Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চলন ‘ব্যাঁকা’ ঠেকলেই শাস্তি, স্বাস্থ্যে সন্ত্রাস

প্রবীণ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসককে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে রাজ্য ছাড়তে বাধ্য করা। কাউকে কাউকে দীর্ঘ কাল সাসপেন্ড করে রাখা। অপছন্দের শিক্ষক-চিকিৎসককে নিতান্ত গুরুত্বহীন পদে বসিয়ে মানবসম্পদের যথেচ্ছ অপব্যবহার। অনেককে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ের নামে বছরের পর বছর অকেজো যন্ত্রের মতো ফেলে রাখা। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক গত তিন বছরে এই জাতীয় ঘটনা বাড়ছে।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৪
Share: Save:

প্রবীণ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসককে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে রাজ্য ছাড়তে বাধ্য করা।

কাউকে কাউকে দীর্ঘ কাল সাসপেন্ড করে রাখা।

অপছন্দের শিক্ষক-চিকিৎসককে নিতান্ত গুরুত্বহীন পদে বসিয়ে মানবসম্পদের যথেচ্ছ অপব্যবহার।

অনেককে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ের নামে বছরের পর বছর অকেজো যন্ত্রের মতো ফেলে রাখা।

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসা ইস্তক গত তিন বছরে এই জাতীয় ঘটনা বাড়ছে। যার জেরে সরকারি চিকিৎসকদের একাংশের মনোবল ইদানিং তলানিতে এসে ঠেকেছে বলে খাস স্বাস্থ্যভবনেরই অন্দরে অভিযোগ উঠেছে। স্বাস্থ্য-কর্তারা একান্তে স্বীকার করছেন, চিকিৎসকমহলে এ হেন ‘ত্রাসের আবহের’ প্রভাব পরিষেবাতেও পড়ছে। ফলে আম-জনতাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

এবং সমস্যা সুরাহার ইঙ্গিত তো নেই-ই, বরং তা দিন দিন ঘোরালো হয়ে উঠছে। দফতরের খবর, ভুক্তভোগী বেশ কিছু চিকিৎসক চিঠি লিখে কিংবা মৌখিক ভাবে স্বাস্থ্যভবনকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেছেন। জানিয়েছেন, কিছু শীর্ষস্থানীয় কর্তার প্রতিহিংসামূলক আচরণে তাঁরা বীতশ্রদ্ধ। নজরদারি চালানোর জন্য বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে তুলে আনা কিছু বিশেষজ্ঞ ও শাসকদল-ঘনিষ্ঠ কিছু চিকিৎসক নেতার ‘স্বেচ্ছাচারিতা’ দেখেও ওঁরা হতাশ। স্বাস্থ্যভবনের কাছে ওঁদের অভিযোগ, আনুগত্যে বিন্দুমাত্র খামতি দেখলে ওই ‘প্রভাবশালীরা’ বদলা নিতে উঠে পড়ে লেগে পড়েন। পরিণাম অপবাদ, হেনস্থা, অপমান, বদলি, সাসপেন্ড ইত্যাদি।

সব মিলিয়ে সরকারি চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ রীতিমতো আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বলে কবুল করছেন স্বাস্থ্যভবনের কর্তারাই। আর ‘অপছন্দের’ লোককে শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেওয়ার জন্য যাঁর নাম প্রায় সর্বত্র সর্বাগ্রে উঠে আসছে, তিনি হলেন তৃণমূলের চিকিৎসক-বিধায়ক নির্মল মাজি। প্রসঙ্গটি শুনে যাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া, “স্বাস্থ্যভবনের সব কমিটিতে আমি আছি। তাই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমার মত থাকতেই পারে।” তবে শাসকদলের সুরে সুর না মেলালে তাঁরা যে কাউকে ছেড়ে কথা কইবেন না, নির্মলবাবুর পরের বাক্যে সে ইঙ্গিত স্পষ্ট। “আমার প্রতি আনুগত্য দরকার নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মা-মাটি-মানুষের প্রতি আনুগত্য থাকতে হবে। তা না-থাকলে ও কাজ না-করলে সেই ডাক্তার শাস্তি পাবেন।” সাফ জানিয়েছেন তৃণমূলের চিকিৎসক নেতা।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমনটা হতে পারে কি না, স্বভাবতই সে প্রশ্ন তুলছেন চিকিৎসকদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য: একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল বা তাঁর নেত্রীর প্রতি অনুগত্য না-থাকলে শাস্তি পেতে হবে এটাই যদি নিয়ম হয়ে যায়, তা হলে ভাল ডাক্তারেরা সরকারি চাকরি ছেড়ে চলে যাবেন।

বাস্তব প্রবণতা খানিকটা যেন তেমনই। স্বাস্থ্য-সূত্রে জানা যাচ্ছে, সদ্যোজাতের চিকিৎসায় বিশ্বখ্যাত ‘পুরুলিয়া মডেল’-এর জনক নিওনেটোলজিস্ট অরুণ সিংহের বিরুদ্ধে অর্থ তছরূপ ও দুর্ব্যবহারের অভিযোগ তোলা হয়েছিল। যদিও তার কোনও তদন্ত দফতর করেনি। অপমানিত অরুণবাবু ২০১২-র ডিসেম্বরে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যান নয়াদিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রকে, শিশু-স্বাস্থ্য বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা হয়ে। সম্প্রতি চন্দ্রবাবু নায়ডুর অন্ধ্রপ্রদেশ তাঁকে ডেকে নিয়েছে। অন্ধ্র মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ মেডিক্যাল উপদেষ্টা কমিটির সদস্য করা হয়েছে অরুণবাবুকে। “অথচ সারা জীবন যে রাজ্যকে দিলাম, তারা আমাকে অপমান ছাড়া কিছু দিল না!” বলছেন প্রবীণ চিকিৎসক।

এমন এক জন ডাক্তার রাজ্য ছেড়ে চলে স্বাস্থ্যভবনের আনাচে-কানাচেও আক্ষেপের শেষ নেই। অরুণবাবু বলেছেন, তাঁকে ফেরার অনুরোধ জানিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে ফোন করেছিলেন। “কিন্তু আমাকে কিছু লোকের কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরতে বলা হচ্ছে, যেটা অসম্ভব।” মন্তব্য তাঁর। মলয়বাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমরা চাই, উনি ফিরে আসুন। কিন্তু ওঁকে কখনওই বলা হয়নি ক্ষমা চাইতে। শুধু বলা হয়েছে, যাঁদের সঙ্গে ওঁর বিরোধ, তাঁরাও এই সিস্টেমে থাকবেন। উনি সেটা মানতে পারছেন না।” যে ‘প্রভাবশালী’র জন্য অরুণবাবুকে সরতে হয়েছে বলে অভিযোগ, রাজ্যের মা ও শিশু বিষয়ক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান সেই ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, “ওঁকে (অরুণ সিংহ) ছাড়াই তো পশ্চিমবঙ্গ সদ্যোজাতের চিকিৎসায় বেশি উন্নতি করেছে!”

নতুন জমানার সহনশীলতার ভাঁড়ারে যে বাস্তবিকই টান, তার আভাস অবশ্য মিলেছিল একেবারে গোড়ায়। দিয়েছিলেন পরিবর্তনের সরকারের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। ২০১১-র ২৬ মে বাঙুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি (বিআইএন)-তে আচমকা পরিদর্শনে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন প্রতিষ্ঠানের তদানীন্তন অধিকর্তা শ্যামাপদ গড়াই। তুরন্ত তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়। ছ’মাস বাদে ধরানো হয় শো-কজের কাগজ। তারও তিন-চার মাস বাদে চার্জশিট দিয়ে আরজিকরের তৎকালীন অধ্যক্ষের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গড়া হয়। কমিটি এক বার শ্যামাপদবাবুকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তার পরে সব চুপচাপ। স্বাস্থ্য-সচিবের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, “শ্যামাপদ গড়াইয়ের বিষয়টা অন্য রকম। কোনও মন্তব্য করতে পারব না।”

তালিকায় আরও নাম রয়েছে। যেমন এনআরএসের প্রাক্তন অধ্যক্ষ তথা ফরেন্সিক মেডিসিনের প্রবীণ প্রফেসর প্রদীপ ঘোষ। অভিযোগ, ২০১২-র নভেম্বর থেকে তাঁকে স্বাস্থ্যভবনে গুরুত্বহীন পদে স্রেফ বসিয়ে রাখা হয়েছে। প্রদীপবাবু নিজেও জানাচ্ছেন, তাঁর কোনও কাজ নেই। ফরেন্সিকে শিক্ষক-চিকিৎসকের প্রবল আকাল সত্ত্বেও ওঁকে বসিয়ে রাখা কেন?

রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “এঁরা বসে বসে ঘোঁট পাকান। এঁদের এমনই হওয়া উচিত।” স্বাস্থ্য-শিক্ষার প্রাক্তন যুগ্ম অধিকর্তা তথা বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রদীপ সাহা সম্পর্কেও অধিকর্তার বক্তব্য প্রায় এক। বায়োকেমিস্ট্রির প্রফেসর প্রদীপবাবুকে ২০১৩-র এপ্রিল থেকে স্বাস্থ্যভবনে ‘কম্পালসরি ওয়েটিং’য়ে রাখা হয়েছে। “উনি ডিএমই-কে মানবেন না। এ দিকে বহরমপুরে বসে সমান্তরাল প্রশাসন চালাবেন! এ চলতে পারে না। তা ছাড়া কম্পালসরি ওয়েটিং সরকারি নীতির ব্যাপার।” বলছেন সুশান্তবাবু।

উঠে আসছে গত বছরের এনসেফ্যালাইটিস-কাণ্ডের প্রসঙ্গও। উত্তরবঙ্গে রোগটির প্রাদুর্ভাবের খবর স্বাস্থ্যভবনে ‘সময় মতো’ না-জানানোর অভিযোগে সাসপেন্ড করা হয়েছিল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অনুপ রায় এবং জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য-আধিকারিক সুবীর ভৌমিককে। বছর ঘুরতে চললেও তাঁদের শো-কজ বা চার্জশিট হয়নি। স্বাস্থ্য-সচিবের ব্যাখ্যা, “তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার মতো উপযুক্ত আইএএস বা ডব্লিউবিসিএস অফিসার মিলছিল না। এখন পেয়েছি। দ্রুত চার্জশিট দেব।”

এখানেই শেষ নয়। অভিযোগ, ‘শিক্ষা দিতে’ গিয়ে আরও অনেককে সরানো হয়েছে, যাঁদের জায়গায় যোগ্য বিকল্প পাওয়া যাচ্ছে না। অরুণ সিংহ চলে যাওয়ায় এসএসকেএমে নিওনেটোলজি’র ডিএম কোর্স যেমন বন্ধ, তেমন বিপ্লব আচার্য নামে এক ডাক্তারকে এনআরএস থেকে বিদায় দেওয়ায় সেখানে ‘অর্থোপেডিক ট্রেনিং ও লাইভ ওয়ার্কশপ’ চলছে না দু’বছর ধরে। সার্জন তমোনাশ চৌধুরী বদলি হওয়ায় আরজিকরে ল্যাপ্রোস্কোপি ট্রেনিং সেন্টার ঝাঁপ গোটানোর মুখে। সিউড়ির এক গাইনি অন্যায় বদলির প্রতিবাদে চাকরি ছেড়েছেন। রায়গঞ্জ হাসপাতাল ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে একাধিক চিকিৎসক কাজ করছেন না।

“এ অবস্থায় কোনও যোগ্য ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ডাক্তারবাবু যদি সরকারি চাকরিতে থাকতে না চান, তাঁকে দোষ দেওয়া যায় কি?” প্রশ্ন তুলছেন স্বাস্থ্য দফতরেরই এক কর্তা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE