Advertisement
E-Paper

পতন অনিবার্য বুঝেও কী করে অত শান্ত ছিলেন পাইলট সুমিত? বিমান-কাণ্ডে কথোপকথনের রেকর্ডিং থেকে যে প্রশ্ন উঠছে

ককপিটের যে কথোপকথন প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে কোনও পাইলটের নামের উল্লেখ নেই। কে কোন কথাটি বলছেন, চিহ্নিত করা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ১২:১৪
অহমদাবাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ক্যাপটেন ছিলেন পাইলট সুমিত সবরওয়াল।

অহমদাবাদের দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানের ক্যাপটেন ছিলেন পাইলট সুমিত সবরওয়াল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

১২ জুন। বেলা ১টা ৩৮ মিনিট। অহমদাবাদ বিমানবন্দরের রানওয়ে ছেড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১। তার পর ঠিক ৩২ সেকেন্ডের মাথায় বিমানটি ভেঙে পড়ে। ককপিটের ভিতর এই ৩২ সেকেন্ডে সমস্ত রহস্য কেন্দ্রীভূত। জ্বালানির সুইচ আচমকা বন্ধ করলেন কে? অভিজ্ঞ পাইলট কী ভাবে অত শান্ত হয়ে বসে ছিলেন? কো-পাইলটের ভয়ার্ত চিৎকারের মুখেও কী ভাবে এল তাঁর শান্ত, স্থির জবাব— ‘‘আমি কিছু করিনি’’! ভারতের তদন্তকারী সংস্থার প্রাথমিক রিপোর্ট পড়ে এমনই অনেক প্রশ্ন তুলছেন মার্কিন তদন্তকারীরা। যার কিছুটা অনুমান, কিছুটা বিশ্বাস এবং কিছুটা তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে উদ্ঘাটিত সত্য। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের উল্লেখ করে বুধবার এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যা তদন্তের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে।

মার্কিন আধিকারিকদের মতে, অহমদাবাদে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান দুর্ঘটনার নেপথ্যে পাইলটদের ত্রুটির সম্ভাবনাই জোরালো হচ্ছে। ভারতের এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)-র প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে সরাসরি এ কথা বলা হয়নি। তবে দুর্ঘটনার ঠিক আগের মুহূর্তে ককপিটের মধ্যে পাইলটদের কথোপকথন প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে শোনা গিয়েছে, এক জন পাইলট অন্য জনকে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘কেন তুমি জ্বালানির সুইচটা বন্ধ করে দিলে?’’ অন্য জন তার উত্তরে বলছেন, ‘‘আমি কিছু বন্ধ করিনি।’’ এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১ বিমানটিতে প্রধান ক্যাপ্টেন হিসাবে ছিলেন অভিজ্ঞ পাইলট সুমিত সবরওয়াল (৫৬)। ১৫,৬৩৮ ঘণ্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। এ ছাড়া তাঁর সঙ্গে ফার্স্ট অফিসার হিসাবে ছিলেন কো-পাইলট ক্লাইভ কুন্দর (৩২)। যে কথোপকথন প্রকাশ্যে এসেছে, তার মধ্যে কে কোন কথাটি বলেছেন, তা স্পষ্ট করা হয়নি রিপোর্টে। দাবি, গলার স্বর সম্পর্কে এখনও নিশ্চিত নন তদন্তকারীরা। কিন্তু এই কথোপকথন থেকে অনেকেই একটি বিষয়ে একমত হচ্ছেন যে, কোনও এক পাইলট জ্বালানির সুইচ বন্ধ করে থাকতে পারেন। বিমানটিতে রক্ষণাবেক্ষণগত কোনও ত্রুটি ছিল না বলেও প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে জানানো হয়েছে। কী ভাবে জ্বালানির সুইচ বন্ধ হয়ে গেল, তা নিয়ে ধোঁয়াশা নজর ঘুরিয়ে দিচ্ছে ৫৬ বছরের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেন সুমিতের দিকেই। দাবি, জ্বালানির সুইচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি শান্ত ছিলেন!

দুর্ঘটনাস্থল থেকে প্রাপ্ত যে তথ্যপ্রমাণ মার্কিন আধিকারিকেরা খতিয়ে দেখেছেন, সে বিষয়ে ওয়াকিবহালদের উল্লেখ করে নতুন রিপোর্ট প্রকাশ করেছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ফার্স্ট অফিসার বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার বিমানটি চালাচ্ছিলেন। রানওয়ে ছাড়ার পরেই তিনি অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনকে প্রশ্ন করেন, ‘কেন তুমি জ্বালানির সুইচ বন্ধ করে দিলে?’ ফার্স্ট অফিসার অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। তার পর প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান। কিন্তু ক্যাপটেন তখনও খুব শান্ত হয়ে ছিলেন।’

ভারতের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে তাদের মতামত জানার চেষ্টাও করেছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যমটি। কিন্তু রিপোর্টে দাবি, মন্ত্রকের আধিকারিকেরা এই তত্ত্বকে ‘একতরফা’ বলে দাগিয়ে দিয়েছেন এবং বাড়তি কোনও কথা এ নিয়ে বলতে চাননি। আমেরিকার ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন সেফ্‌টি বোর্ডের চেয়ারওম্যান জেনিফার হোমেনডি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ককপিটের ভয়েস রেকর্ডিং শুনতে চেয়েছেন। দাবি, এমন ভাবে তদন্তকারী সংস্থা প্রাথমিক রিপোর্ট তৈরি করেছে, যাতে সরাসরি পাইলটের ত্রুটির কথা বলা না হলেও সে দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে।

ভারতের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, রানওয়ে ছাড়ার পরেই এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটির জ্বালানির সুইচ ‘রান’ থেকে ‘কাটঅফ’-এ পৌঁছে গিয়েছিল। ফলে ইঞ্জিনে জ্বালানি পৌঁছোনো বন্ধ হয়ে যায়। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’টি ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কয়েক সেকেন্ড পরে তা চালু করা গেলেও আর বিমানটিকে বাঁচানো যায়নি। সেটি সামনের বহুতলে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ে এবং বিস্ফোরণ ঘটে। বিমান বিশেষজ্ঞেরা অনেকেই একটি বিষয়ে একমত, জ্বালানির সুইচ নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যেতে পারে না। কেউ তা বন্ধ করে না দিলে দু’টি ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার মাঝে এক সেকেন্ডের ব্যবধানও থাকত না বলে তাঁদের দাবি। সাধারণত, জ্বালানির সুইচ পাইলটেরাই ব্যবহার করে থাকেন। বিমান রানওয়ে ছাড়ার আগে এই সুইচ চালু করা হয়। ফলে চালু হয়ে যায় ইঞ্জিন। আবার বিমান অবতরণের সময়ে এই সুইচ বন্ধ করে ইঞ্জিন বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া, মাঝ-আকাশে কোনও জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে (যেমন, ইঞ্জিনে আগুন ধরে যাওয়া) এই সুইচ ব্যবহার করা হয়। ফলে সুস্থ অবস্থায় ভুল করে এই সুইচে হাত দেওয়া পাইলটের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সম্ভাবনা বাস্তবসম্মতও নয়, দাবি বিশেষজ্ঞদের।

ভারতের তদন্ত রিপোর্ট পড়ে মার্কিন বিশেষজ্ঞদের দাবি, বোয়িং বিমানটির নিয়ন্ত্রণ সম্ভবত ফার্স্ট অফিসারের হাতেই ছিল। অভিজ্ঞ পাইলট গোটা বিষয়টি পর্যালোচনা করছিলেন। ফলে এই সময়ে তাঁর হাত ফাঁকা থাকাই স্বাভাবিক। বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করছেন, এই ঘটনাটির অপরাধমূলক তদন্ত (ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন) হওয়া দরকার।

ক্যাপ্টেন সুমিতের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। দাবি, তিনি বেশ বিষণ্ণ ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর বেশ কিছু দিন ছুটিও নিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় তদন্তকারীরা এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি। সুমিত তাঁর বাবার সঙ্গে থাকতেন। বাবাকে বলেছিলেন, সময়ের আগেই অবসর নেবেন তিনি। বাকি সময়টুকু নবতিপর বাবার সঙ্গে কাটাবেন। সুমিতের বাবাও বিমান মন্ত্রকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সুমিতের এক পরিচিতের কথায়, ‘‘ও খুব মিতভাষী ছিল। কখনও মদ খেত না। কখনও রেগে যেত না। সকলের সঙ্গে আস্তে আস্তে নিচু গলায় কথা বলত।’’ এই আপাত শান্ত, মিতভাষী সুমিত কি পতন ও মৃত্যু অনিবার্য জেনেও স্বভাবসিদ্ধ ভাবেই শান্ত থাকতে পেরেছিলেন? প্রশ্ন থেকে গেল। বিমান দুর্ঘটনায় পাইলটদের আত্মঘাতী পদক্ষেপ নতুন নয়। এর আগে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনায় পাইলটের সরাসরি এবং ইচ্ছাকৃত আত্মঘাতী পদক্ষেপ প্রমাণিত হয়েছে। তবে অহমদাবাদের ঘটনার ক্ষেত্রে এখনই সে দিকে ইঙ্গিত করার সময় এসেছে বলে অনেকেই মনে করছেন না। তাঁদের মতে, তার জন্য আগে এএআইবি-র তদন্তের চূড়ান্ত রিপোর্টের অপেক্ষা করতে হবে।

Ahmedabad Plane Crash Pilot Dies Air India Plane Boeing 787 Dreamliners Plane Crash Gujrat Plane Crash
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy