১১ মিনিটে ৭ বার। ২০০৬ সালের ১১ জুলাই সন্ধেবেলা লোকাল ট্রেনে একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল বাণিজ্যনগরী। ন’বছর পর সেই মামলায় আজ দোষী সাব্যস্ত হল ১২ জন। মুম্বইয়ের বিশেষ আদালতের (মোকোকা) বিচারক যতীন ডি শিন্দে শুক্রবার এই রায় ঘোষণা করেন। সাজা নিয়ে দু’পক্ষের আইনজীবীর সওয়াল সোমবার শুনবেন তিনি।
২০০৬ সালেরই নভেম্বর মাসে ৩০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছিল সন্ত্রাস দমন শাখা (এটিএস)। তবে তাদের মধ্যে শুধু ১৩ জনকে ধরতে পারে পুলিশ। পলাতক বাকি ১৭ জনের মধ্যে বেশ কিছু পাক নাগরিক আছে বলে সন্দেহ তদন্তকারীদের। ধৃত ১৩ জনের মধ্যে ১২ জনের বিরুদ্ধেই অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে আজ। যদিও বেকসুর ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন এক অভিযুক্ত।
ন’বছর আগের সেই অভিশপ্ত সন্ধে আজও ভোলেনি মুম্বই। শহরের লাইফ লাইন, রেল পথকে সে বার নিশানা করেছিল জঙ্গিরা। একটা বিস্ফোরণের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই যেন ফের বিকট আওয়াজ। সব মিলিয়ে মোট সাত বার। ওয়েস্টার্ন লাইনের দাদার থেকে ভায়ান্দর স্টেশনের মাঝে লন্ডভন্ড হয়ে যায় রেল যোগাযোগ। কোথাও ভিড়ে ঠাসা চলন্ত ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরায় আচমকাই ফাটে প্রেসার কুকারে রাখা আরডিএক্স। কোথাও বিস্ফোরণে উড়ে যায় লাইনের কিছুটা অংশ, কোথাও আবার আক্রমণ হয় রেল স্টেশনে। প্রাণ হারান ১৮৮ জন। আহত হন আটশোরও বেশি মানুষ।
এ দিন যে ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছে আদালত, তারা প্রত্যেকেই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন সিমি-র সদস্য। তাদের কেউ জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিতে দু’-দু’বার ঘুরে এসেছিল পাকিস্তান, কেউ নেপাল সীমান্ত হয়ে পাক নাগরিকদের নিয়ে এসেছিল মুম্বইয়ে। কেউ সামলেছিল আর্থিক লেনদেনের বিষয়, কেউ বা আবার বেছে নিয়েছিল নিশানা। বিস্ফোরণে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত এই বারো জনের নাম— কমল আহমেদ আনসারি, তনভির আহমেদ আনসারি, মহম্মদ ফয়জল শেখ, এহতেশাম সিদ্দিকি, মহম্মদ মজিদ শফি, শেখ আলম শেখ, মহম্মদ সাজিদ আনসারি, মুজাম্মিল শেখ, সোহেল মহম্মদ শেখ, জামির আহমেদ শেখ, নাভিদ হুসেন খান ও আসিফ খান। এদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি, অস্ত্র আইন, বেআইনি কাজ প্রতিরোধ আইন, সরকারি সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতি বিরোধী আইনের একাধিক ধারায় মামলা করা হয়েছিল। পাঁচ জনের নামে সরাসরি খুনের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি পর্যন্ত হতে পারে।
২০০৭-এ শুরু হয় এই বিস্ফোরণ কাণ্ডের শুনানি। কিন্তু পরের বছরই শুনানির উপর স্থগিতাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। প্রায় দু’বছর পর শীর্ষ আদালত সেই নির্দেশ রদ করলে ফের চালু হয় মামলা। তবে এই মামলার মোড় ঘুরেছিল এক বারই— যখন ইন্ডিয়ান মুজাহিদিনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাদিক শেখকে সাক্ষ্য দিতে আদালতে ডেকে পাঠান অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী। সাদিক এক বার বলেছিলেন, ২০০৫ পর্যন্ত মুম্বইয়ে যত হামলা হয়েছে, তার পিছনে ছিল আইএম। নিজের মক্কেলদের বাঁচাতে তাই সাদিককেই কোর্টে টেনে আনতে চান অভিযুক্তদের কৌঁসুলি। তাঁর সেই আর্জি মঞ্জুরও করেন বিচারক।
তবে রায় ঘোষণায় ৯ বছর পেরিয়ে যাওয়ার ক্ষুব্ধ অনেকেই। সে দিন বান্দ্রা থেকে ট্রেনে চেপেছিলেন সুভাস কাম্বলে। প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন, কিন্তু মৃত্যুমিছিল ভুলতে পারেননি। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘দোষ প্রমাণ হতেই এত বছর কেটে গেল।’’ আজ তাঁর একটাই প্রার্থনা— অপরাধীদের যেন চরম সাজা হয়।
তবে সময় লাগলেও দোষীরা যে ছাড়া পেয়ে যায়নি এতেই খুশি মুম্বইয়ের প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার এ এন রায়। সন্ত্রাস দমন শাখার প্রাক্তন প্রধান কে পি রঘুবংশীও একমত তাঁর সঙ্গে। দু’জনেই জানিয়েছেন, আর পাঁচটা বিস্ফোরণের থেকে এই মামলার ফারাক অনেকটা। রঘুবংশীর কথায়, ‘‘সব বিস্ফোরণেই কোনও না কোনও তদন্ত সূত্র থাকে। কিন্তু এখানে সে রকম কিচ্ছুটি ছিল না। তালগোল পালানো লাইন-ট্রেনের কামরা আর দেহাংশ। বাইরেটা ভিড়ে ঠাসা। অন্ধকারে কিছুই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার উপর নাগাড়ে বৃষ্টি।’’ তা সত্ত্বেও তাঁরা যে চার্জশিট পেশ করেছিলেন, এক জন বাদে সকলের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় অনেকটাই স্বস্তিতে এই প্রাক্তন প্রধান।
তবে সরকারি কৌঁসুলি রাজা ঠাকরের লড়াইটা এখনও শেষ হয়নি। সোমবার থেকে শুরু হবে সাজার জন্য সওয়াল। এত দিনের খাটনির ফল মিলল। তিনি কি খুশি? ঠাকরে জানালেন— দোষীদের চূড়ান্ত সাজার জন্যই চেষ্টা করবেন আপ্রাণ। তাতে স্বজনহারারা যদি শান্তি পান, তবেই সার্থক তাঁর পরিশ্রম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy