Advertisement
১০ মে ২০২৪

জয়যাত্রা

ফিল্মের গান নিয়েই লোকে আজকাল কথা বলে বেশি। গানের অ্যালবাম নিয়ে নয়। বললেন জয় সরকার। মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়এ বছর শ্রীকান্ত আচার্য আর শ্রীজাত, এক সঙ্গে বাংলা গজলের অ্যালবাম করছেন জয় সরকার। ‘মুসাফিরানা পার্ট টু’ বলতে পারেন। তবে অবশ্যই নামটা অন্য হবে। বাংলা গজল কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা একটা রাস্তা যেটা ফিল্ম মিউজিকে কেউ কখনও ভাবেওনি। মনোময় আর শুভমিতার সঙ্গেও অ্যালবাম করছেন জয়।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:৩০
Share: Save:

লোপামুদ্রা মিত্রর ছায়া থেকে বেরিয়ে জয় সরকার আজ সেলিব্রিটি। এটা কেমন করে হল?

আমি কিন্তু সারাটা জীবন লোপামুদ্রা মিত্রর ছায়াতেই থাকতে চাই। আমার প্রথম গান রেকর্ড করেছে লোপা। তার পর শ্রীকান্ত আচার্যর সঙ্গে আমি কাজ করতে আরম্ভ করি। শ্রীকান্ত আচার্য আর লোপামুদ্রা মিত্রর সাঙ্গীতিক প্রশ্রয়েই আমি কেরিয়ার শুরু করি।

কিন্তু তা সত্ত্বেও একক পরিচিতি পেতে এত দেরি হল কেন?

ইন্দ্রাণী সেন, হৈমন্তী শুক্লা, শ্রেয়া, মনোময় সকলের সঙ্গেই তো অ্যালবামে কাজ করেছি। শ্রীকান্ত আচার্যর ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ লোপামুদ্রার ‘যাও পাখি’ হিট হওয়ার পরে আমার কাজ পাওয়া বেড়েছিল। কিন্তু সকলেই তখন গায়ক-গায়িকার অ্যালবাম হিসেবে গানটাকে বুঝতেন, চিনতেন। সুরকারদের তখন জায়গা ছিল না। তাই আমার একক পরিচিতিও সে অর্থে ছিল না।

জয় সরকারের একক স্বীকৃতির সূচনা তা হলে রিংগোর ছবি দিয়ে?

হ্যাঁ, ওঁর ‘যদি একদিন’-এ প্রথম ব্রেক পাই। তার পর একের পর এক ছবির কাজ। রিয়্যালিটি শো-তে রোজ হাজির হয়ে সাধারণ মানুষের কাছেও ঘরের ছেলে হিসেবে পৌঁছে গেলাম।

রিয়্যালিটি শো কি আরও কাজ পেতে সাহায্য করল?

একেবারেই না। আমি বরাবরই কাজ করেই কাজ পেয়েছি। পিআর করাও পছন্দ করি না। আর, কেউ আমাকে একটু সুযোগ দিন বললেও গান গাইতে দিই না।

‘দেখেছ কি তাকে’ গানটি লোপামুদ্রা মিত্রকে না দিয়ে শুভমিতাকে দিয়ে রেকর্ড করিয়েছিলেন কেন?

ওই গানটা লোপার খুব পছন্দের গান। ও গাইতেও চেয়েছিল। তবে যে বছর গানটা তৈরি হয়, সে বছর লোপার অ্যালবামের সঙ্গে ওই গানটা ম্যাচ করেনি। পরে শুভমিতা এই গানটা গেয়ে শোনালে আমি ওকে দিয়েই রেকর্ড করাই।

কিন্তু গান বাঁচাতে ঘর সামলালেন কী করে?

লোপা রেগে গিয়েছিল। ঝগড়াও হয়েছিল। কিন্তু ও পরে বলেছিল ওটা শুভমিতার গলায় ‘আমাদের গান’। আসলে গান যা দাবি করে, আমরা সেটাই করি। তাই আলাদা করে ঘর সামলাতে হয় না।

কিন্তু লোপামুদ্রার পুরুষ ফ্যানেদের কেমন করে সামলান?

ধুর! আমি তো চাই পুরুষ ফ্যানদের সঙ্গে লোপা একটুআধটু প্রেম করুক। সেটা আর হল কই?

কেন? তাতে আপনার প্রেমের কোনও সুবিধে হবে বলে মনে হয়?

বুদ্ধিমতী মহিলাদের সঙ্গে আমি কথা বলতে ভালইবাসি। কিন্তু কেউ প্রেমে হাবুডুবু খেলে, তখন তার ফোনটা লোপাকে ধরিয়ে দিই।

দু’দুটো বড় রিয়্যালিটি শো-এর বিচারক আপনি। রিয়্যালিটি শো কি পেশাদার গায়ক তৈরি করে দেয়?

রিয়েলিটি শো-এর ছেলেমেয়েরা স্টেজ-ফ্রি হয়ে যায়। নানা ধারার গানও গাইতে পারে। রিয়্যালিটি শো-শেষ হওয়ার পরই জীবনের আসলে রিয়্যালিটি শোয়ের লড়াই আরম্ভ হয়।

অভিভাবকদের ভূমিকাটা রিয়্যালিটি শো-য়ের ক্ষেত্রে কতটা জরুরি?

সবচেয়ে জরুরি। টাকার খাতিরে ছেলেমেয়েদের দিয়ে একের পর এক অনুষ্ঠান করার পরিকল্পনা অভিভাবকরা বন্ধ করুন। শ্রেয়া ঘোষালের বাবা অল্প বয়সে প্রচুর অফার সত্ত্বেও শ্রেয়াকে দিয়ে ক্রমাগত অনুষ্ঠান করিয়ে যাননি। পুরো তৈরি হয়ে মাঠে না নামলে দিগ্ভ্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রচুর।

রিয়্যালিটি শো-এর আনকোরা প্রতিভাকে আপনি কাজে লাগান?

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগেই শোভনকে ‘হাফ সিরিয়াস’ আর কুশলকে ‘দ্য প্লে’-তে গাইয়েছি আমি। অন্বেষা খুব সিরিয়াসলি গানটাকে নিচ্ছে। তবে ওর নিজস্ব গানের জনপ্রিয়তা দরকার।

এখন তো ডিস্কে ছয়-আট বিটের বাংলা গানের চল!

এই বিট কিন্তু নতুন নয়। ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ বা ভূমি’র ‘তোমার দেখা নাই’ও ছয়-আট বিটেরই গান। এই চলনটা আসলে ফোক মিউজিকেরই অঙ্গ। যা মানুষের মনকে সহজে ছুঁয়ে যায়। কিন্তু ক্রমাগত এই গান বেজেই চলেছে, এটা কিন্তু নেওয়া যায় না।

সত্যিই কি সকলে নাচেন?

অত নাচলে আজও রবীন্দ্রনাথের গানের সিডি সবচেয়ে বেশি বিক্রি হত না, বা ডাউনলোড হত না।

শ্রোতাদের আন্ডারএস্টিমেট করা হচ্ছে?

ঠিক তাই। মেলোডির জায়গা আজীবন থাকবে। মাস আর ক্লাস দুটোকে ব্যালান্স করে চলতে হবে।

ইদানীং এই মাস আর ক্লাসের সার্থক ছায়া আপনি কার মধ্যে খুঁজে পান?

গুলজার। যিনি ‘বিড়ি জ্বলাইলে’-ও লিখতে পারেন আবার ‘মেরা কুছ সামান’ সৃষ্টি করতে পারেন। এখনকার গানকে বাজারে হিট না করিয়ে মানুষের হৃদয়ে হিট করাতে হবে। এটাই আসল।

সুরকার হিসেবে ররবীন্দ্রসঙ্গীত কতটা আধুনিক বলে মনে হয়?

রবীন্দ্রনাথের মতো আধুনিক মানুষ কেউ নেই। আদৌ হবে কি না, জানি না। তাঁর গানও আধুনিক। যে কোনও অনুভূতির সঙ্গে যায়।

কিন্তু হাওয়া-বদলের সঙ্গে এই গানের খানিক বদল নিশ্চয়ই চলতে পারে?

উপস্থাপনায় যন্ত্রানুষঙ্গে পরিবর্তন আনাই যায়। বটগাছকে বনসাই করে রাখা যায় না। কিন্তু কথা-সুর পাল্টে খরবরদারি না করাই ভাল। রবীন্দ্রনাথের কাজ করতে হলে রবীন্দ্রনাথের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। আমি রবীন্দ্রনাথকে আমার কন্টেম্পোরারি ইন্ডাস্ট্রির একজন সহকর্মী ভাবি।

‘জাতিস্মর’-এ কবীর সুমনকে অ্যাসিস্ট করলেন না কেন?

সৃজিত বলেছিল আমাকে কাজটা করতে। কিন্তু তখন ‘হাফ সিরিয়াস’, ‘রূপকথা নয়’-এর শ্যুট চলছিল। ‘অলীক সুখ’-এর ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করছিলাম। তার সঙ্গে রিয়্যালিটি শো! কী করে করতাম?

আফসোস হয়নি?

না, তবে কবীর সুমনের সঙ্গে কাজ করা হল না। আসলে আমার মনে হয় যার যেটা করার, সে এখন ইন্ডাস্ট্রিতে সেটাই করছে।

মানে আপনার কোনও ক্ষোভ নেই?

নাহ্, আছে। আজকাল ফিল্মের গান নিয়ে প্রচুর কথা হয়। গানের অ্যালবাম নিয়ে কম কথা হয়। এটা কেন হবে?

কিন্তু গত বছর তো আপনি অ্যালবাম নিয়ে কাজ করেননি?

ব্যস্ততায় হয়ে ওঠেনি। তবে এ বছর আমি, শ্রীকান্ত আচার্য আর শ্রীজাত, এক সঙ্গে বাংলা গজলের অ্যালবাম করছি। ‘মুসাফিরানা পার্ট টু’ বলতে পারেন। তবে অবশ্যই নামটা অন্য হবে। বাংলা গজল কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা একটা রাস্তা যেটা ফিল্ম মিউজিকে কেউ কখনও ভাবেওনি। এর সঙ্গে মনোময় আর শুভমিতার অ্যালবাম করছি।

কিন্তু আজও ফিল্মের গানের প্রেক্ষিতেই গায়ক বা সুরকারের রেটিং ঠিক করা হয়। এটা কেন?

এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। আমি চাই না ফিল্ম মিউজিকের গানের নিরিখে আমায় কেউ রেট করুক। ফিল্মের প্রমোশনটাই তো গানের মধ্য দিয়ে হয়। সেখানে গানের জন্যে বাজেটও অনেক বেশি। অডিয়ো অ্যালবামের সেই বাজেট নেই। তাই পরিচিতিও কম। এ ক্ষেত্রে রেডিয়ো স্টেশনকে আরও অ্যাক্টিভ হতে হবে। আর ইন্টারনেট থেকে রেভেনিউ কালেক্ট করার কথা ভাবতে হবে।

নতুন প্রতিভাদের কী হবে?

নতুন ট্যালেন্টের এখানে সত্যি জায়গা নেই। প্রচুর ছেলেমেয়ে দিগ্ভ্রান্ত। লোপামুদ্রা নিজের মিউজিক কোম্পানি করেছে। ও কিন্তু আমাদের পথ দেখিয়েছে। নিজের কাজের দায়িত্ব শিল্পীদেরও নিতে হবে। সবটাই রেকর্ডিং কোম্পানির ওপর নির্ভর করলে হবে না। নিজে কোম্পানি করে নতুন গান, নতুন কণ্ঠকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে হবে।

ফিল্ম ছাড়া অ্যালবামের গানেও তা হলে জনপ্রিয়তা পাওয়া যেতে পারে?

বাংলা গানের ঐতিহ্যই তাই বলছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে সলিল চৌধুরী, কবীর সুমন থেকে নচিকেতা সবটাই তো নিজস্ব গানের ধারা থেকেই এসেছে। এগুলো কি ফিল্মের গান? সেই ধারাটা ফিরিয়ে আনতে হবে। শুধু ফিল্মের গান গাইলে দম ফুরিয়ে আসবে।

কিন্তু মুম্বইতে তো ফিল্মের গানেরই দাপট!

সেটা ঠিকই। কিন্তু সেখান থেকেও শিল্পীরা বেরিয়ে এসে স্বাধীন ভাবে কাজ করতে চাইছেন। নয়তো কোক স্টুডিয়ো বা এমটিভি আনপ্লাগ-এর মতো অনুষ্ঠান জনপ্রিয় হত না। এই সব অনুষ্ঠানে অনেক সময়ই অ্যালবামের গান হয়।

অ্যালবাম ছাড়াও আর কী কাজ করছেন?

বাংলাদেশের জন্য ‘বাদী বান্দার রূপকথা’ অবলম্বনে আলিবাবার একটা মাল্টিমিডিয়া প্রোডাকশনে কাজ করছি। নচিকেতা, শ্রীকান্ত আচার্য, লোপামুদ্রা, অন্বেষা, মনোময় সবাই গান গাইবে। সুকল্যাণ ভট্টাচার্য পরিচালনা করছেন। ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের মূল আলিবাবার গান, মর্জিনা আবদাল্লার গান, আর আমার গান থাকছে এতে।

এখনকার কোন সঙ্গীত পরিচালকের কাজ শুনতে ভাল লাগছে?

অমিত ত্রিবেদী। অসাধারণ কাজ করছেন। ফোকটাকে ঠিক মতো ব্যবহার করতে পারেন। বাংলায় শান্তনু মৈত্র। ওঁর ‘অন্তহীন’ ছবির গান বাংলা ছবির গানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।

ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত?

ও প্রচুর কাজ করছে। ওর এবং আমার একসঙ্গেই কাজ শুরু। তবে ও যাই করুক, আজ থেকে বহু বছর আগে শেখর দাস-এর ‘মহুলবনীর সেরেঞ’-এ ওর কাজ এখনও আমার বেস্ট লাগে।

অনুপম রায়?

অনুপম নিজের গানেও জনপ্রিয়, আবার অন্যকে দিয়ে গান গাইয়েও সফল। নীল দত্তের কাজও খুব ভাল। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও অত্যন্ত গুণী সুরকার। বাংলা ছবির গানকে কমার্শিয়ালাইজ করে সমস্ত ক্লাসের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার কৃতিত্বটা ওর। তবে ওকে ইন্ডাস্ট্রি ঠিক ব্যবহার করতে পারেনি।

আপনার মতে এখনকার প্রথম তিন জন গায়ক, গায়িকা কে?

এটা খুবই বলা মুশকিল। তাতে কেউ কেউ হয়তো বা ক্ষুণ্ণ হবেন। লোপামুদ্রার গান ভাল লাগে ওর নিজস্বতার জন্য। শ্রেয়ার আমি গুণগ্রাহী। সোমলতাও ভাল। শ্রীকান্ত আচার্যর সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পাই। রূপঙ্কর আর অরিজিৎ তো বটেই।

আরও আছে, তাই বলতে চাই... তিন জনে কখনওই আজকের ট্যালেন্ট শেষ হয়ে যায় না। ( হাসি)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

joy sarkar music album
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE