Advertisement
E-Paper

আশ্বিনের কোল খালি থাকে না

বয়ঃসন্ধির সেই দুর্গাপুজোর কাছে জানতে চাই, আমাকে তার মনে আছে কি? লিখছেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়।এখন আকাশে কখনও রোদ্দুর, কখনও বৃষ্টি। আশ্বিনের গোড়ার দিকে আকাশ এই রকম খামখেয়ালি হওয়ারই তো কথা ছিল। তাই হয়েছে। তবে তাতে কার কী এসে গেল? বয়ঃসন্ধির সেই দুর্গাপুজোর কাছে জানতে চাই, আমাকে তার মনে আছে কি? লিখছেন অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৫ ১৪:২৪

এখন আকাশে কখনও রোদ্দুর, কখনও বৃষ্টি। আশ্বিনের গোড়ার দিকে আকাশ এই রকম খামখেয়ালি হওয়ারই তো কথা ছিল। তাই হয়েছে। তবে তাতে কার কী এসে গেল? আকাশের অনুমতি ছাড়াই রোদ-বৃষ্টির ফাঁক গলে ঢুকে পড়েছে পুজোর আমেজ। বিছানায় শেষ রাতে হাল্কা শীত অনুভব করছি। বুঝতে পারছি, আমার বঞ্চিত দৃষ্টির অগোচরে কোথাও নিশ্চয়ই কাশফুল ফুটে উঠেছে। ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে শিউলির ডাল। পদ্মের গোলাপি থেকে শিশির পিছলে যাচ্ছে পুকুরের জলে। আসলে প্রকৃতির অন্তরে পুজোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। আমরাও কি উৎসবের আয়োজনে কোমর বেঁধে নেমে পড়িনি?

এই যে নানা পশরায় দোকানপাট সেজে উঠেছে, উপচে-পড়া না হলেও তাতে ক্রমশ ভিড় বাড়ছে। গয়না না শাড়ি, কাশ্মীর না কন্যাকুমারী— ঘরে ঘরে তর্কের ঝড়। বিউটি পার্লারে জোরালো আলোর নীচে শুরু হয়ে গেছে শরীর ঘষামাজার পালা। আগে থেকে না ঘষলে চেহারায় ঠিকরে-পড়া জেল্লা আসে নাকি! মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত সুন্দরতম হতে হবে। যেন এই ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে গেলে ওই ফুটপাথে ছেলেটি থমকে দাঁড়িয়ে যায় কিছু ক্ষণ। আমি খুব জানি। রক্তে মাংসে হাড়ে মজ্জায় জানি, পুজো এলে এই ভাবনাই ঘুরঘুর করে উঠতি যৌবনে।

আজ বেশ মনে পড়ে, পুজোর সময় আমার সমস্ত চিন্তা জুড়ে থাকত, সপ্তমীতে কেমন সাজব...অষ্টমীতে সবচেয়ে গরজাস শাড়িটা...নবমীতে ফাটাফাটি লুক চাই! বাবার লৌহকঠিন প্রহরা এড়িয়ে পুজোর পাঁচ দিন ছেলেগুলোকে আমার পিছনে দৌড় করাতে হবে তো! ভাবলে খুব হাসি পায়— আমি এখন শাড়ি সরিয়ে স্কার্ট, কেপরি, জিনসের দিকে হাত বাড়াচ্ছি আর বয়ঃসন্ধিকালে যখন ভাল করে শাড়ি পরতেই পারতাম না, মায়ের সঙ্গে জেদ করে পুজোর ক’দিন শাড়িই পরেছি। শাড়ি পরলে বেশ বড়সড় দেখায়। আসলে আমার সমবয়সি বা আমার থেকে এক-দু’ বছরের বড় ছেলেগুলোকে আমার মোটেও পছন্দ হত না। মনে হত, ওরা কী ন্যাকা আর এলেবেলে ক্যাবলা! আমার অসম্ভব বুদ্ধি, ম্যাচিওরিটি, স্মার্টনেসের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে আমার থেকে অন্তত পনেরো-ষোলো বছরের বড় যারা। বড় ছেলেগুলোর নাকে দড়ি পরিয়ে ঘোরাতে বেশি আনন্দ পেতাম। তবে ওরা কেউই কোনও দিন আমার মনে রেখাপাত করতে পারেনি। ওরা খুব সাদামাটা, সাধারণ, একঘেয়ে। একটু অ-সাধারণ, অন্য রকম না হলে কি ভাল লাগে! এই ভাল লাগা পরে আমার জীবনসঙ্গী নির্বাচনেও যে ছাপ ফেলেছে, তা বলাই বাহুল্য। আসলে ওই বয়সে ওই দারুণ ছটফটানিগুলো প্রেম নয়, কেবল ভাল লাগা।

সেই ভাল লাগার টানে আমি অনায়াসে সপ্তমীর দিন ‘ক’-এর সঙ্গে, অষ্টমীর দিন ‘খ’-এর সঙ্গে, নবমীর দিন ‘গ’-এর সঙ্গে রাস্তায় পাশাপাশি বহু দূর হেঁটে গিয়েছি। আমার জন্য ওদের একটু হাসি, একটু কথা, একটু প্রেম বা আর-একটু থাকার আবেদন, আর-এক বার দেখা করার আকুতি, আর-এক বার হাত ছোঁয়ার আকুলতা আমার মনে তখন জয়ের আনন্দ এনে দিত। ওরা যত ভিখিরি হত, আমি ততই রানি হয়ে উঠতাম! যে কোনও কিছু জয় করতে আমার দারুণ লাগে।

তবে আমার বয়ঃসন্ধির সব দুর্গাপুজোই কিন্তু এমন জয়ধ্বনিতে কাটেনি। কোনও এক পুজোয় গো-হারান হেরে গিয়েছিলাম। সে বছর পুজোয় আমাকে ঘিরে মৌমাছি ওড়েনি। পায়ের কাছে টুপটাপ চিঠি পড়েনি। ও, ভাবছেন বুঝি, সে বার পুজোয় হাতির মতো ফুলে গেছি! খ্যাংরা কাঠির মতো চুপসে গেছি! চুল উঠে টাক! কিংবা গালে কাটা দাগ! কক্ষনও তা নয়। সে বছর আমার কোষ্ঠীতে চন্দ্রে রাহু ঢুকেছিল। সবই আমার কপাল। বেশ, তবে সেই কপালের গল্পই বলছি।

সে দিনটা ছিল দুর্গাপঞ্চমী। আমি তখন ক্লাস এইট। পুজোর ছুটির আগে লাস্ট কোচিং ক্লাস সেরে বাবার সঙ্গে সন্ধের লাল আলো মাড়িয়ে মাড়িয়ে বাড়ি ফিরছি। মন্দিরতলায় রাস্তার পাশে দাঁড়ানো দুটো ছেলে নিশ্চয়ই আমাকে কিছু বাজে কথা বলেছিল। বাবা আমায় বলল, ‘‘এখানে দাঁড়া।’’ তার পর হনহন করে ওদের দিকে এগিয়ে গেল। ওদের ঠেস দেওয়া কনুইয়ের তলা থেকে সাইকেলটা টেনে বার করে দু’হাতে মাথার ওপর তুলে রাস্তায় আছড়ে ফেলল। ব্যস, ‘দিকে দিকে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে’! ভিতু ছেলের দল ভয় পেয়ে গেল। আমারও কপাল পুড়ল। কিন্তু সেই ভয়ও রইল মাত্র কিছু দিনের জন্য। প্রেম তো চিরকাল অকুতোভয়!

আমার বয়ঃসন্ধির দুর্গাপুজো নিয়ে বলতে বসে সেই বিশেষ পুজোটার কথা বলব না, তা কি হয়? সেই পুজোয় আমার দু’হাত ভরা অভিজ্ঞতা আমার দু’গুণ বয়স বাড়িয়ে দিল। সেই পুজোয় আমি প্রথম জীবন ছুঁলাম, চিনলাম, অনুভব করলাম।

সালটা ১৯৯৭ হবে। ঠিক পুজোর আগেই আমি সবে ‘মিস তিলোত্তমা’ হয়েছি। শুনে সবাই ভাবল— ও মা! আমাদের পাড়ার মেয়ে, ঘরের মেয়ে, রক্তের সম্পর্কের মেয়ে, রোজের দেখা এলেবেলে মেয়ে একেবারে মিস তিলোত্তমা! সবাই খুব হামলে পড়ে টিভিতে তিলোত্তমা কনটেস্ট দেখল। তিলোত্তমা মঞ্চে মুকুট-পরা আমায় দেখল। কাগজে কাগজে আমার ছবি দেখল, দীর্ঘ সাক্ষাৎকার পড়ে মুখস্ত করে ফেলল, ম্যাগাজিনে মলাটজোড়া আমার মুখ দেখল। কেউ অবাক হয়ে অথবা হতাশ হয়ে জানতে পারল— প্রভাত রায় আমাকে ছবির অফার দিয়েছেন! ঋতুপর্ণ ঘোষ ছবির জন্য ডেকেছেন। ব্যস, রাতারাতি আমি সেলিব্রিটি হয়ে গেলাম! সে বছর পাড়ার পুজোয় আমি রানি থেকে মহারানি হয়ে উঠলাম। তখন আমার চার পাশে সব কিছু ভীষণ বদলে যাচ্ছে। না, দেমাক নয়। সেই বছর ব্যস্ততার জন্য পাড়ার প্যান্ডেলে সপ্তমীর আগে যেতে পারিনি। কিন্তু সপ্তমীর দিন সন্ধেবেলা সেজেগুজে প্যান্ডেলে গিয়ে দাঁড়াতেই...কী আশ্চর্য, চার জন চেয়ার নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এল। অথচ আগের বছরেও বসার চেয়ার নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কত কাড়াকাড়ি করেছি। চেয়ারে বসতেই আমাকে সবাই আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, যেন অচেনা কেউ। যারা ঠাকুর দেখতে এসেছিল, আঙুল তুলে এ ওকে দেখাতে লাগল, ‘‘ওই যে...ওই যে, ওই দিকে...লাল শাড়ি...তিলোত্তমা!’’ আমার তখন অস্বস্তি লাগছে। লজ্জা লাগছে। ভাল লাগছে। অচেনা অনেকে যেচে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করল। অভিনন্দন জানাল। কত আশীর্বাদ করল। আবার খুব চেনা কাছের মানুষও ইচ্ছে করে আমাকে এড়িয়ে দূরে সরে গেল। তখন সব কিছু বদলে যাচ্ছে, ভীষণ বদলে যাচ্ছে!

সেই আশ্চর্য বদলের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে অনেকগুলো বছর পার করে ফেলেছি। সেই বদল কখন একটু একটু করে বদলে দিয়েছে আমাকেও। আমি আজও আশ্বিন ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। যেতে যেতে গাড়ির ভিতর থেকে প্যান্ডেলে পেরেক ঠোকার শব্দ শুনি। বাঁশের গা রঙিন কাপড়ে মুড়ে যাচ্ছে দেখি। আধো ঘুমে মহালয়া শুনি। ঢাকের বাজনা শুনি। ‘দুগ্গা মাঈকী জয়’ শুনি। কিন্তু বুকের ভিতর সেই দামালপনা কই! আমি জানি, বয়সের গভীরতায় ঢেউ কম থাকে। আমি জানি, পর পর দাঁড়িয়ে আছে দামাল হৃদয়। আমার পর আরও কেউ, তারও পর আবার কেউ। আশ্বিনের কোল খালি থাকে না। শুধু জানতে ইচ্ছে করে আমার বয়ঃসন্ধির সেই দুর্গাপুজোর কাছে— আমাকে কখনও তার মনে পড়ে কি?

অলঙ্করণ: সুমন চৌধুরী।

Arpita Chatterjee Bengali Actress অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy