Advertisement
E-Paper

রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনও দিন আমায় টানেনি

এই রকম নানা বিস্ফোরক কথা বললেন অনুপম রায়। তাঁর মুখোমুখি স্রবন্তী বন্দ্যোপাধ্যায়।এখন বাংলা গান মানে কী? ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ নাকি ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’? ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ একটা ‘কাল্ট’ গান বলা যেতে পারে। যাকে ঘিরে বাঙালির রোমাঞ্চের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। আর ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ কেন লোকের এত ভাল লেগেছিল আমি জানি না!

শেষ আপডেট: ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:০০
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।

এখন বাংলা গান মানে কী? ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ নাকি ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’?

‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’ একটা ‘কাল্ট’ গান বলা যেতে পারে। যাকে ঘিরে বাঙালির রোমাঞ্চের ইতিহাস তৈরি হয়েছিল। আর ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ কেন লোকের এত ভাল লেগেছিল আমি জানি না! তবে বাংলা গান বললে এই দুটো গানই থাকবে। ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’-র ওপর ভিত্তি করেই তো আজকের বাংলা গান লেখা হচ্ছে। তবে আজকের বাংলা গান কিন্তু ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’-তে আর আটকে নেই।

আপনার গানে ‘মেঘের তারায়় ভরা স্টেশন একটু থামতে চায় প্রেমিকের ইন্সপিরেশন!’ বা ‘ভেজা রেলগাড়ি সবুজ ছুঁয়ে ফেলে’ এমন অজস্র দৃশ্য তৈরি করা শব্দেরা চলে আসে। এই বাঁধনছেঁড়া গান কেমন করে লেখেন?

আমি খুব ভিস্যুয়াল পছন্দ করি। এই যে ‘জলফড়িং’ গানটার কথা বললেন। এটা মিয়াজাকি-র অ্যানিমেশন ‘স্পিরিটেড অ্যাওয়ে’ দেখে লেখা। সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে একটা ট্রেন যাচ্ছে... অসাধারণ! ইরানের পরিচালক আব্বাস কিয়ারুস্তামির ছবি দেখলে একটা ভিস্যুয়াল ট্রিট হয়। যার প্রভাব গানে আসে। ঋত্বিক ঘটকের ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ কত বার যে দেখেছি! কত গানে যে সেই দৃশ্যের ছায়া পড়েছে, নিজেও জানি না!

এই যে গান লেখার কথা বলছেন, এটা কি মনে হয় না রবীন্দ্রনাথ-পরবর্তী বাংলা কবিতা যতটা এগিয়েছে বাংলা গান সে ভাবে এগোয়নি?

আমার তো উল্টোটাই মনে হয়। এখনও বাংলা কবিতার কথা বলতে গেলে কিন্তু আমরা সুনীল, শক্তিতে থেমে যাই। সে জায়গায় বাংলা গানের ক্ষেত্রে আমরা সুমন, নচিকেতা, অঞ্জন বলে ‘চন্দ্রবিন্দু’তে চলে আসি। আমার মনে হয় নব্বই দশকের পর থেকে বাংলা গান অনেকটাই এগিয়েছে।

‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’ আজকের প্রজন্মকে তো আত্মকেন্দ্রিক করে দিচ্ছে। যে যা খুশি করছে আর বলছে ‘আমাকে আমার মতো থাকতে দাও’। এটা কি ঠিক হচ্ছে?

দেখুন যে যার মতো করে এই গানটা নিয়েছে। আজকের প্রজন্মের নিশ্চয়ই কোথাও স্পেস দরকার। তাই গানটা এত জনপ্রিয় হয়েছে। তবে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে দেখেছি, অনেক বয়স্ক মানুষও এই গানের অনুরোধ করেন। আসলে সময়, সময় এই গানটাকে গ্রহণ করেছে।

সময় যদি আপনার গানকে গ্রহণই করে তা হলে এ বারের পুজোর অ্যালবাম ‘বাক্যবাগীশ’-এ কেন বলছেন ‘এ সমাজে আমার কোনও জায়গা নেই’? এটা কি হতাশার গান?

একেবারেই না। সমাজটা চোখের সামনে পাল্টাচ্ছে। সেই বদলের ছবি নিয়ে এ বারের অ্যালবাম। ‘বাক্যবাগীশ’ একেবারে কাঠখোট্টা!

মানে প্রেম নেই?

নাহ্ একেবারেই।

সেকী! অনুপম রায় বদলে যাওয়া সমাজে প্রেম দেখতে পাচ্ছেন না! এমনটা হল কী করে?

আরে প্রেম তো থাকেই। পরের অ্যালবামে আসবে না-হয়। এখন একটু ব্রেক।

আপনার জীবনেও কি এখন প্রেম ব্রেক?

নাহ্। প্রেমটাও কিন্তু আমি প্রফেশনালি করি। সারাক্ষণই থাকে। তবে একসঙ্গে অনেক প্রেম চালাতে পারব না! কেউ আমায় ভালবাসে... সেটা কোনও কিছু দিয়েই রিপ্লেস করা যায় না। তবে প্রেম নয়, এ বার কিছু অন্য কথা বলার ছিল।

যেমন?

একটি গান আছে ‘বাবুরে’। কী কারণে একজন মানুষ বাবু হয়ে ওঠে? স্যালারি, ইএমআই ঘেরা বাবুদের কথা বলেছি। গরিব মানুষ তাদের কাছে কতটা অসহায়! মজা করে বলা অ্যান্টিক্যাপিটালিস্ট গান। কেবলমাত্র আনন্দplus-এর জন্য একটা গান লিখেছিলাম। বাঙালির আড্ডা নিয়ে। কেমন করে স্কাইপে, ফেসবুকে চলে যাচ্ছে আড্ডা। আড্ডা দেওয়া মানুষের সময় বদলে গিয়েছে। সকালে অফিস যেতে যেতে কেউ এমন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা জুড়ছে, যার তখন কাজের দিন ফুরিয়ে রাত।

হঠাৎ ‘রাজপ্রাসাদের বন্দি’র মতো অ্যান্টি হোমোফোবিক গান কেন পুজোর অ্যালবামে?

যখন গে-রাইটস্-এর বিরুদ্ধে ৩৭৭ ধারা চালু হল, তখনই গান এসেছিল। ভালবাসাকে স্ট্রাকচারের মধ্যে রেখে দেখতে হবে কেন?

এখন তো ফিল্মের গানের নিরিখে সঙ্গীতশিল্পীদের রেটিং করা হয়। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন একটা শুষ্কং-কাষ্ঠং সমাজের ছবি বলা গান লোকে শুনবে?

দেখুন, আমি জানি ফিল্মের জন্য যদি গান লিখি সেখানে যা টাকা পাওয়া যায়, নিজের অ্যালবামের জন্য সেটা কখনওই পাব না। কিন্তু ফিল্মের গান তো সিচুয়েশনের কথা ভেবে লিখতে হয়। গায়ক হিসেবে, কম্পোজার হিসেবে আমার তো একটা খিদে আছে। নিজের অ্যালবামে সেই খিদে মেটে। গানের জন্যই গান তৈরি হওয়াটা বাংলা গানের জন্য খুব জরুরি। চেষ্টা তো করে যেতেই হবে।

এত যে জনপ্রিয় আপনার গান, রয়্যালটি পেয়েছেন কখনও?

রয়্যালটি শব্দটা কী ঠিক জানি না। তবে এ বার ‘বাক্যবাগীশ’ অ্যালবামের জন্য কথা হয়েছে রয়্যালটির। দেখা যাক, লোকে অ্যালবামটাকে কী ভাবে নেয়।

এই অ্যালবামেও নিজেকে ভেঙেছেন অনুপম। সেটা কেমন?

সাউন্ড নিয়ে একটা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছে ‘বাক্যবাগীশ’-এ। আমার গলা যেহেতু সফ্ট, অনুভূতিপ্রবণ, সেটার কথা মাথায় রেখে এ বারে কোনও সিন্থেটিক টোন ব্যবহার করা হয়নি এখানে। সাউন্ডটা কিন্তু একটা ব্যান্ড প্রোডিউস করছে। যদিও তা ব্যান্ডের মতো নয়। ভায়োলিন যেমন ব্যবহার করা হয়েছে, তবলা, ঢোলও এসেছে। আমার গলার ‘র’ টোনটা ধরে রাখার জন্য বারবার লাইভ রেকর্ড করা হয়েছে।

অনুপমের গান মানেই পেলবতা। এই ‘র’ টোন, অ্যাবস্ট্রাক্ট শব্দের ভিস্যুয়াল প্রেজেন্টেশন একটু একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে না?

উপমহাদেশে কাজ করতে গেলে টাইপকাস্ট হয়ে যাওয়ার একটা সমস্যা থেকেই যায়। বব ডিলানকে কিন্তু এই প্রশ্নটা কেউ করবে না। সারা জীবন উনি তো একই ধারার গান করেছেন। আর সত্যি কথা বলতে কী আমার মনে হয় স্পেশালাইজেশন কিন্তু একটা ধারাতেই হয়। গান গাওয়ার ক্ষেত্রে এটাই আমার ধাঁচ। আমি সেটাতেই মনোযোগ দেব। তবে ছবির জন্য ছ’টা গান তৈরি করতে হলে আমি কিন্তু ছ’টা গানই আলাদা করার চেষ্টা করি।

লোকে তা হলে ঠিকই বলে। ছবির জন্য, বিশেষ করে সৃজিতের জন্য অনুপম সবচেয়ে ভাল গান তৈরি করে...

সবাই তা হলে আমার সব গান শোনেনি। ‘চলো পাল্টাই’ কিন্তু খুব বড় হিট। সেটা সৃজিতের ছবি ছিল না। আসলে সৃজিত আলাদা করে ওর ছবিতে গানের একটা বিরাট জায়গা রাখে। আমি তো সকলকেই গান শোনাই। কিন্তু ও ঠিক আমার ভাল গানটা চিনে নিতে জানে। এমনও হয়েছে আমার গানের কথা ভেবে ও ওর ছবির দৃশ্য লিখেছে! এতটাই গানের জায়গা থাকে ওর ছবিতে। মৈনাকের সঙ্গেও কাজ করে ভাল লেগেছে।

এখন কাদের গান ভাল লাগছে?

আমি চিরদিনই ‘চন্দ্রবিন্দু’র ভক্ত। ওদের পরে প্রাঞ্জলের লেখা বেশ লাগছে। শিলাদা (শিলাজিৎ) বেশ ইন্টারেস্টিং লেখে। তবে এখন কেন গান লিখছে না জানি না। লোপাদির (লোপামুদ্রা মিত্র) গানও ভাল লাগে। ‘হেমলক সোসাইটি’-র গানটা ওকে ভেবেই লিখেছিলাম।

রবীন্দ্রনাথ না সলিল চৌধুরী কার গান পছন্দের?

অফকোর্স সলিল চৌধুরী। রবীন্দ্রসঙ্গীত কোনও দিন আমায় টানেনি।

সুমন না নচিকেতা?

দু’জনের গান শুনেই আমার গান লেখা।

কিন্তু শিল্পীরা, যাঁরা মঞ্চে বাংলা গান করছেন, তাঁরা কবীর সুমনের গান মঞ্চে গান না কেন? কবীর সুমন তো জনপ্রিয়...

জনপ্রিয় ঠিকই. কিন্তু যাঁরা পারফর্ম করছেন, তাঁরা বোধহয় সেটা বিশ্বাস করেন না! তাই কবীর সুমনের গান অন্য শিল্পীর কণ্ঠে মঞ্চে শোনা যায় না।

বাংলা গান আগে যেমন হিন্দি ছবিতে ব্যবহার করা হত, সেই ট্রেন্ডটা জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে আবার ফিরে আসছে। আপনার ইচ্ছে করে না?

হবে খুব শিগগির। আমার গান হিন্দি ছবিতে ব্যবহার করা হবে। ফাইনাল হলে জানাব।

দেবের জন্য নাচের গান লিখতে ইচ্ছে করে না? কমার্শিয়াল ছবিতে ‘ও মধু ও মধু’-র মতো গান লিখতে পারবেন?

সে রকম অফার করেও না কেউ। আমার কোনও ইচ্ছেও নেই। আর দেবের জন্য গান লিখব ভাবিনি। সুযোগ এলে করব নিশ্চয়ই। তবে তাগিদ কতটা থাকবে জানি না!

‘একবার বল তোর কেউ নেই’ বা ‘চতুষ্কোণ’-এ ‘বসন্ত এসে গেছে’ এই গানগুলোয় নাকি লুকিয়ে আছে আপনার চোখের জল, জীবনের অনন্য মুহূর্ত... অন্য কাউকে দিয়ে গাওয়াতে পারবেন এই গান?

নাহ্। ওগুলো সত্যি মনে হয় কেবল আমার গান। আমি জানি গানগুলো কেন এসেছে। গন্ধ পাই ওদের... জানি কতটা চোখের জল আছে ওখানে... ওগুলো শুধু আমার!

anupam roy srobonti bandopadhay interview
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy