Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
National News

৭৩ বছর আগে মৃত্যু, দেশে ফিরে কফিনে ‘মিলন’ হল প্রেমিকা সুসানের সঙ্গে

বোমারু বিমানটা নিয়ে সে দিন চিনের কুনমিং থেকে আকাশে উড়েছিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ড। উত্তর-পূর্ব ভারতের আকাশে পৌঁছে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। একা নন, ছয় সঙ্গীকে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন মেঘের মাঝে।

২২ বছরের ঝকঝকে তরুণ রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ড। মার্কিন বিমানবাহিনীর ছটফটে সদস্য আকাশে হারিয়ে গিয়েছিলেন ৭৩ বছর আগে। ছবি: সংগৃহীত।

২২ বছরের ঝকঝকে তরুণ রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ড। মার্কিন বিমানবাহিনীর ছটফটে সদস্য আকাশে হারিয়ে গিয়েছিলেন ৭৩ বছর আগে। ছবি: সংগৃহীত।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৭ ১৭:৪২
Share: Save:

নিবাস আমেরিকা। কর্মস্থল চিন। আর নিখোঁজ হওয়ার ঠিকানা ভারতের আকাশ।

বোমারু বিমানটা নিয়ে সে দিন চিনের কুনমিং থেকে আকাশে উড়েছিলেন মার্কিন বিমানবাহিনীর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ড। উত্তর-পূর্ব ভারতের আকাশে পৌঁছে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। একা নন, ছয় সঙ্গীকে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন মেঘের মাঝে। তার পর থেকে ৭৩ বছর অরুণাচলই ‘ঠিকানা’ ছিল তাঁর। আমেরিকায় আকুল অপেক্ষা করছিলেন প্রেমিকা সুসান ব্রাউন। কিন্তু রবার্ট ফিরতে পারেননি। এত দিনে রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ড দেশে ফিরলেন বটে। কিন্তু ফিরলেন কফিনবন্দি হয়ে। সুসানও আর নেই।

রবার্ট-সুসানের প্রেমকাহিনী আমেরিকার কনকর্ড-জর্জিয়ার মানুষের কাছে সুপরিচিত। চিনে এবং উত্তর-পূর্ব ভারতেও অনেকেই জানেন রবার্ট-সুসানের কথা। ১৯৪২ সালে ‘টেক্সাস আর্মি ফ্লাইং স্কুল’ থেকে উত্তীর্ণ হয়েই সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন ২২ বছরের রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ড। সুসানের সঙ্গে রবার্টের প্রেমের শুরু অবশ্য তারও আগে। আমেরিকারই এক গির্জায় দেখা হয়েছিল দু’জনের। সেখান থেকে প্রেম। প্রেম থেকে সংসার পাতার ভাবনা। সে স্বপ্ন পূরণ হওয়ার আগেই আসে যুদ্ধক্ষেত্রের ডাক। কথা ছিল, যুদ্ধ থেকে প্রথম ছুটি পেয়ে যখন দেশে ফিরবেন, তখনই রবার্ট বিয়ে করবেন বাগদত্তা সুসানকে। মার্কিন বিমান বাহিনীর ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট রবার্ট ইউজিন অক্সফোর্ডকে চিনে পাঠানো হয়েছিল। কাজের জন্য নাকি মুখিয়ে থাকতেন ছটফটে তরুণ। বেশি কাজ করে কর্তাদের খুশি করতে পারলে, প্রথম ছুটিটা তাড়াতাড়ি মিলবে— রবার্ট নাকি এমনই ভাবতেন। শুধু কর্তাদের নয়, চিনের যে এলাকায় পোস্টিং ছিল রবার্টের, সেই এলাকার বাসিন্দাদেরও নাকি খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মিষ্টভাষী, সদাহাস্যময় যুবক।

‘হট অ্যাজ হেল’— এই বিমান নিয়েই শেষ বার আকাশে উড়েছিলেন রবার্টরা। তার পর হারিয়ে গিয়েছিলেন অরুণাচলের আকাশে। ছবি: সংগৃহীত।

১৯৪৪ সাল, ২৫ জানুয়ারি, সকাল ৭টা ৪০ মিনিট। চিনের কুনমিং থেকে ভারতের চাবুয়ায় রসদ পৌঁছনোর জন্য আকাশে উড়েছিল মার্কিন বিমানবাহিনীর ৪২৫ স্কোয়াড্রনের ‘৩০৮ বম্বার্ডমেন্ট গ্রুপ’-এর ‘বি-২৪ লিবারেটর হেভি বম্বার’ যুদ্ধবিমান। বিমানটির ডাকনাম ছিল, ‘হট অ্যাজ হেল।’ ওই বিমানে রবার্টের থাকার কথা ছিল না। কিন্তু সুসানের সঙ্গে দেখা করার জন্য মনে মনে ছটফট করতে থাকা তরুণ তখন রোজ কাজ চেয়ে নিচ্ছিলেন কর্তাদের কাছ থেকে। মাথায় সেই এক চিন্তা— বেশি বেশি কাজ করলে, তাড়াতাড়ি ছুটি মিলবে। অতএব হট অ্যাজ হেলে উঠে পড়েছিলেন রবার্ট অক্সফোর্ড। সঙ্গী ছিল আরও চারটি বিমান। উত্তর-পূর্ব ভারতে ঢুকে অত্যন্ত খারাপ আবহাওয়ার মধ্যে পড়ে মার্কিন বিমানবহরটি। পৌনে ১১টা নাগাদ দৃশ্যমানতা এক মাইলে নেমে আসে। বিপদ বুঝে দু’টি বিমানের আরোহীরা বিমান ছেড়ে প্যারাস্যুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তৃতীয় বিমানটি ভেঙে পড়ে এবং তার ধ্বংসাবশেষও উদ্ধার হয়। কিন্তু খোঁজ মেলেনি ‘হট অ্যাজ হেল’ এবং ‘হ্যালিজ কমেট’ নামে দু’টি বিমানের। অরুণাচল প্রদেশের ‘হাম্প’ এলাকায় ওই বিমান দু’টি ভেঙে পড়েছে বলে সন্দেহ ছিল। কিন্তু বহু তল্লাশিতেও সে সময় কোনও ধ্বংসাবশেষ মেলেনি। কারও দেহাবশেষও মেলেনি।

সুসান ব্রাউন— প্রায় ২০ বছর অপেক্ষায় ছিলেন প্রেমিক রবার্টের জন্য। রবার্টের মৃত্যুসংবাদ পাওয়ার পর আর বেশি দিন বাঁচেননি। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া।

নিখোঁজ হওয়ার ৬২ বছর পর হট অ্যাজ হেলের খোঁজ মেলে। ২০০৬ সালে পর্বতারোহী ওকেন তায়েং অরুণাচলের আপার সিয়াং জেলায় প্রায় ৯ হাজার ফুট উচ্চতায় বিমানটির ধ্বংসাবশেষ দেখতে পান। তার পর আমেরিকাকে সে খবর জানানো হয়। ওকেনের কথায়, “অনেক কূটনৈতিক ধাপ পেরিয়ে পেন্টাগন থেকে সরকারি দল ও বেসরকারি অভিযানকারীরা ২০০৯ সালে এখানে আসেন। তাঁদের নিয়ে তিন দিন পাহাড় চড়ে আমরা ওই এলাকায় যাই। মেলে বিমানের ধ্বাংসাবশেষ ও হাড়গোড়।” হাড়গোড়ের ডিএনএ পরীক্ষা করে জানা যায়, তা রবার্ট অক্সফোর্ডের দেহাবশেষ। সেই থেকেই দেহাবশেষ আমেরিকায় পাঠানোর তোড়জোড় চলছিল। কিন্তু লাল ফিতের ফাঁসে দীর্ঘ দিন আটকে ছিল সে প্রক্রিয়াও। সব বাধা কাটিয়ে চলতি মাসেই রবার্ট অক্সফোর্ডের দেহাংশ সরকারি ভাবে আমেরিকার হাতে তুলে দেয় ভারত সরকার।

কনকর্ডের ম্যাগনোলিয়া কবরস্থানে বহু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন রবার্টের শেষকৃত্যে। ছিলেন স্থানীয় চিনা বাসিন্দারাও। ছবি: সোশ্যাল মিডিয়া।

১৯৪৪ সালে রবার্ট নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরও সুসান ব্রাউন কিন্তু আকুল অপেক্ষায় ছিলেন। দীর্ঘ দু’দশক রবার্টের পথ চেয়ে ছিলেন। পরে এক রেভারেন্ডের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হন। কিন্তু নিঃসন্তান ছিলেন। রবার্টের স্মৃতি আঁকড়েই দিন কাটাচ্ছিলেন। ২০০৯ সালে সুসানের কাছে খবর পৌঁছেছিল রবার্ট আর নেই। ভেঙে পড়েছিলেন ভীষণ ভাবে। আর বেশি দিন বাঁচেননি। ২০১১ সালেই মারা যান।

আরও পড়ুন: ডায়ানার বায়োগ্রাফিতে এ কী লিখেছেন লেখক! পড়লে শিউরে উঠবেন

বৃহস্পতিবার বিমানে আটলান্টা পৌঁছয় ইউজিনের কফিন। সেখান থেকে সড়ক পথে পৌঁছয় জর্জিয়ার কনকর্ডে। রবিবারে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় রবার্ট অক্সফোর্ডের শেষকৃত্য হয়। রবার্টের বাবা-মা-ভাইরা আর কেউ নেই। পরিবারের পরবর্তী বিভিন্ন প্রজন্ম শেষকৃত্যে হাজির হয়েছিল। সুসানের বান্ধবী মন্টিন উইলসন এবং রবার্টের ভাইপোর স্ত্রী মেরিল রোয়ান হাজির হয়েছিলেন। চিনেও রবার্টের নাম বেশ পরিচিত। তাই কনকর্ডের চিনা বাসিন্দারাও শেষকৃত্যে যোগ দেন। চিনা রীতি অনুযায়ী কফিনের উপরে রাখেন পবিত্র কাপড়। মার্কিন বাহিনী পুরোনো বোমারু বিমান উড়িয়ে অভিবাদন জানায় রবার্টকে। আর দেহ সমাহিত হওয়ার আগে সুসান ব্রাউনের একটি ছবি সযত্নে রবার্টের কফিনের উপর রাখেন মেরিল রোয়ান। ছবিটিকে শুইয়ে দেন রবার্টের সামরিক পোশাকের উপরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE