Advertisement
E-Paper

নোরা দেখি ‘পথের পাঁচালী’র থিম মিউজিকটা বাজাচ্ছে

আগামী কাল পণ্ডিত রবিশঙ্করের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এরই মধ্যে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অনুষ্কা শঙ্কর খবর পেলেন তাঁর চতুর্থ বার গ্র্যামি মনোনয়নের। পিতৃবিয়োগের ক্ষত থেকে স্বীকৃতির উল্লাস — সব নিয়ে লন্ডন থেকে কথা বললেন তিনি। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।আগামী কাল পণ্ডিত রবিশঙ্করের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এরই মধ্যে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা অনুষ্কা শঙ্কর খবর পেলেন তাঁর চতুর্থ বার গ্র্যামি মনোনয়নের। পিতৃবিয়োগের ক্ষত থেকে স্বীকৃতির উল্লাস — সব নিয়ে লন্ডন থেকে কথা বললেন তিনি। শুনলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত।

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:০০

দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল।

দু’বছর আগে এই সময় পণ্ডিত রবিশঙ্কর নার্সিং হোমে।

কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন। কিন্তু অনুভূতিপ্রবণ মনটা তখনও সতেজ।

মাঝে মধ্যে ঠোঁট কেঁপে উঠত। কিন্তু গলার স্বর সায় দিত না। জামাই জো রাইট এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর হাতে। বলেছিলেন যা মনে হয় তা যেন লিখে ফেলেন। আস্তে, খুব আস্তে, পণ্ডিতজি লিখেছিলেন ‘যা হওয়ার তা হবে।’

এই ঘটনার কিছু মাস আগে অনুষ্কা শঙ্কর কাজ করছিলেন তাঁর অ্যালবাম নিয়ে। অ্যালবামের নাম ‘ট্রেসেস অব ইউ’। এই অ্যালবামই যে পরবর্তী কালে গ্র্যামির জন্য মনোনীত হবে সেটা কোনও ভাবেই তখন জানা সম্ভব ছিল না। তবে যেটা তখনও বেশ বুঝতে পারছিলেন তা হল পণ্ডিতজির শরীরটা ভাল নেই। একদিন অ্যালবামের কাজ করতে গিয়ে হঠাত্‌ই তাঁর প্রযোজক নীতিন স্যনেকে বলেছিলেন যে এমন একটা গান লিখতে চান যার মূর্ছনার মধ্যে থাকবে তাঁর মন ভাল না-থাকার ব্যঞ্জনা। যেখানে বোঝাতে পারবেন যে তাঁর বাবার শরীর ভাল নেই। “ইট ওয়াজ স্টিল ফিউ মান্থস বিফোর হি পাসড অ্যাওয়ে। বাট আই ডিড নট ওয়ান্ট টু বি রিয়েলি ডিরেক্ট অ্যাবাউট ইট,” স্মৃতিচারণ করে বলেন অনুষ্কা।

ঠিক করলেন রবি শব্দটা এমন ভাবে গানে ব্যবহার করবেন যাতে সেটা একটা রূপকের কাজ করে। লিখলেন ‘দ্য সান ওন্ট সেট।’ জানতেন যে ‘রবি’ শব্দটার ইংরেজি তর্জমা করলে হয় ‘সান’। গানের কথার মধ্যে বারবার করে ঘুরে ফিরে দুটো লাইন ব্যবহার করলেন: “দ্য সান ওন্ট সেট/নট নাও, নট ইয়েট।” তার পর লিখলেন: “স্টার্টিং টু গেট কোল্ড/হোল্ডিং অন থ্রু চেঞ্জ/ দ্য ডে গ্রোজ ওল্ড/ আই মিস দ্য মর্নিং হিট/ফল আপঅন মাই ফেস/আই উইশ নিউ ইউ দেন/ ইটস অলওয়েজ সানসেট ইন দিজ প্লেস।” এর কিছু মাস পরেই সূর্যাস্ত হল। পণ্ডিতজির কথায় যা হওয়ার তাই হল।

১১ ডিসেম্বর ২০১২য় পণ্ডিতজি চলে গেলেন। রেখে গেলেন অসংখ্য স্মৃতি, সুরের মূর্ছনা ছাড়াও ওই এক টুকরো কাগজটা।

যে কাগজের ঠিক চারটে শব্দ স্ক্যান করে তা দিয়ে বাঁ হাতে অনুষ্কা একটা ট্যাটু আঁকিয়ে নিলেন। কব্জির ঠিক তলায়। সেতার বাজানোর সময় খুব কাছ থেকে দেখলে যেটা আজও সকলের নজরে পড়ে।

এই দু’ বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গিয়েছে অনুষ্কার জীবনে। চতুর্থ বার গ্র্যামি মনোনয়ন পেলেন সেই ‘ট্রেসেস অব ইউ’ অ্যালবামটার জন্য। তার সঙ্গে দ্বিতীয়বার প্রেগনেন্সির আনন্দ। সবই আছে। নেই সেই আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার জন্য এক জন মানুষ। তাঁর বাপি, তাঁর গুরু।

পণ্ডিতজির দ্বিতীয় মৃত্যু বার্ষিকীতে আলাদা করে কোনও অনুষ্ঠান করছে না শঙ্কর পরিবার। অনুষ্কা নিজে উড়ে যাচ্ছেন ফ্লোরেন্সে। ১৩ ডিসেম্বর সেখানে তাঁর কনসার্ট রয়েছে জুবিন মেটার সঙ্গে।

প্রেগনেন্সির এত অ্যাডভান্স স্টেজে এসেও এ ভাবে কনসার্ট করে যাওয়া সহজ কথা নয়। “প্রেগনেন্সির প্রথম দিকটায় বেশ সমস্যা হয়েছিল। অসুস্থ থাকার জন্য লজ্জাজনক ভাবে কিছু কনসর্ট বাতিলও করে দিয়েছিলাম আমি। কারণ বাচ্চার স্বাস্থ্যই ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে অক্টোবর মাসে আমি লন্ডনে একটা ফেস্টিভ্যাল কিউরেট করেছিলাম। যেটার মূল বিষয় রবীন্দ্রনাথ। এর মধ্যে একটা ক্ল্যাসিকাল অ্যালবামও রেকর্ড করেছি। বাচ্চা হওয়ার আগেই সেটার মিক্সিং সেরে ফেলতে চাই,” লন্ডন থেকে জানান অনুষ্কা।

চার চারটে গ্র্যামি মনোনয়নের পরে যে তিনি উচ্ছ্বসিত হবেন এটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু গ্র্যামি মনোনয়নের খবরটার ঠিক ঘাড়ে ঘাড়েই রয়েছে যে তার বাপির মৃত্যুবার্ষিকীর শোকের ছায়া। ভাললাগার সঙ্গে সঙ্গে তাই মনের ঈশান কোণে কোথাও যেন জমে রয়েছে আরও কিছু অন্য অনুভূতি। “সত্যি দারুণ লাগছে। আমার কাজটা আবার গ্র্যামির মনোনয়ন তালিকায় স্বীকৃতি পেল। আমার ছ’টা সোলো স্টুডিয়ো অ্যালবামের মধ্যে চারটে গ্র্যামি মনোনয়ন পেয়েছে। সত্যি এটা একটা দারুণ ঘটনা। আমি কৃতজ্ঞ,” বলেন অনুষ্কা।


বাবার সঙ্গে দুই কন্যা

তবে এই ভাললাগার মাঝে মাঝে কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠে মন কেমন-করা এক বিষণ্ণতা। জীবনের বিরাট একটা অংশ আজও শূন্যতায় ভরা। এমন এক শূন্যতা যা সব আনন্দকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। কেমন লাগে এমন একটা অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি মনোনয়ন পেতে যার সঙ্গে পণ্ডিতজির একটা আত্মিক যোগাযোগ রয়েছে? “অল অ্যালবামস আর এক্সট্রিমলি পার্সোনাল। সব অ্যালবামই বেশ ব্যক্তিগত। কারণ শিল্পীরা তো নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই অনুপ্রেরণা নিয়ে কাজ করেন। আমার আগের অ্যালবামগুলোর মধ্যেও ব্যক্তিগত অনেক অনুভূতির প্রভাব রয়েছে। আমার রোম্যান্টিক লাইফ, প্রথম প্রেগনেন্সি, জীবনের নানা ওঠাপড়া যা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, এই সব ঘটনাই কোনও না কোনও ভাবে আমার অ্যালবামগুলোর মধ্যে এসেছে,” বলেন অনুষ্কা। তার পর মনে করিয়ে দেন কী ভাবে এই অ্যালবামের একটা গান ‘ট্রেসেস অব ইউ’য়ের ভিডিয়োটা শ্যুটিং করা হয়েছিল কলকাতা সহ বিশ্বের অন্য তিন শহরে। ভিডিয়োর পরিচালক অনুষ্কার স্বামী। অনুষ্কা, নোরা আর নীতিন ছাড়াও এই ভিডিয়োতে দেখা যায় তবলাবাদক তন্ময় বসুকেও।

তবে ভিডিয়ো শ্যুটিং হোক বা গানের রেকর্ডিং, অনুষ্কা স্বীকার করেন গোটা অ্যালবামে কাজ করাটা তাঁর কাছে একটা ক্যাথারসিসের অনুভূতি।

“আই ওয়েন্ট থ্রু দ্য প্রসেস অব লুজিং মাই ফাদার হোয়াইলস্ট মেকিং দ্য অ্যালবাম। অ্যালবামটা করতে করতে বাপিকে হারানোর শোকের মধ্যে দিয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল। তাই এটা বলব যে এই অ্যালবাম তৈরি করাটা আমার কাছে খুব কষ্টের একটা অভিজ্ঞতা। আবার তারই সঙ্গে ক্যাথারসিসও হত। এবং কোথাও এই কাজটা করার মধ্যে দিয়ে আমার হিলিংও হয়েছে। যখনই এটা কেউ শোনেন হয়তো সেটার মধ্যে দিয়েই নিজেদের জীবনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিল খোঁজেন। এই গ্র্যামি মনোনয়নের মধ্যে দিয়েই হোক বা অনুরাগী আর শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া থেকেই হোক, এই অ্যালবামের গানগুলোর জন্য খুব উষ্ণ ফিডব্যাক পেয়েছি,” বলেন অনুষ্কা। আর এই উষ্ণতার কথা বলতে গিয়েই তাঁর মনে পড়ে যায় অ্যালবাম তৈরির নানা ঘটনা। যেমন যে দিন তিনি উড়ে যাচ্ছিলেন নিউ ইয়র্কে, ফ্লাইটে বসেই ‘আনসেড’ গানটার কথাগুলো বেঁধেছিলেন। মাথায় একটা সুরও ভাঁজছিলেন। কিন্তু পরে বোন নোরা জোনস্‌-কে যখন সেই সুরটা শুনিয়েছিলেন, তখন সেটা খানিকটা বেমানান লেগেছিল।

কথাবার্তার মাঝে নোরা তাঁর লেখা বাণীগুলো গুনগুন করতে থাকেন ‘লভ ওয়াজ’নট লেফ্ট আনসেড, থ্যাঙ্ক ইউ দ্যাট ওয়াজ লেফ্ট আনসেড, আই সি ইউ মে বি লেফ্ট আনসেড, আই ডোন্ট নো হোয়াট ওয়াজ সেড’ গুনগুন করতে করতেই বসে পড়েন তাঁর পিয়ানোর সামনে। আপনমনের খেয়ালেই বাজিয়ে ফেলেন অন্য একটা ধুন। সেখান থেকে অদ্ভুত এক কাকতালীয় ঘটনার সূত্রপাত। ধুনটা অনুষ্কার অত্যন্ত পরিচিত। শুধু অনুষ্কা কেন? হয়তো আপামর বাঙালির কাছেই তাই। “শুনেই বুঝলাম নোরা যেটা বাজাচ্ছে, তার আশ্চর্য মিল রয়েছে ‘পথের পাঁচালি’র থিম সঙের সঙ্গে। বহু দশক আগে বাপি সেই সুরটা করেছিলেন। আইকনিক মেলোডির জন্য যা আজও সারা পৃথিবীতে সমাদৃত,” জানান অনুষ্কা। কিন্তু নোরাকে ব্যাপারটা বলতেই আরও একটা আশ্চর্য ঘটনা হয়। নোরা নাকি তত দিন পর্যন্ত ‘পথের পাঁচালি’ দেখেননি! আর ওই থিম মিউজিকটাও কোনও দিন শোনেননি! দু’বোন হতবাক হয়ে যান এই কো-ইনসিডেন্স-এর কথা ভেবে। তার পর নিজেদের সামলে উঠে ভাবেন যে হয়তো এটাই নিয়তি। যা তাঁদের সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে তাঁরা ঠিক পথেই এগোচ্ছেন! একটা সময় ছিল যখন ছিদ্রান্বেষীরা তাঁর প্রতিটি কাজের পিছনেই শুধুমাত্র এটাই বলে আসতেন যে তিনি যা পাচ্ছেন, তার পুরোটাই সম্ভব হচ্ছে বাবার মেয়ে হওয়ার সুবাদে। এই গ্র্যামি মনোনয়নটা কি কোনও ভাবে সেই ছিদ্রান্বেষীদের যোগ্য জবাব হল? “যাঁরা দেখতে চান না, তাঁদের কিছুই এসে যাবে না। আমি আমার কাজে কতটা এফর্ট দিয়েছি, সঙ্গীত সম্পর্কে আমি কতটা সিনসিয়ার, সেটা তো তাঁরা দেখতে চাননি। আমার মনে হয় না তাঁরা এই মনোনয়নের জন্য তাঁদের মত পাল্টাবেন। তাঁরা এখনও বলতেই পারেন যে এটাও হয়েছে আমার পদবির গুণে। তাই আমি সব সময় নিজের জীবন, নিজের কাজেই ফোকাসটা রাখতে চাই। কে কী বলছে, তা নিয়ে আমি সময় নষ্ট করি না। অন্যের চোখে নিজেকে প্রমাণ করাটা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়।”

দু’বছর বাবাকে হারানোর শূন্যতা নিয়ে বেঁচে থাকার পর এ সব ব্যাপার নিয়ে আর চর্চা করতে চান না তিনি। “ভালমন্দ যা কিছুই আমাদের দিকে জীবন ছুড়ে দিচ্ছে, তা মাথা পেতে নেওয়া ছাড়া আমাদের কি আর কোনও উপায় আছে? পিতৃবিয়োগ এক বিশাল ব্যাপার। কোনও কিছু দিয়েই এই শূন্যতাকে ভরানো যায় না। তবু জীবন বয়ে চলে। তার সঙ্গে আমাদেরও এগিয়ে যেতে হয়। আমার সৌভাগ্য বাপি এখনও ওঁর অজস্র রেকর্ডিংয়ের মধ্যে দিয়ে আজও আমার কাছে জীবন্ত। সতেজ। ওঁর সুরের মধ্যে দিয়ে আজও আমি বাপিকে অনুভব করতে পারি।”

সূর্যাস্ত নামেই হয়েছে। রবির কিরণে, সুর-তাল-লয়ের মধ্যে এ রবি আজও জ্বলজ্বল করছেন। হয়তো তাই বলা যায়: ‘দ্য সান হ্যাজন্ট সেট/ নট নাও, নট ইয়েট....’

ananda plus anushka shankar priyanka dasgupta
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy