০১ মে ২০২৪
একুশের সেরা ২১

বিসর্জন

 বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়
বাসুদেব চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০০:০৬
Share: Save:

‘‘কী হে বীরেন, মূর্তি তৈরির কাজ কত দূর?’’

চেনা কণ্ঠস্বরে ত্রিপলের আড়াল থেকে মুখ বাড়ায় মৃৎশিল্পী বীরেন পাল। বীরেনের কাজের বিশেষত্ব এটাই, মূর্তি তৈরির কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কারও দর্শনের উপায় নেই। গ্রাম প্রধান অখিল অধিকারী এসেছেন প্রতিমা তৈরির কাজ দেখতে।

‘‘ওই চলছে কর্তা। এ বছর নামোপাড়া আর রাজাপাড়ার দায়িত্বটাও নিয়েছি। ষষ্ঠীর দিন শেষ করে ফেলব।’’

‘‘বয়সটা দিন দিন বাড়ছে বীরেন, সেটা খেয়াল আছে? প্রতি বছর এটারই দায়িত্ব নাও তো। এবছর হঠাৎ কী হল?’’

‘‘চিন্তা করবেননি কর্তা, সময়ের আগে শেষ করে ফেলব।’’

‘‘আমি তোমার শরীর নিয়ে চিন্তা করছি, বীরেন। নিজের খেয়াল রেখো।’’

বীরেন পাল দেবীপুরের বামুনপাড়ার দুর্গামন্দিরে বহু বছর ধরে প্রতিমা তৈরীর কাজ করে আসছে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ। কয়েক বছর হল সাহায্যের জন্য তিনটে শাগরেদ রেখেছে। সকলেই কমবয়সি, বেশ কর্মঠ ছেলে। তবে এ বছর তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়েছে বীরেন। একা হাতে সব দিক সামলাচ্ছে। এত বড় একটা দুর্ঘটনার পর কেউ আশা করতেই পারেনি যে বীরেন আবার উঠে দাঁড়াবে, মূর্তি তৈরি তো দূর অস্ত। ছয় মাস আগে বীরেনের মেয়ের ক্ষতবিক্ষত, নগ্ন, নিথর দেহটা উদ্ধার হয়েছিল জঙ্গলের ভিতরে! এমন অমানবিক, জঘন্য কাজ করল কারা, কোন হদিস পাওয়া যায়নি। সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, সকলেই বীরেনকে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার পরামর্শ দিলেও বীরেন সে পথ মাড়ায়নি‌! তার চোখে একফোঁটা জল পর্যন্ত দেখা যায়নি। সবাই ভেবেছিল বীরেন হয়তো শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে। কিন্তু না! সকলকে ভুল প্রমাণ করে এত বড় একটা শোক সামলে সেই বীরেন নির্বিকার চিত্তে প্রতিমা তৈরি করে চলেছে!

সমস্ত উৎকণ্ঠা কাটিয়ে ষষ্ঠীর বোধনের আগেই কাজ সেরে ফেলল বীরেন। ত্রিপলের অবগুণ্ঠন উঠতেই সকলে হতবাক! এ কী বানিয়েছে বীরেন? অর্ধনগ্ন অবস্থায় ভূপতিত মা দুর্গা! সমস্ত শরীর নখের আঁচড়ে রক্তাক্ত! মা দুর্গার স্থানে মহিষাসুর। মুখে বিদঘুটে হাসি। লক্ষ্মী, গণেশ, কার্তিক, সরস্বতী, অস্তিত্বহীন। তাঁদের জায়গা নিয়েছে সাধারণ পোশাকের কিছু মানুষ। মায়ের শোচনীয় অবস্থা তারা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে যেন।

দেবীপুর গ্রাম জুড়ে মহা শোরগোল। বামুনপাড়ার সাথে সাথে নামোপাড়া, রাজাপাড়া, সর্বত্র একই চিত্র! গ্রামের মাতব্বরস্থানীয় লোকেরা বীরেনকে হাতের সামনে পেলে বোধ হয় মেরেই ফেলবে।

জঙ্গলের উঁচু ঢিবিটার উপরে তিন শাগরেদকে নিয়ে খোশমেজাজে আড্ডা মারছে বীরেন। অখিলবাবু পৌঁছে গেলেন সেখানে।

‘‘বীরেন এ কেমন ছেলেমানুষি?’’

‘‘কী ছেলেমানুষি দেখলেন কর্তা?’’

‘‘মা দুর্গাকে ওই অবস্থায়... এই অনাচার সহ্য হবে ভেবেছ?’’

‘‘কী যে বলেন কর্তা! অনাচার কোথায়? পুরোটাই তো আচার! এই প্রথম বার মাকে যথার্থ রূপে তুলে ধরতে পারলাম।’’

‘‘তুমি শোকে পাগল হয়ে গিয়েছ বীরেন।’’

‘‘সমাজের এটাই যে চালচিত্র কর্তা! এর থেকে বড় বাস্তব কি আর কিছু আছে? আমার ওইটুকু মেয়েটা কী দোষ করেছিল বলতে পারেন। নরখাদকগুলো ছিঁড়েখুঁড়ে তাকে খুবলে খুবলে শেষ করে দিল। আমি কোনও মূর্তি তৈরি করিনি কর্তা, গল্প লিখেছি গো, গল্প, উত্তরণের গল্প, সমাজের উত্তরণের গল্প!’’

অখিলবাবুর দুটো চোখ বাষ্পায়িত। ‘‘এমন উত্তরণের গল্প আগে লিখিসনি কেন রে? আমার নাতনিটাকেও যে...গ্রামের মাথা হয়েও কিছুই করতে পারিনি। তোর উত্তরণের গল্পে আমিও আজ শামিল হলাম বীরেন।’’ কান্নারুদ্ধ গলা তাঁর।

‘‘আমি জানতাম আপনি এখানে আসবেন, তাই আমিও তৈরি হয়েই আছি। আর একখানা উত্তরণ আপনাকে দেখতে হবে কর্তা, এক্ষুনি ঘটবে সেই উত্তরণ।’’

প্রৌঢ় বীরেনের হাতে ছোট্ট ধারালো একটা কুকরি, ন্যুব্জ শরীরটা ধনুকের ছিলার মতো ছিটকে ওঠে তার... চোখের পলকে তার তিন শাগরেদের কন্ঠনালিতে অব্যর্থ নিশানা!! ধাতব বস্তুর লক্ষ্যভেদের আওয়াজ কানে আসে শুধু। তিনটে রক্তাক্ত নিথর শরীর ঢিবির ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নীচে! ‘‘এদের ছেলের মতো ভালবেসেছিলাম কর্তা। আমার বাড়িতে ছিল অবাধ যাতায়াত, সেই সুযোগে মেয়েটাকে আমার... দানের এমন প্রতিদান পাব, বুঝতে পারিনি। সব জেনেও চুপ ছিলাম এতদিন, বোধনেই বিসর্জন ঘটাব বলে।’’ এবার দৃঢ়তা হারিয়ে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়ে বীরেন। দীর্ঘ ছয় মাস ধরে জমে থাকা কান্নাটা সুদে-আসলে তার হিসেব পুষিয়ে নিচ্ছে তখন।

গ্রামের মন্দিরে সান্ধ্যকালীন আরতি... ঘন্টার ঢং ঢং আওয়াজের সাথে শঙ্খধ্বনির নিনাদ... শুধু কি তাই? নাকি এমন উত্তরণের গল্পে শঙ্খ আর ঘন্টার ধ্বনিও পূর্ণ সহমত পোষণ করছে তাদের আওয়াজের মধ্যে দিয়ে! একটা মৃদু বাতাস, ঢিবির পাশের শিউলি গাছের ফুলগুলো পুষ্পবৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে থাকে বীরেনের মাথায়! হয়তো এ ভাবেই ঈশ্বরের আশীর্বাদের মধ্যে দিয়ে বোধনের সন্ধ্যায় রচিত হয়ে গেল এক বীরের বীরগাথা! ঈশ্বর কখনও কখনও এ ভাবেই নিজের অস্তিত্ব জাহির করেন যে। দূর থেকে ভেসে আসছে বোধনের মন্ত্র...

‘রাবণস্য বধার্থায় রামস্যানু গ্রহায় চ

অকালে ব্রহ্মনা বোধো দেব্যাস্ত্বয়ি কৃতঃ পুরা।

অহমপ্যাশ্বিনে ষষঠ্যাং সায়াহ্নে বোধয়ামি বৈ…’

অখিলবাবুর সারা শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে‌। পর পর বেশ কয়েক দিন ধরে দেবীপুর গ্রামে পুলিশের ভ্যান এসে ফিরে যাচ্ছে। বীরেনকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না, প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে গ্রামবাসী! অষ্টপ্রহর প্রহরায় তারা। হাতে নেই মোমবাতি, চোখে প্রজ্জ্বলিত আগুন। তা হলে সমাজ উত্তরণের গল্পটা কি বীরেন শেষমেশ লিখেই ফেলল? না কি তাপমাত্রা কমে গেলেই তপ্ত শলাকা উষ্ণতা হারিয়ে পুনরায় শীতল হয়ে পড়বে? উত্তরটা তোলা থাক আগামীর জন্য...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE