আবেদনকারীর সই নেই হলফনামায় স্বাক্ষর আগরতলা আদালতের আইনজীবী ও নোটারির।—নিজস্ব চিত্র।
বাংলাদেশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পশিম পাইকপাড়ায় বাড়ি মহম্মদ সাইফ উল্লাহ (৪৫)-র। জাতীয় পরিচয় পত্রের নম্বর ১২২১৩০২৩০০৯২০। কিছু দিন আগে এই ভদ্রলোকই ত্রিপুরায় এসে নোটারির মাধ্যমে একটি হলফনামা করেছেন— তিনি গত ৮ বছর ধরে আগরতলার অদূরে জয়পুরে গ্রামেই থাকেন। অথচ সাইফ উল্লাহর নাম এখনো দিব্যি রয়েছে বাংলাদেশের ভোটার তালিকায়।
এটা তো একটি উদাহরণ মাত্র। এ ভাবে বাংলাদেশের বহু মানুষই আগরতলা জেলা দায়রা আদালতে এসে আইনি ভাবে ভারতের বাসিন্দা বনে যাচ্ছেন। কোনও দুষ্টচক্রের সঙ্গে তাঁদের যোগ রয়েছে কি না, তাঁরা কোনও অপরাধে জড়িত কিনা— সেটুকু যাচাই করার সুযোগ পর্যন্ত নেই। এই হলফনামা দাখিল করেই আদতে বাংলাদেশের নাগরিকেরা দিব্যি ভারতের নাগরিক প্রমাণপত্র, এমনকী পাসপোর্ট পর্যন্ত বার করে নিচ্ছেন। অনেকে বিদেশেও যাচ্ছেন কাজের সন্ধানে।
সাইফ উল্লাহের হলফনামা করিয়েছেন আগরতলার নোটারি নির্মলকুমার পাল। বিষয়টি নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে নির্মলবাবু বলেন, ‘‘আমাদের কিছু করার নেই। কেউ যদি মিথ্যা কথা বলে, সেটাকেও আমাদের সত্য বলেই ধরে নিতে হয়।’’
নির্মলবাবুর দাবি, তাঁর কাছে আবেদনটি আসার আগে কোনও আইনজীবী স্বাক্ষর করে তা ভেরিফাই করে দেন। তখন আর তাঁর কোনও দায়িত্ব থাকে না তথ্যের সত্যাসত্য বিচারের। নির্মলবাবুর যুক্তি— নোটারির কাজে ফি এত কম, তথ্য যাচাই করা সম্ভব নয়। একই রকম আর একটি এফিডেভিটে নোটারি নির্লকুমার পালই আইনজীবী হিসেবে ভেরিফাই করে দিয়েছেন। সেটা কী করে হল, জানতে চাওয়া হলে নির্মলবাবু কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি কেবল বলেন, ‘‘যে বা যাঁরা এই কাজ করেন, তাঁরা অবশ্যই একটা অবৈধ কাজকে উত্সাহ দিচ্ছে।’’
আইনজীবী সংগঠনের সচিব ভাস্কর দেববর্মাও কার্যত মেনে নেন যে আগরতলা আদালতে এমন ব্যাপার চলছে। বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই আদালতে এসে ভারতের নাগরিক হিসাবে হলফনামা বার করে নিয়ে যাচ্ছেন। সংগঠনের কোনও সদস্য এই কাজে জড়িত থাকলে সংগঠন তাঁদের শাস্তি দেবে কি না, এই প্রশ্ন করা হলে সচিব তা এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, ‘‘কেউ যদি সত্য গোপন করে অসত্য হলফনামা করান, বা মিথ্যা জেনেও স্বাক্ষর করে তা ভেরিফাই করেন, সে ক্ষেত্রে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে।’’ সচিব জানান, কোনও আইনজীবী যদি জেনেশুনে কোনও বাংলাদেশিকে এ দেশের নাগরিকত্বের আইনি কাগজপত্র বের করে দিয়েছেন বলে প্রমাণ মেলে, তা হলে তাকে ত্রিপুরা বার অ্যাসোসিয়েশন থেকে বার করে দেওয়া হবে এবং নোটারির লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু সচিবের এই দাবির কথা শুনে হেসে ফেললেন প্রবীণ আইনজীবীদের অনেকে। বহু দিন ধরেই আগরতলা আদালতে এই কাজ চলছে বলে জানান তাঁরা। বার অ্যাসোসিয়েশন সব জেনেশুনেও কখনও তা বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়নি বলে তাঁদের অভিযোগ।
আন্দবাজারের হাতে পলাশ মিঞা নামের এমন এক বাংলাদেশির হলফনামার কপিও এসেছে, যেখানে আবেদনকারীর স্বাক্ষরটুকুও নেই, কিন্তু এক আইনজীবী তা ভেরিফাই করে সই করে দিয়েছেন।
কিন্তু দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিরাট ঝুঁকির এই কাজ বন্ধ করতে পুলিশ কী করছে? ত্রিপুরা পুলিশের আইনশৃঙ্খলা বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত শ্রী অনুরাগ বলেন, কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাঁরা দোষীদের গ্রেফতার করতেই পারেন। কিন্তু নিরন্তর এই কাজ চললেও পুলিশ কেন কোনও দিন কাউকে গ্রেফতার করেনি, সে প্রশ্ন তিনি এড়িয়ে যান। এই পুলিশকর্তা জানান, কিছু দিন আগে দুই বাংলাদেশিকে আগরতলা বিমানবন্দরে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কায়েস মিঞা ও সৌরভ মিঞা নামে এই দুই যুবক কলকাতা যাচ্ছিলেন ভারতীয় পাসপোর্টের আবেদন করতে। পুলিশ তাঁদের কাছ থেকে প্যানকার্ড পায়, যা তাঁরা আগরতলার একটি দালাল চক্রের মাধ্যমে বার করেছিল। কিন্তু সেই চক্রকে নির্মূল করতে পুলিশ কী করেছে, দফতরের কর্তারা তা জানাতে পারেননি। সাধারণ মানুষের অবশ্য অভিযোগ, কাগজপত্র বার করতে বাংলাদেশিরা যে টাকা দেন, তার ভাগ পুলিশের কাছে আসে বলেই তারা চুপ।
তবে পুলিশ কন্ট্রোলের এসপি উত্তম ভৌমিক জানান, ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের ৮৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের একটা বড় অংশে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় সে দেশের বহু নাগরিক অবাধেই যাতায়াত করেন এই রাজ্যে। তবে তাদের ধরতে টাস্ক ফোর্স তৈরি করেছে পুলিশ। ২০১৪-য় আটক করা হয়েছিল ১৩৪৮ জনকে। এ বছর মার্চ পর্যন্ত ধরা পড়েছে ২৪৭ জন। বিএসএফের মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে হলে দাবি জানিয়েছেন এই পুলিশ কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy