সবচেয়ে আগে প্রকাশ পায়। বাপ্টিস্ট মিশনারি কেরি বাংলায় বই লিখলে, ব্রিটিশ সাহিত্যিক রাদিচে রবীন্দ্রনাথ আওড়ালে বাঙালি ধন্য ধন্য করে। কিন্তু শ্যাম আর কুল, দুটোই তো একই সঙ্গে রাখা যেতে পারে না! মাদার টেরেজাও ভারতীয় নোবেলজয়ী, আবার হরগোবিন্দ খোরানাও এ কেমন সমীকরণ!

অথচ সাহিত্যের দুনিয়ায় ভাষা-স্বাধীনতার এমন উদাহরণ বিরল নয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি জন্মেছিলেন কবি তরু দত্ত। লেখালিখি করেছেন ইংরেজি আর ফরাসিতে। মনে মনে তিনি ফরাসিই ছিলেন। তাঁর পরিচিতিই ছিল: জাতিতে হিন্দু, শিক্ষায় ইংরেজ, অন্তরে ফরাসি। কিংবা মিলান কুন্দেরা। চেক দেশে জন্মেও তিনি ফরাসি সাহিত্যিক হিসেবেই পরিচিত হতে চেয়েছেন। তাঁর লেখালিখি ‘ফরাসি সাহিত্য’ হিসেবেই গণ্য হোক, এমনকী বইয়ের দোকানেও ফরাসি বইয়ের তাকেই তাঁর বইপত্র থাকুক আজও এমনই ইচ্ছে তাঁর। স্যামুয়েল বেকেট-এর নামও এই ব্র্যাকেটে ঢোকানো যায়। আয়ারল্যান্ড-এর নাগরিক হয়েও বহু কাজই তাঁর ফরাসি ভাষায়। ‘En attendant Godot’ হল ফরাসিতে লেখা সেই নাটকটি, ভাষান্তরে যেটি ‘Waiting for Godot’ নামে মুখে মুখে ফিরেছে।

ইতালীয় চিত্রনির্মাতা পিয়ের পাওলো পাসোলিনি প্রথম জীবনে বেশ কিছু কবিতা লিখেছিলেন। যে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ ইতালীয় ভাষায় তিনি কথা বলতেন, সে ভাষায় নয়, কবিতাগুলি ছিল ইতালির গ্রাম্য ভাষা ফ্রিউল্যান-এ। এ জন্য পৃথক ভাবে এই ভাষার বিস্তর চর্চাও করতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর প্রথম বই ‘Versi a Casarsa’ ছিল সে ভাষাতেই লেখা। পণ্ডিতেরা বলেন, এ নাকি যুবক পাসোলিনির রাজনৈতিক অবস্থান। বটেই। কোণঠাসা ভাষাকে আগলে স্রোতের উলটো দিকে হেঁটে যাওয়ার স্বাধীনতাই বা এক জনের থাকবে না কেন? কেন এক জন এস.টি সংরক্ষণের বদান্যতা পাবেন, অথচ নিজের ভাষায় উচ্চশিক্ষার স্বাধীনতা পাবেন না? কেন তাঁকে পরীক্ষার খাতায় প্রামাণ্য বাংলাই লিখতে হবে? বিজাতীয় ঝড়-ঝঞ্ঝার থেকে নিজের ভাষাকে, তার প্রতিটি অক্ষরকে, শব্দকে, শব্দের মাঝের প্রতিটি বিমূর্ত শূন্যস্থানকেও মনে মনে সযত্নে আঁকড়ে থাকা সহজ কথা নয়।

কবীর সুমন যেখানে বলেন, ‘দরকার হলে আমি খুব প্রাদেশিক, রাষ্ট্র মানি না নিজের ভাষাকে ভুলে।’ আর ভুয়ো ভূপর্যটক মন্দার বোস বলেন, ‘বিদেশে গিয়ে আপনি যদি বাংলা ভুলতে চান তো তিন মাসেই ভুলতে পারেন, আর যদি না চান তো তিরিশ বছরেও ভুলবেন না।’ কিন্তু ভুললে তো চলবে না, এই ভুলতে চাওয়া কিংবা ভুলতে না-চাওয়া এ দুয়ের স্বাধীনতাই ব্যক্তিবিশেষের থাকা উচিত। তা সে স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ময়েই হোক বা আচমকা খিস্তিতে। কিংবা ভাষার যাবতীয় সীমানা ভেঙে দেওয়া কোনও একটা ট্রিমেন্ডাস কবিতায়!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

susnata chowdhury susnata independence day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE