মস্তিষ্কে অ্যানিউরিজ়ম ফেটে গেলে স্ট্রোকের আশঙ্কা থাকে। কী ভাবে এই সমস্যা চিহ্নিত করবেন? রইল বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অ্যানিউরিজ়ম — শব্দটি অনেকের কাছে অপরিচিত। এটি এমন একটা সমস্যা যা অজান্তে শরীরের মধ্যে জন্ম নেয়, কখনও সারা জীবন সুপ্ত থাকে, আবার কখনও এতটাই ভয়াবহ হয় যে, সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু সচেতন হলে চিকিৎসার মাধ্যমে আরোগ্য লাভ সম্ভব। অবশ্য তার আগে অ্যানিউরিজ়ম কী, কেন হয় এবং কতটা ভয়াবহ তা জানা প্রয়োজন।
অ্যানিউরিজ়ম কী
শরীরে হার্ট থেকে একাধিক আর্টারি বা ধমনির মাধ্যমে রক্ত মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাহিত হচ্ছে। বিভিন্ন কারণে ধমনির এক বা একাধিক জায়গা দুর্বল হয়ে গেলে সেখানে রক্ত জমে বেলুনের মতো হয়। সেই বেলুন আকারে ছোট বা বড় হতে পারে। এই বেলুনের মতো হওয়াকে বলে অ্যানিউরিজ়ম। ‘‘অ্যানিউরিজ়ম সাধারণত তৈরি হয় দুটো ধমনি যেখানে ওয়াইয়ের মতো ভাগ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে। ওখানে রক্তের গতি সবচেয়ে বেশি থাকে। এই জন্য আর্টারির অ্যাঙ্গেলে অ্যানিউরিজ়ম বেশি হয়। শুধু অ্যাঙ্গেল হলে হবে না, কত দ্রুত গতিতে রক্ত যাচ্ছে সেই শক্তির উপরেও নির্ভর করছে,’’ বললেন মেডিকেল কলেজের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. অরুণাংশু তালুকদার। যে ধমনিগুলো সোজাসুজি অনেকটা পথ যাচ্ছে, যেমন হাত বা পায়ের ধমনি, সেখানে অ্যানিউরিজ়ম সচরাচর হয় না। সমস্যা মূলত হয়, ব্রেন, হার্ট, কিডনি ও পেটে। কোথাও ছোট ছোট আকারে বেলুন তৈরি হয়, কোথাও আবার মাকুর মতো ফুলে যায়। অ্যানিউরিজ়ম কখনওই বাইরে থেকে বোঝা যাবে না। বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গেলে উপসর্গ দেখা দেবে।
কী কী কারণে হতে পারে
- অ্যানিউরিজ়মের পিছনে একাধিক কারণ আছে—
- অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ ও ডায়াবিটিস
- রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাবৃদ্ধি
- অতিরিক্ত ধূমপান
- এই রোগের পারিবারিক ইতিহাসে থাকলে। বিশেষ করে যাঁদের পরিবারে পলিস্টিক কিডনি সমস্যা আছে।
- বয়সজনিত কারণেও হতে পারে কারণ, বয়সের সঙ্গে আর্টারিগুলো দুর্বল হয়ে যায়
- শরীরে কোনও সংক্রমণ হলে
- জন্মগত কারণ।
অ্যানিউরিজ়ম কি প্রাণহানির কারণ হতে পারে?
এই রোগ হলেই যে মৃত্যুর আশঙ্কা আছে তা নয়। এই প্রসঙ্গে ডা. তালুকদার বললেন, ‘‘অনেকেই অ্যানিউরিজ়ম নিয়ে আমৃত্যু দিব্যি থাকেন, টেরও পান না। এর থেকে বড় ধরনের বিপদ হতে পারে যদি অ্যানিউরিজ়ম ফেটে যায় এবং তা থেকে হেমারেজ হয়। ব্রেনে অ্যানিউরিজ়মের সম্ভাবনা বেশি। কারণ ওইটুকু জায়গার মধ্যে প্রচুর আঁকাবাঁকা ধমনি রয়েছে। ব্রেনে অ্যানিউরিজ়ম ফেটে গেলে স্ট্রোকের সম্ভাবনা থাকে। পেটের মধ্যে এটি ফেটে গেলে রোগী শকে চলে যেতে পারেন। অনেক সময়ে হেমারেজ না হয়ে থ্রম্বোসিস বা রক্ত জমাট বেঁধে যায়। এর ফলে রক্ত চলাচলের স্বাভাবিক গতি বাধাপ্রাপ্ত হয়।’’
মস্তিষ্কে অ্যানিউরিজ়ম
ব্রেনে অ্যানিউরিজ়ম থাকলে বিপদ সবচেয়ে বেশি। এটি ফেটে গেলে কি ব্রেন স্ট্রোক হতে পারে? নিউরোলজিস্ট ও স্ট্রোক স্পেশ্যালিস্ট ডা. জয়ন্ত রায় বললেন ‘‘হ্যাঁ, এটাকে এক ধরনের স্ট্রোক বলা যায়, যেখানে ব্রেন হেমারেজ হয়। যাকে বলে সাবঅ্যারাকনয়েড হেমারেজ বা সংক্ষেপে এসএএইচ। এর ফলে ব্রেনের মধ্যে চারিদিকে রক্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই হেমারেজ হওয়ার আগে প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হবে, ওটাই উপসর্গ। এ ছাড়া বমি, খিঁচুনি হতে পারে। ফুসিফর্ম, ডিসেকটিং, মাইকোটিক ইত্যাদি অ্যানিউরিজ়মের মধ্যে সাকুলার (বেরি) অ্যানিউরিজ়ম সবচেয়ে ক্ষতিকর। সাবঅ্যারাকনয়েড হেমারেজ হওয়ার পর যে রক্ত ব্রেনের চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তা কিছু দিন পরে গলে যায়। কিন্তু রক্তের মধ্যে থাকা কেমিক্যাল ধমনীগুলোকে চেপে দেয়। এর জন্য দেখা যায় চিকিৎসার ফলে রোগী অ্যানিউরিজ়ম থেকে বেঁচে গেলেও হয়তো দু’সপ্তাহ পর তাঁর স্ট্রোক হয়ে গেল। যাকে বলে ভেসোস্প্যাজ়ম, এটা ইস্কেমিক স্ট্রোক।’’ সব সময় যে অ্যানিউরিজ়ম ফেটে গিয়ে প্রচুর রক্তপাত হবে তা নয়, অল্প রক্তপাতও হতে পারে যাকে বলে সেন্টিনেল ব্লিড। এ ক্ষেত্রেও উপসর্গ মাথা ব্যথা। রক্তপাত হওয়ার পরে মাথা ব্যথা কমে যায়, পুরোটাই ঘটে অল্প সময়ের মধ্যে। মাথাব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হয় না বলে মনে হতে পারে মাইগ্রেনের সমস্যা। আর এখানেই রোগ নির্ণয় হতে দেরি হয়। ‘‘সেন্টিনেল ব্লিড হল সর্তকবার্তা। পরেরটা হয়তো মারাত্মক হতে পারে আর দিনকয়েকের মধ্যেই হতে পারে,” বললেন ডা. রায়।
চিকিৎসকেরা ব্রেন অ্যানিউরিজ়মকে কয়েকটা গ্রেডে ভাগ করেছেন। চিকিৎসা হয় সেই গ্রেড অনুযায়ী। ‘‘গ্রেড এক ও দুই স্তরে যদি অ্যানিউরিজ়ম থাকে এবং ফেটে না যায়, তা হলে একটা ওপেন সার্জারিতে ক্লিপিং করে দেওয়া যায়। বেলুনের গোড়ায় ছোট্ট একটা ক্লিপ বসিয়ে দেওয়া যাতে ভবিষ্যতে সেটা ফেটে না যায়। এ ছাড়া আর একটা উপায় কয়েলিং। এটা অনেকটা অ্যাঞ্জিয়োগ্রামের মতো, অস্ত্রোপচার না করে একটা ক্যাথিটারের মাধ্যমে ছোট ছোট অ্যালয় কয়েলগুলো বেলুনের ক্যাভিটিগুলোকে এমন ভাবে ফিল করে দেয়, যাতে বেলুনটা সলিড হয়ে যায়, এতে ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। সাবঅ্যারাকনয়েড হেমারেজের যদি পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তা হলে কয়েলিং করে বিপদ অনেকটা কমিয়ে ফেলা যাবে। বেলুনের আকার খুব ছোট থাকলে চিকিৎসকেরা তখনই কিছু করতে বলেন না। কিন্তু ফলোআপেরমধ্যে থাকা জরুরি। কারণ গ্রেড তিন-চারে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকে,’’ বললেন ডা. রায়। তাই ব্যথা অসহনীয় হলে ব্যথানাশক ওষুধ খেয়ে প্রশমন না করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া জরুরি।
আগাম সচেতন হওয়া
লাগামছাড়া রক্তচাপ অ্যানিউরিজ়মের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় এবং এটির ফেটে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করে। ‘‘অ্যানিউরিজ়ম হলে ওষুধ দিয়ে কমানোর উপায় নেই। কিন্তু যাতে আর না বৃদ্ধি পায় সে জন্য শরীরের অন্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যাঁদের রক্তচাপ, শর্করা, কোলেস্টেরল অনিয়ন্ত্রিত, তাঁদের অবশ্যই ওষুধ ও ডায়েটের মাধ্যমে এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আমাদের দেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে দু’-তিন জনের অ্যানিউরিজ়ম হয়,’’ বললেন ডা. তালুকদার।
ঘন ঘন মাথা ব্যথা বা বুকে ব্যথা ফেলে না রেখে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। ধূমপান করা যাবে না। যাঁদের পরিবারে অ্যানিউরিজ়মের ইতিহাস রয়েছে, তাঁদের এই সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। পরিবারে একাধিক সদস্যের এই রোগ থাকলে অন্যান্য সদস্যরা স্ক্রিনিংয়ের জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)