এনআরসি-র পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অসমের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ।
দেশজোড়া বিতর্কের মধ্যেই এনআরসি-র পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অসমের দীর্ঘ দিনের বাসিন্দাদের একটা বড় অংশ। এনআরসি-র বিরোধিতা না করলেও দাবি উঠছে, এক জনও প্রকৃত নাগরিক যেন তালিকা থেকে বাদ না পড়েন। পাশাপাশি অভিযোগ উঠেছে, নাগরিক চিহ্নিত করার নামে সংখ্যালঘুদের হেনস্থা করা হচ্ছে।
যেমন, এনআরসি-র পদ্ধতি নিয়ে যে প্রশ্ন আছে তা স্বীকার করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল মহন্তও। অসম আন্দোলনের এক সময়ের প্রথম সারির মুখ তিনি। তাঁর কথায়, অসমকে বিদেশিমুক্ত করতে গেলে নাগরিক পঞ্জির কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু তাই বলে ৪০ লাখ মানুষ যাঁদের নাম ওঠেনি, তাঁরা সবাই বিদেশি? তিনি স্বীকার করেন, “এঁরা সবাই অনুপ্রবেশকারী, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। আমাদেরও দাবি, বৈধ নাগরিকের নাম যেন কোনও ভাবে বাদ না যায়।”
অসমের সংখ্যালঘু নেতা, জমিয়ত উলেমা হিন্দ (অসম) সভাপতি এবং এআইইউডিএফ সুপ্রিমো বদরুদ্দিন আজমলও এনআরসি-র বিরোধিতা করছেন না। তাঁর অভিযোগ, “নাগরিক চিহ্নিত করার নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে অযথা হেনস্থা করা হচ্ছে। তাঁদের বাংলাদেশি সাজানোর চেষ্টা হচ্ছে।”
আজমলের কথায় স্পষ্ট একটা বিভাজনের সুর। যেটাকে অসম প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি রিপুন বোরা বিজেপির ষড়যন্ত্র বলে ব্যাখ্যা করছেন। এই নাগরিক পঞ্জি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কংগ্রেস সরকারের আমলেই। রিপুনও বাকিদের মতো এনআরসি-র বিরোধী নন। তাঁর দাবি, ‘‘বিজেপি ২০১৯ সালের নির্বাচনকে লক্ষ রেখে সুপরিকল্পিত ভাবে নাগরিক পঞ্জির নামে সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে ফায়দা তোলার চেষ্টায়।” আর তাই, তড়িঘড়ি ভুলভ্রান্তি না শুধরেই এই তালিকা প্রকাশ করতে এত তাড়া বিজেপি সরকারের, অভিযোগ রিপুনের।
অসমের বাঙালিদেরও একটা বড় অংশের আশঙ্কা এই বিভাজনকে নিয়েই।
বস্তুত, জাতি-মাটি-ভিটি— পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসার আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মা-মাটি-মানুষের স্লোগানের মতোই বিজেপির অসম জয়ের ক্যাচ-লাইন ছিল এই স্লোগান। জাতিসত্তা, অসমের রাজনীতিতে বারে বারে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। আর সেই সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে বেআইনি অনুপ্রবেশের বিষয়টি।
তাই নাগরিক পঞ্জির বিরোধিতা করে কখনওই গলা ফাটাতে রাজি নন এখানকার বাসিন্দা বাঙালিদের একটা অংশ। জ্যোৎস্না সাহার পরিবার গুয়াহাটি শহরের অন্যতম পুরনো পরিবার। অবিভক্ত অসমে, গুয়াহাটি শহরে বিদ্যুৎ দফতরের যে ক’জন হাতে গোনা ঠিকাদার ছিলেন তার মধ্যে এক জন ছিলেন জ্যোৎস্নার স্বামী বরুণ। গত কয়েক বছর ধরে পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী তিনি।
নাগরিক পঞ্জিতে নাম লেখাতে তিনি যেতে পারেননি। সরকারি আধিকারিকরা নিজেরাই এসেছিলেন তাঁর কাছে। নাগরিক হওয়ার প্রয়োজনীয় সব নথিই তাঁরা দেখে গিয়েছিলেন। তার পরেও তাঁর নাম নেই তালিকায়। জ্যোৎস্নার আক্ষেপ, “মানুষটা কথা বলতে পারেন না। কিন্তু নাম না ওঠার কথা শুনে মনে মনে কষ্ট পেয়েছেন।” বরুণের নাম না উঠলেও তাঁর নথির ভিত্তিতেই নাম উঠেছে পরিবারের বাকিদের। বরুণের পুত্রবধূ রুনি। তিনি বলেন, “বাবার কাগজ দিয়েই নাম উঠল আমাদের সবার। এর থেকেই স্পষ্ট গোটা প্রক্রিয়াতে গলদ আছে।”
নাগরিক পঞ্জির বিরোধিতা করে কখনওই গলা ফাটাতে রাজি নন এখানকার বাসিন্দা বাঙালিদের একটা অংশ।
সেই রকম গলদের হাজার হাজার উদাহরণ মিলেছে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই। ষাটের দশকে অবিভক্ত অসমের শিলংয়ে পড়াশোনা করে বড় হওয়া তৃপ্তি রাজ্য ভাগ হওয়ার পর চাকরি করেছেন অসম সরকারের বন দফতরে। সরকারি কর্মচারী হওয়ার পরেও তাঁকে নাগরিকের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। তিনি বলেন, “তিরিশ বছর তো এখানকার মানুষের সঙ্গেই কাজ করলাম। কোনও দিন মনে হয়নি আমি অসমের কেউ নই।”
আরও পড়ুন: চূড়ান্ত তালিকায় নাম না থাকলেই ঠাঁই ডিটেনশন ক্যাম্পে? শঙ্কা অসম জুড়ে
তৃপ্তির কথায় খারাপ লাগা আছে, কিন্তু বিদ্বেষ নেই। সেই মনোভাবটাই আরও স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করলেন অভিজিৎ চক্রবর্তী বা উজ্জ্বল ভৌমিকরা, যাঁরা একসময়ে অসমে সক্রিয় রাজনীতি করতেন। এঁদের কেউ বামপন্থী রাজনীতি করতেন, আবার কেউ কংগ্রেস করতেন। এঁরা সবাই অসমের পুরনো বাসিন্দা। তাঁরা বলেন, অনুপ্রবেশ একটা বড় সমস্যা অসমের বুকে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে রাজনীতি শুরু হয়েছে। তাঁরা এনআরসি-র এই পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
অসমের বাঙালিদেরও একটা বড় অংশের আশঙ্কা এই বিভাজনকে নিয়েই। এনআরসি-র বিরোধী তাঁরা নন। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এনআরসি বিরোধিতাও তাঁরা সমর্থন করেন না। তাঁরা মনে করিয়ে দেন, এখনও অসমে জাতিসত্তার প্রভাব যথেষ্ট শক্তিশালী। এনআরসি বিরোধী জিগির তুলে সেই শক্তিকেই জাগিয়ে তুলছেন মমতা। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক বলেন, “পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এর বিরেধিতা করছেন। আর বিরোধিতা করে বিজেপির মতোই সাম্প্রদায়িক এবং জাতিগত বিভাজনকে মদত দিচ্ছেন, যা আগামী দিনে এখানকার বাংলাভাষী মানুষের পক্ষে ভয়ঙ্কর হবে।”
আরও পড়ুন: শিলচর বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হল তৃণমূলের প্রতিনিধি দলকে, পুলিশের বিরুদ্ধে হেনস্থার অভিযোগ
আর সেই কারণেই উজ্জ্বল ভৌমিক বা অসমের আরও অনেক বাংলাভাষী মানুষের আক্ষেপ, নাগরিক পঞ্জিকরণ হোক বা তার বিরোধিতা, সব কিছুতেই এক বিপুল পরিমাণ বাংলাভাষীকে অসমের বুকে গিনিপিগ বানিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। তাঁদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা চান রাজনৈতিক দলগুলির কাছে আরও মানবিকতা এবং সংবেদনশীলতা। ভাষা বা জাতিকে প্রাধান্য না দিয়ে অসম এবং অসমের মানুষকেই নিজের করে বাঁচতে চান তাঁরা।
ফাইল চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy