Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

নাগরিক পঞ্জি নিয়ে শঙ্কায় উপজাতিরাও

জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) নবীকরণ নিয়ে বরাক উপত্যকার উপজাতিরাও উদ্বেগে। তাঁদের আশঙ্কা, উপজাতি সম্প্রদায়ের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের নাম নাগরিক পঞ্জীতে উঠবে না। এ বিষয়ে আজ তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত নোডাল অফিসার প্রতীক হাজেলার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০২:৫০
Share: Save:

জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) নবীকরণ নিয়ে বরাক উপত্যকার উপজাতিরাও উদ্বেগে। তাঁদের আশঙ্কা, উপজাতি সম্প্রদায়ের ৭০ শতাংশের বেশি মানুষের নাম নাগরিক পঞ্জীতে উঠবে না। এ বিষয়ে আজ তাঁরা সুপ্রিম কোর্ট নিযুক্ত নোডাল অফিসার প্রতীক হাজেলার হস্তক্ষেপ চেয়েছেন। কাছাড়ের জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে তাঁর কাছে স্মারকপত্র পাঠায় বরাক উপত্যকার দশটি উপজাতি সংগঠনের জোট ‘অল আসাম ট্রাইবাল সঙ্ঘ’।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-সভাপতি জামুপাও কাবুই জানান, উপজাতিদের বাড়িতে আলমারি বা সিন্দুক বলে কিছু নেই। তাঁরা বাঁশের চোঙে কাগজপত্র ঢুকিয়ে রাখেন। বাঁশে ঘুনপোকা বাসা বেঁধে কাগজপত্র নষ্ট করে দেয়। এ ছাড়া, বাঁশ-বেতের ঘরে প্রায়ই আগুন লাগে, কোনও কিছু বাঁচানো সম্ভব হয় না। গোষ্ঠী সংঘর্ষের সময়ও নথিপত্র ফেলে প্রাণ নিয়ে পালাতে হয়। এ সবের চেয়ে বড় কথা, জুম চাষ করে বলে তারা কয়েক দিন পর পর জায়গা বদলান। এর দরুন উপজাতিদের অনেকের নাম ভোটার তালিকায় নেই। যাঁদের রয়েছে, উচ্চারণগত সমস্যার দরুন তাঁদেরও প্রায় সবার নাম ভুল ছাপা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘উপজাতিদের অধিকাংশই অশিক্ষিত। জন্মমৃত্যুর প্রত্যয়নপত্রের বালাই নেই তাঁদের। ফলে অধিকাংশের কাছে কোনও নথিপত্র নেই।’’

‘অল আসাম রংমাই নাগা স্টুডেন্টস ইউনিয়নের’ সভাপতি কম্বি রংমাই-এর প্রশ্ন— বিদেশি চিহ্নিতকরণের জন্যই যদি অসমে পৃথক পদ্ধতিতে এনআরসির কাজ চলছে, তা হলে উপজাতিদের কাছে নথি খোঁজা কেন?

হাইপাউ যাদুনাং, রানি গাইদিনলুর সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে তাঁরা বলেন, ‘‘কাছাড় জেলার নয়াগ্রাম থেকে ধরে নিয়ে যাদুনাংকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ব্রিটিশ। এ বার কি তাঁদের বংশধরদেরও বিদেশি বলে সন্দেহ করা হচ্ছে?’’ জনগণনার ধাঁচে কোনও ধরনের নথি ছাড়া উপজাতিদের নাম তোলার দাবিও তোলেন তাঁরা।

নোডাল অফিসারকে স্মারকপত্র দিয়েই অবশ্য সংগঠনগুলি বসে নেই। ২৮ জুন গুয়াহাটিতে সমস্ত উপজাতি জনগোষ্ঠীর শীর্ষনেতাদের নিয়ে রাজ্য পর্যায়ের বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে বর্তমান সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করা হবে। প্রয়োজনে আন্দোলনসূচি গ্রহণ করা হবে। সেই দিন এনআরসি নিয়ে আরেকটি রাজ্য পর্যায়ের বৈঠক হবে নগাঁও জেলার হোজাইয়ে। সেটি বঙ্গভাষীদের।

এনআরসি প্রসঙ্গে সরকার সুপ্রিম কোর্টের দিকে হাত তুলে নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে রাজ্যে অশান্তির সৃষ্টি হবে— সেই ইঙ্গিতও দিয়ে রাখেন বরাক উপত্যকার উপজাতি জোটের নেতারা। যে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতির জন্য সরকার দায়ী থাকবে বলে আগাম জানিয়ে রাখেন তাঁরা। চরণ তিপ্রা, দিগন্ত বর্মনরা শোনান, ‘‘উপজাতিদের এক জনের নামও যদি বাদ পড়ে আমরা তা মেনে নেব না।’’

স্মারকপত্রে তাঁরা ইতিহাস টেনে বলেন— ‘কাছাড়ে এক সময় কাছাড়ি উপজাতিদের রাজত্ব ছিল। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলকে বলা হতো উপজাতি প্রধান পিছিয়ে পড়ে এলাকা। ১৯৫০ সালে ভারত সরকার ডিমাসা, বর্মন, নাগা, মার, মিজো, কুকি, খাসি, প্নার, জয়ন্তিয়া, চাকমা, কার্বি, রিয়াং, রাংখলদের তফসিলভুক্ত করে উপজাতির স্বীকৃতি দেয়।

পরবর্তীতে আসাম সরকারও সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে একই কথা প্রকাশ করে। বর্তমানে তাদের লোকসংখ্যা আড়াই থেকে তিন লক্ষ। বরাক উপত্যকার ৬৫০টি গ্রামে তাঁরা বসবাস করেন। অনেকগুলি দু’শো বছরেরও বেশি পুরনো। ২০০৬ সালের বনবাসী অধিকার আইনেও তাঁদের বনাঞ্চলে থাকার অধিকার প্রদান করা হয়েছে।’

স্মারকপত্রে তাঁরা জানিয়েছেন, ১৯৪৮ সাল থেকে কালাইন ব্লকের মহাদেবপুর পঞ্চায়েতের মেনাম কারবি পুঞ্জি এবং উধারবন্দ ব্লকের কুম্ভা মার পুঞ্জিতে ‘হেডম্যান’ নিযুক্ত করছেন জেলাশাসক। কিন্তু ১৯৬৬ বা ১৯৭১ সালের ভোটার তালিকায় সেইসব হেডম্যান বা তাঁদের পুঞ্জির কারও নাম নেই। এই চিত্র আজও বর্তমান বলে উধারবন্দের কয়েকটি গ্রামের কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা জানান, এখন যে বিএলও’রা এনআরসি ফর্ম বিলি করছেন, তাঁরা বড় নাগাডুম মার পুঞ্জি ও নাগাডুম খাসি পুঞ্জির কথা জানেন না। কী ভাবে ওইসব এলাকার উপজাতিরা নথি জমা করবেন, নোডাল অফিসারের কাছে জানতে চায় অল আসাম ট্রাইবাল সঙ্ঘ।

বরাকভ্যালি হিল ট্রাইবস অ্যাসোসিয়েশন, রংমাই কাউন্সিল, বরাক ভ্যালি কার্বি ইউনিয়ন, মার ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন, বরাক ভ্যালি খাসি-প্নার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি, রিয়াং সোসিও কালচারাল অর্গানাইজেশনের কর্মকর্তারাও এনআরসি নিয়ে সরব থাকার কথা জানিয়ে দেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE