Advertisement
E-Paper

দেবী হয়ে বাঁচতে চান না, অনশন ভাঙলেন শর্মিলা

বিকেল ৪টে ২২ মিনিট। তাঁর ডান হাতে একটুখানি মধু ঢেলে দিলেন নার্স। কিন্তু মুখে তুলতে পারলেন না। পরের দু’মিনিট ধরে শুধুই কেঁদে চললেন। বিকেল ৪টে ২৪ মিনিট ১৪ সেকেন্ড। হাতে ঢেলে দেওয়া মধু আঙুলে নিয়ে জিভে ঠেকালেন। একটু যেন বিকৃতও করলেন মুখটা।

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

শেষ আপডেট: ১০ অগস্ট ২০১৬ ০৪:২৭
অনশন ভাঙার পর। ইম্ফলে শর্মিলা চানু। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।

অনশন ভাঙার পর। ইম্ফলে শর্মিলা চানু। মঙ্গলবার। —নিজস্ব চিত্র।

বিকেল ৪টে ২২ মিনিট। তাঁর ডান হাতে একটুখানি মধু ঢেলে দিলেন নার্স। কিন্তু মুখে তুলতে পারলেন না। পরের দু’মিনিট ধরে শুধুই কেঁদে চললেন। বিকেল ৪টে ২৪ মিনিট ১৪ সেকেন্ড। হাতে ঢেলে দেওয়া মধু আঙুলে নিয়ে জিভে ঠেকালেন। একটু যেন বিকৃতও করলেন মুখটা।

শেষ হল মণিপুর-কন্যা ইরম শর্মিলা চানুর ১৬ বছরের অনশন সত্যাগ্রহ।

তত ক্ষণে চানুর সঙ্গিনীরা ভেঙে পড়েছেন কান্নায়। সে কান্না আনন্দের নয়, তীব্র আক্রোশের। কিংকর্তব্যবিমূঢ় চানুর আন্দোলনের সেনাপতি বাবলু লোইতংবাম-ও। আশপাশে দেখা গেল না পরিবারের কাউকেই। কিন্তু চানু তাঁর সিদ্ধান্তে অটল। বললেন, “আমি দেবী হয়ে বাঁচতে চাই না। এটা আমার জীবন। সিদ্ধান্ত আমি নেব। মানুষের ওপর আস্থা রয়েছে। তাঁরা আমার পাশে থাকলে নির্বাচনে জিতে আফস্পা হটাবই।”

কিন্তু নিকটাত্মীয় থেকে শুরু করে তাঁর আন্দোলনের সঙ্গীরা, কেউই যে আপাতত চানুর ওপর আস্থা রাখছেন না, তা স্পষ্ট হয়ে গেল কিছু ক্ষণের মধ্যেই। অনশন ভাঙার আগেই দাদা সিংহজিৎ জানিয়ে দিয়েছিলেন, মা সখীদেবী চান না যে ‘পরাজিত’ মেয়ে বাড়ি ফিরুক। আজ মুক্ত হওয়ার পরে চানু অবশ্য নিজে জানান, আফস্পা এখনও প্রত্যাহার করা হয়নি। তাই বাড়ি ফিরছেন না তিনি। মায়ের সঙ্গে দেখাও করছেন না। দীর্ঘদিনের শুভানুধ্যায়ী প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা সুরেশের বাড়ি রাত কাটাতে গিয়েছিলেন চানু। কিন্তু চানুর নাম নিয়েই তৈরি করা যে সংগঠন, সেই ‘শর্মিলা কানবা লুপ’-এর প্রতিবাদে তাঁকে সুরেশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। সেখান থেকে আর একটি জায়গায় যান। প্রতিবাদী মহিলারা সেখানেও পুলিশের ভ্যান থেকে নামতে দেননি চানুকে। শেষে পুলিশ লাইনসে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। রাতে অবশ্য শরীর খারাপ হওয়ায় ফের হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে।

অনশন ভেঙে ‘দেবী’ থেকে ‘মানবী’ হওয়ার দু’ঘণ্টার মধ্যে শর্মিলা বুঝে যান, যে-মণিপুরের মুখ ছিলেন তিনি, সেই মণিপুর এখন আর তাঁর সঙ্গে নেই।

২০০০ সালের ২ নভেম্বর মালোম বাস স্ট্যান্ডে ১০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে জঙ্গি সন্দেহে হত্যা করার প্রতিবাদে এবং আফস্পা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সে বছরই ৪ নভেম্বর থেকে অনশন শুরু করেছিলেন শর্মিলা। ন’জন ভাইবোনের মধ্যে সব থেকে ছোট শর্মিলা মায়ের কাছে শপথ করেছিলেন, আফস্পা যত দিন প্রত্যাহার না-হবে, তত দিন বাড়ি ফিরবেন না, মায়ের মুখও দেখবেন না। কিন্তু গত ২৬ জুলাই অনুগামীদের পুরোপুরি অন্ধকারে রেখে আদালতে হঠাৎ শর্মিলা ঘোষণা করে বসেন, তিনি অনশন ভাঙতে চান। বিয়ে করতে চান। লড়তে চান ২০১৭ সালের নির্বাচনে।

‘দেবী’র এমন মানবিক ‘অধঃপতনে’ যে ধিক্কার সে দিন শোনা গিয়েছিল, আজও তার প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আজ সকাল সাড়ে দশটায় জওহরলাল নেহরু হাসপাতাল থেকে বার করা হয় চানুকে। সকাল ১১টায় তিনি ঢুকে যান পশ্চিম ইম্ফলের জেলা দায়রা আদালতে। বেলা ১টা ২০ মিনিটে বেরিয়ে আসেন এজলাস থেকে। জানান, জামিনের আবেদন করেছেন। পরের লক্ষ্য রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়া।

আদালত চত্বরে দাঁড়িয়ে শর্মিলার এত দিনের সঙ্গীরা বলাবলি করছেন, অনশন ভেঙে তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন শর্মিলা। অনেকে আবার বলছেন, এ সবই সরকারের চক্রান্ত। জোর করে শর্মিলাকে দিয়ে এ সব করানো হচ্ছে। শর্মিলার আন্দোলনের দীর্ঘদিনের সঙ্গী বাবলু লোইতংবামের কথায়, “স্বাধীন ভারতের সব চেয়ে বড় সত্যাগ্রহ আন্দোলন যে পরাজয় স্বীকার করল, তাতেই মন ভেঙে যাচ্ছে।”

সওয়া দু’ঘণ্টার শুনানিতে শর্মিলা ছাড়াও হাসপাতালের মেডিক্যাল টিম ও তদন্তকারী অফিসারের বক্তব্য শোনেন সিজেএম। শর্মিলা বলেন, “মানুষ আমায় সাধারণ মেয়ে হিসেবে কেন দেখে না? আমি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। অনশন ভাঙতে চাই। রাজনীতিতে নামতে চাই।’’ বাইরে বেরিয়ে শর্মিলা সাংবাদিকদেরও বলেন, “আমি মুখ্যমন্ত্রী হতে চাই। ক্ষমতা হাতে না এলে আইন বদল করা যাবে না।”

শর্মিলার আইনজীবী এল রেবেদা এ দিন জানান, এত দিন শর্মিলা ৩০৯ ধারায় (আত্মহত্যার চেষ্টা) নিজেকে অপরাধী হিসেবে মানতে রাজি ছিলেন না। রাজ্য ওই ধারায় তাঁকে অপরাধী বলে দাবি করছিল। তাই শুনানি চলছিল। এ দিন শর্মিলা যে হেতু জানান তাঁর অপরাধ জামিনযোগ্য, তাই ৩০৯ ধারার অধীনে বিচারক ১০ হাজার টাকার ব্যক্তিগত বন্ডে তাঁকে জামিন দিয়েছেন।

অর্থাৎ মুক্তির স্বার্থে এত দিনের অনশন আন্দোলনকেও এ বার অপরাধ হিসেবে মেনে নিলেন শর্মিলা!

Chanu Sharmila
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy