Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

জন্মদিনের পোশাকই সেরা

জামাকাপড় পরে থাকতেই হবে, এই ফরমান কেন মানব? বহু দিন চলছে ন্যুডিস্ট আন্দোলন। মূলত হাসাহাসি ও যৌন ফ্যান্টাসির জন্ম দিলেও, এখন কিন্তু বিদেশে রিসর্ট বা বিচ লিখছে ‘ক্লোদিং অপশনাল’।সেটা ১৯২০-র দশক। সদ্য একটা বিশ্বযুদ্ধের আঁচে ঝলসে উঠেছে পশ্চিমি দুনিয়া। সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া। সব ধারণারই ভাঙচুর চলেছে। জার্মানিতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল এক আন্দোলন। ন্যুডিস্ট মুভমেন্ট। ‘ফ্রি বডি কালচার’-এর মধ্যে দিয়ে গোড়াপত্তনটা হয়েছিল আগেই। বলা হল, নগ্ন দেহ মোটেই লজ্জার জিনিস নয়। এর জন্য কোনও সংরক্ষিত এলাকা বা আলাদা সমুদ্রসৈকতের প্রয়োজনই বা হবে কেন?

বাবা চললেন ছেলেকে নিয়ে ন্যুডিস্ট ক্যাম্পে। সিনেমা: সন্স অব নরওয়ে।

বাবা চললেন ছেলেকে নিয়ে ন্যুডিস্ট ক্যাম্পে। সিনেমা: সন্স অব নরওয়ে।

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৫ অগস্ট ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

সেটা ১৯২০-র দশক। সদ্য একটা বিশ্বযুদ্ধের আঁচে ঝলসে উঠেছে পশ্চিমি দুনিয়া। সব কিছুতেই পরিবর্তনের ছোঁয়া। সব ধারণারই ভাঙচুর চলেছে। জার্মানিতে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে লাগল এক আন্দোলন। ন্যুডিস্ট মুভমেন্ট। ‘ফ্রি বডি কালচার’-এর মধ্যে দিয়ে গোড়াপত্তনটা হয়েছিল আগেই। বলা হল, নগ্ন দেহ মোটেই লজ্জার জিনিস নয়। এর জন্য কোনও সংরক্ষিত এলাকা বা আলাদা সমুদ্রসৈকতের প্রয়োজনই বা হবে কেন? উনিশ শতকের একেবারে শেষের দিকে এসেন-এ প্রতিষ্ঠিত হল প্রথম ‘ফ্রি বডি কালচার ক্লাব’। আর ১৯২০ সালে জার্মানি উপহার পেল তার প্রথম ন্যুড বিচ। কিন্তু তখন জার্মানির রাজনীতিতে দুরন্ত গতিতে উঠে আসছেন অ্যাডল্ফ হিটলার। তড়িঘড়ি ধামাচাপা পড়ল ন্যুডিস্ট আন্দোলন। কিন্তু হারিয়ে গেল না। আস্তে আস্তে ডালপালা মেলল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কানাডায়। আরও কিছু পরে, ষাটের দশকে সারা পৃথিবীর পাশাপাশি বাঙালিও পরিচিত হবে একটা নামের সঙ্গে ন্যুডিস্ট কলোনি।

‘কলোনি’ শব্দটা ব্যবহার করার রেওয়াজ অবশ্য এখন আর নেই। এতে কেমন যেন একটা কর্তৃত্ববাদ, সাম্রাজ্যবাদ-মার্কা গন্ধ। ‘ন্যুডিস্ট’-এর পাশাপাশি বসেছে আরও এক নতুন শব্দ, ‘নেচারিস্ট’। মার্কিন মুলুকে এদের একই অর্থ। কিন্তু ব্রিটেনে একটা পরিষ্কার দাগ টানা আছে দুইয়ের মধ্যে। ‘ন্যুডিজম’ মানে নগ্ন হওয়া ও থাকা। আর ‘নেচারিজম’ নগ্নতার সঙ্গে সঙ্গে আরও কিছু অনুষঙ্গ জুড়ে এক ভিন্ন জীবনচর্যা। সেখানে প্রকৃতির শরণ নেওয়া, অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, স্বাস্থ্যকর খাওয়া, ধূমপান না-করা, যোগাসন: এগুলোরও ভূমিকা আছে।

কিন্তু প্রধান কথাটা একই: পোশাক বর্জনের অধিকার। এই দাবির সূত্রে ইংল্যান্ডের বাসিন্দা স্টিফেন গফ একটা ভারী গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছিলেন। জন্মেছি নগ্ন হয়ে, মরবও অমনি অবস্থায়। তবে মাঝের সময়টুকুতে অনর্থক গায়ে পোশাক চড়ানো কেন? নিজেও তিনি গত এক দশক জামাকাপড়ের ধার মাড়াননি। নগ্ন হয়েই ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা স্কটল্যান্ড-ইংল্যান্ড।

কিন্তু অধিকাংশ মানুষের কাছে, রাষ্ট্রের কাছেও, এ একটা অ-সভ্য দাবি। খোলা গা দেখানোর স্বাধীনতা চাইবে আবার কী! ওখানেই যে যাবতীয় কামনা আর যৌনতার চিহ্নগুলো জ্বলজ্বল করছে। সব কিছুকে উন্মুক্ত করে গুচ্ছের লোকের মাঝে ঘুরে বেড়ানোকে বদ্ধ পাগলামি বলে কিছুটা ছাড় দেওয়া যেতে পারে, চাট্টি অবজ্ঞা ছুড়ে দেওয়া যেতে পারে, নিষিদ্ধ দৃশ্যটুকুর দিকে অপাঙ্গে এক ঝলক তাকানোও যেতে পারে। কিন্তু এমন দাবিকে সমর্থন? কিছুতেই না। সুতরাং, এল শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্ন, জুড়ল আইনকানুন। আর স্টিফেন গফের মতো মানুষকে ঢুকতে হল জেলে, দিতে হল মোটা জরিমানা।

পাবলিক ন্যুডিটির সমর্থকদের লড়াইটা শুরু এই মানসিকতারই বিরুদ্ধে। নিজের ইচ্ছেমত পোশাকে শরীর সাজানোর অধিকার যদি আমাদের থাকতে পারে, তা হলে নিজের ইচ্ছেমত শরীরকে উন্মুক্ত করার অধিকার কেন থাকবে না? ‘মানুষ যখন নগ্ন থাকে, তখন তাদের ভাবনাচিন্তা আর অনুভূতিওয়ালা মানুষ হিসেবে দেখা সহজ। মানুষ অপূর্ব এক জিনিস, আর নিজের মনুষ্যত্বকে লুকিয়ে রাখাটা একদম উচিত নয়’, বলেছিলেন ভিনসেন্ট বেথেল। ১৯৯৯ সাল নাগাদ ব্রিটেনের এই মানুষটি এক ক্যাম্পেন শুরু করেন, ‘দ্য ফ্রিডম টু বি ইয়োরসেল্ফ’। মূল উদ্দেশ্য ছিল, জনসমক্ষে নগ্ন হওয়ার অধিকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আন্দোলনের আর এক পরিচিত মুখ ছিলেন টেরি স্যু ওয়েব। পাবলিক ন্যুডিটির অপরাধে বেথেল-এর মতো তিনিও বহু বার জেলে গিয়েছেন, ছাড়াও পেয়েছেন। এমনকী, বন্দি অবস্থাতেও তিনি হামেশাই পোশাক ছাড়া কাটিয়েছেন। ফল, আরও লম্বা বন্দিজীবন।

অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গের প্রসঙ্গই ধরা যাক। পুরুষরা যত্র-তত্র-সর্বত্র। মেয়েরা ভয়ানক গোপনে, রেখেঢেকে এ রীতি এ দেশেরও, বিদেশেরও। সেই কোন ছোট্টবেলার চেনা ছবি। লোডশেডিং, বেগুনপোড়া গরম সন্ধে। অমনি রোয়াকে বসে পড়ল পাড়া-বেপাড়ার পুরুষের দল। তার পর হাঁটুর ওপর লুঙ্গি আর ঘামে চুপচুপে পাঁজরগোনা অথবা চর্বি থলথলে আ-ঢাকা চামড়ার সারি, সঙ্গে তুমুল আড্ডা। কেউ কখনও এসে শ্লীল-অশ্লীলের প্রশ্ন উচ্চারণ করবে না। এ তো পুরুষের জন্মগত অধিকার, মেয়েদের কেন হতে যাবে?

ওদের তো ঊর্ধ্ব, নিম্ন দুই অঙ্গেই পরতে পরতে যৌনতা মাখানো। সুতরাং যতই তোমরা মেয়েরা বাইরে পা বাড়াও না কেন, এইখানে পুরুষের জুতোয় পা গলানোর অধিকার তোমাদের নেই।

কেন নেই? এই বেখাপ্পা প্রশ্নটাই উঠে এসেছিল পশ্চিমে। আন্দোলনের নাম ‘টপফ্রিডম’। মূল কথা ছিল, পুরুষদের যদি জনসমক্ষে শরীরের ওপর-অংশে কাপড় না জড়ানোর অধিকার থাকে, তা হলে মেয়েদেরও সেই অধিকার দিতে হবে। কেন মেয়েদের ক্ষেত্রেই বা সমাজ অনাবৃত ঊর্ধ্বাঙ্গকে যৌন প্রতীক ভেবে বসে থাকবে? কাজ কিছু হল। ইউরোপের কয়েকটি দেশে সমুদ্রসৈকতে ‘টপলেস সানবাথ’ আর ‘টপলেস সুইমিং’ গ্রাহ্য হল।

সাধারণ মানুষ এই সব আন্দোলন নিয়ে হয় হাসাহাসি করেছেন, নয় বিরক্ত হয়েছেন। ন্যুডিস্টদের গায়ে ছুড়েছেন মানসিক রোগীর তকমাও। অথচ বার বারই ন্যুডিস্টরা দাবি করেছেন, তাঁদের আন্দোলন সম্পূর্ণ মানবাধিকারের প্রশ্নে। এর সঙ্গে প্রকাশ্য যৌনতার সম্পর্ক নেই। তাঁরা শুধুমাত্র চান, মানুষদের অধিকার থাকবে রাস্তা দিয়ে নগ্ন হয়ে হাঁটার। এক জন পোশাকওয়ালা মানুষ যে যে অধিকার পায়, এক জন নগ্ন মানুষের ঠিক সেই অধিকারগুলো যেন থাকে।

রাষ্ট্রের সুরও সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা কিছু নয়। ‘বিকৃতি’ বলেই ব্যাপারটাকে দাগিয়ে দেওয়া গিয়েছে মোটের ওপর। ফলে এই ‘উদ্ভট’ স্বাধীনতার দাবি কখনও বিপ্লব হয়ে উঠতে পারেনি। তবে সব আগুনেরই আঁচ কোথাও না কোথাও টের পাওয়া যায়। পশ্চিমে একটা ধারণা বেশ কিছু দিন ধরেই জনপ্রিয়: ‘ক্লোদিং অপশনাল’। এ ধারণাকে ঘিরেই তৈরি হয়েছে বিচ, রিসর্ট, ভিলেজ। এর মানে, সীমিত পরিসরে অবাধ নগ্নতার ছাড়পত্র। ইচ্ছে করলে যে কেউ যখন খুশি পোশাক খুলে স্বাধীন ভাবে চলাফেরা করতে পারে, কোনও রকম আইনি ঝঞ্ঝাট ছাড়াই। তবে এ সবই একটা ঘেরাটোপে আটকা। যে অর্থে বেথেল বা গফ-রা স্বাধীনতা চেয়ে এসেছেন, যাবতীয় কেন-যদি-কিন্তু-তবে ছাড়া, তেমনটা সব দেশে গ্রাহ্য হয়নি।

সভ্যতা হয়তো সব স্বাধীনতা স্বীকার করে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

poulomi das chattopadhyay independence day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE