Advertisement
১৯ মে ২০২৪

কাঁথা পালটাব না

সন্তান চাই না: বললেই সেই মেয়ের দিকে সমাজ এমন করে তাকায় যেন ভয়াবহ ডাইনি। তাকে বলা হয় ‘স্বার্থপর’, ‘সংসারভাঙানি’। এই হিসেব কিন্তু অনেকেই উলটে দিয়েছেন। সঞ্চারী মুখোপাধ্যায়সে ভারী বেয়াড়া, বেয়াদপ, উচ্ছৃঙ্খল, না-মেয়েলি এবং অপূর্ণ তো অবশ্যই। কিঁউ কি, সে বাচ্চা চায় না। কী!!! সে কি আদৌ নারী? না সমাজের মতে পাপিষ্ঠা, উড়ুক্কু, স্বার্থপর, এবং ফিসফিসিয়ে ‘বাঁজা আসলে’।

শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

সে ভারী বেয়াড়া, বেয়াদপ, উচ্ছৃঙ্খল, না-মেয়েলি এবং অপূর্ণ তো অবশ্যই। কিঁউ কি, সে বাচ্চা চায় না।

কী!!! সে কি আদৌ নারী?

না সমাজের মতে পাপিষ্ঠা, উড়ুক্কু, স্বার্থপর, এবং ফিসফিসিয়ে ‘বাঁজা আসলে’।

আজ্ঞে, হ্যা।ঁ সে সব মেয়েদের কথাই বলছি, যারা স্বেচ্ছায় বাচ্চা চায় না। মানে নিজের বাচ্চা চায় না, গর্ভধারিণী হতে চায় না, ন’মাসের সুখ-যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে চায় না, কাঁথা পালটানো আর পটি পরিষ্কারের মধ্যে নিজের পূর্ণতা খোঁজে না, নিজের স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে নিয়ত গুমরে মরতে চায় না, কিছু বছর পর কেরিয়ারে কিছু হল না বলে স্বামীকে দোষারোপ করে ডাবল-ডিপ্রেশনে যেতে চায় না এবং বাচ্চার ওপর অহেতুক নিজের ফ্রাসট্রেশন ফলায় না। এরা অন্য গোত্রের। নিজের ফুরফুরে অস্তিত্বের পিয়াসি। নারী হওয়ার চরম মানে এদের কাছে মাতৃত্বের আশীর্বাদ নয়।

তার মানে কি ওরা ভারী খারাপ? না বোধহয়। সব ছেলে যেমন এক রকম নয়, তেমনি সব মেয়েও এক রকম নয়। অনেক ছেলে নিজের ইচ্ছেয় ঘরের কাজ করে, রান্না করতে ভালবাসে, বউকে সাহায্য করতে ভালবাসে। তেমনি অনেক মেয়েও বাড়ির কাজ করতে ভালবাসে না, রান্না করতে তাদের জঘন্য লাগে আর বাচ্চা বিয়োতে চায় না। মানে যা যা কাজ তার জন্য বরাদ্দ, সেগুলো করতে তার মন ওঠে না, বরং অনেক অন্য কাজে তাকে পেয়ে বসে। যেমন ধরুন দেশ বেড়ানো কিংবা বই লেখা কিংবা প্রধানমন্ত্রী হওয়া বা নিতান্তই ফেলে-ছড়িয়ে আলস্যে জীবন বাঁচা।

এ জন্য তাদের কি কম খোঁচা খেতে হয়? মোটেও না। খোঁচা বরং অনেক বেশি।

‘কী রে, তুই কি অ্যাবনর্মাল? বাচ্চা চাস না? এ রকম একটা আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখবি? জানিস এই ছোট্ট মুঠো খিলখিল হাসি কত আনন্দের, কত আকর্ষণের?’ কিংবা, ‘তোর নিজের হল না মানেই তো জীবন শেষ নয়। একটা দত্তক নে। শেষ বয়সে কে দেখবে?’ অথবা, ‘তুই না একটা মেয়ে, নিজের নারীত্বের অপমান করবি?’ এ সব খুব কমন দোষারোপ তাদের প্রতি। অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড-এর উদ্দেশ্যে লিবারাল দলের সেনেটর বিল হেফারনন বলেন, জুলিয়া প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য নন, কারণ উনি ‘ডেলিবারেটলি ব্যারেন’, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় সন্তান ধারণ করতে চান না। অপমান, কটূক্তি এবং নারীবিরোধী আক্রমণ এখানেই শেষ নয়। ডেভিড ফারলে, অস্ট্রেলিয়ান এগ্রিকালচার সংস্থার সিইও, জুলিয়াকে বলেন, ‘সন্তানধারণে অক্ষম এক জন বয়স্ক গাভী’। জুলিয়া ঠিক করে প্রধানমন্ত্রিত্ব করতে পারলেন কি না, রাজনৈতিক ভাবে সফল না অসফল এ সবের চেয়ে অনেক বড় হয়ে উঠল, তিনি ‘মা’ কি না। আমেরিকানিবাসী ডমিনিকান রিপাবলিক-এর লেখিকা হেরালদিন এস্তেভেস তাঁর একটি লেখায় লিখেছেন, ‘সবাই আমায় বলেছিল সন্তান না থাকলে জীবন অপূর্ণ হয়। কিন্তু আমি মানতে রাজি হইনি। সন্তান হলে মনে হয় মিরাক্ল হল, হয়তো সত্যি। কিন্তু আমি সন্তান চাই না। এই কারণে আমার সঙ্গে আমার বয়ফ্রেন্ডের সম্পর্ক ভেঙে গেল। মায়ের বন্ধু বলেছিল বাচ্চারা ঈশ্বরের আশীর্বাদ। নিশ্চয়ই। বাচ্চারা আমার চার পাশে থাকলে আমার মন দারুণ ভাল হয়ে যায়। কিন্তু আমি নিজের বাচ্চা চাই না। আমি স্বার্থপর? হয়তো। কিন্তু বাচ্চারা যেমন ভাল, তেমনি বাচ্চা মানুষ করা একটা বিরাট দায়িত্বের ব্যাপার। আমি সেই দায়িত্ব নিতে রাজি নই। আমি সমাজের নিয়মের বা চিরাচরিত প্রথার কাছে মাথা নোয়াব না। আমার জীবন আমারই। আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই।’ অস্ট্রেলিয়ারই অন্য এক জন লেখিকা ললি বার লিখেছেন, ‘নিজের জীবন বাঁচতে বাঁচতে যখন আমার চল্লিশ হল, তখন দেখলাম আমার সব বন্ধু হয় মা হয়ে গেছে, নয়তো সন্তানসম্ভবা। আমার কেমন মনে হল, সারা পৃথিবী বেড়িয়ে, দুটো নভেল লিখে, ভারতে নির্বাণ অভ্যেস করে, লন্ডনে তুমুল পার্টি করে কি আমার জীবনটা বিসর্জন দিলাম? খুব ডিপ্রেস্ড লাগছিল। মাকে গিয়ে দোষ দিলাম। তুমি কেন আমায় বললে না সেট্ল করতে? মা-ই আমার জীবনটাকে আরও এক বার আলো করে দিল। বলল, তুমি নভেল লিখবে, দেশ বেড়াবে, তোমার মতো করে থাকবে, এটাই তোমার ডেসটিনি। অন্যের মতো সংসার করে বাচ্চা নিয়ে লেপটে থাকাটা তোমার জন্য নয়। আমার কী হালকা লাগল বলে বোঝাতে পারব না। আমি ফিরে গেলাম আমার জীবনে। অবশ্য এর পরেও এক জন আমায় বলেছিলেন যে আমার মতো সুন্দরী মহিলার বিয়ে না হওয়া আর বাচ্চা না হওয়া কত বড় ট্র্যাজেডি। আমার কাছে যেটা মুক্তি, সেটা ওঁর মনে হয়েছিল, ট্র্যাজেডি।’

এ রকম অনেক অনেক মেয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছেন। যেমন ধরুন, ওপ্রা উইনফ্রে, ক্যামেরন ডিয়াজ, সান্ড্রা বুলক, এমনকী বলিউডের অভিনেত্রী করিনা কপূরও। ওপ্রা তো বলেইছেন যে, ‘আমার বাচ্চা থাকলে, আমি যে জীবনটা চেয়েছিলাম, সেটা পেতাম না।’ আবার করিনা বলেছেন, ‘আমি আর সইফ টিপিক্যাল ভারতীয় স্বামী-স্ত্রী’র মতো নই। সইফ-এর দুটো বাচ্চা রয়েছে। আর হতেই পারে যে আমি আর সইফ বাচ্চা চাইলামই না।’ আচ্ছা, এতে কি ওঁদের সাফল্যে দাগ লেগে গেল? আসলে মুশকিলটা হল, সক্কলের ‘সার্থকতা’র ছকটা আমরা ঠিক করে রেখেছি। সেই গৎ থেকে বেরিয়ে, নিজের মতো করে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা আমরা কাউকে দিই না। মেজরিটির মতো করেই স্বাধীন হও এই পরাধীনতাটা গোটা সমাজের ওপর চাপিয়ে আমরা দিব্যি নিজেদের শেকলের কড়াগুলোয় হাত বোলাই। অথচ ‘আমি বাচ্চা চাই’, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার এক জন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের যতটা, ‘আমি বাচ্চা চাই না’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও ঠিক ততটাই। কিন্তু কে বুঝছে? কেউ যদি বলে, ‘আমি তো বলিনি যে আমি বাচ্চা ভালবাসি না, কিন্তু আমার সারা জীবন আটকে যেতে ভয় করে, আমার স্বপ্নগুলো যদি পূরণ না করতে পারি, তা হলে শেষ বয়সে নিজেকে কী উত্তর দেব?’ আমরা বলব, কীসের উত্তর? সংসার-ধর্ম পালন করেছ, নারীত্বের সংজ্ঞা মেনেছ, আবার কী চাই?

আবার এমনও হতেই পারে, কেউ বলল, ‘আমি দু-মিনিটের বেশি কোনও বাচ্চা সহ্য করতে পারি না।’ তা হলে সেই মতটাকেও গ্রাহ্য করতে হবে। কারণ এটা তার জীবন। সে তার জীবন নিয়ে কী করবে, সেটা স্রেফ তার সিদ্ধান্ত। কিন্তু আমরা ঘোর রক্ষণশীলরা এই নিজস্বতাকে কিছুতেই মেনে নেব না। যত ক্ষণ না তাকে সমাজের মিক্সিতে ঘুরিয়ে মখমল মেয়ে-মেয়ে লেই বানিয়ে ফেলব, তার নিস্তার নেই।

কিন্তু এখন অনেক মেয়ে এই ‘নিস্তার’কে লবডঙ্কা দেখিয়ে নিজের জীবন বাঁচছে। নারী হিসেবে তারা কিছু কমতি নয়। এই মেয়ে নিজেকে সম্মান করে, নিজের ইচ্ছের মূল্য দেয়, নিজের সিদ্ধান্তের দায়িত্ব নেয়। আসলে সে মাতৃত্বকে দেখেছে একটা ‘অপশন’ হিসেবে, ‘কম্পালশন’ হিসেবে নয়। সে মনে করে নারীত্বের সার্থকতা ‘নিজত্বে’, কেবল ‘মাতৃত্বে’ নয়। অতএব সে অপূর্ণ নয়, বেয়াদপ নয়, উচ্ছৃঙ্খল নয়। সে সাহসী, সে নিজের সিদ্ধান্ত গ্রহণে পিছপা হয় না, আর সেই সিদ্ধান্ত ভুল হলে সেই দায়ও নিজেই কাঁধে করে বেড়ায়, এমনকী সে বাচ্চা ধারণ করে গর্ভপাতও করাতে পারে। তাদের কলজে আসলে অন্য রকম ধুকপুক দিয়ে তৈরি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

sanchari mukhopadhyay sanchari independence day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE