Advertisement
০৫ মে ২০২৪

গ্রাহকচরিত্রে মুগ্ধ ব্যাঙ্ক, হলই না হয় দুর্ভোগ, উদ্দেশ্যটা তো ভাল

দুপুরে দক্ষিণ কলকাতার ব্রাঞ্চ থেকে ম্যানেজারের ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বেসরকারি ব্যাঙ্কের বড় কর্তাটি।

টাকা তোলার ঢল নবান্নে।  ছবি: সুদীপ আচার্য।

টাকা তোলার ঢল নবান্নে। ছবি: সুদীপ আচার্য।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৬ ০৪:২১
Share: Save:

দুপুরে দক্ষিণ কলকাতার ব্রাঞ্চ থেকে ম্যানেজারের ফোন পেয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন বেসরকারি ব্যাঙ্কের বড় কর্তাটি।

ঘাবড়ানোর কারণ আছে। বৃহস্পতিবারের মতো শুক্রবারেও তাঁরা শাখায় শাখায় পর্যাপ্ত নগদ জুগিয়ে উঠতে পারেননি। ফলে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট বাধল কিনা, তা নিয়ে উদ্বেগ ছিল বিলক্ষণ। তাই রীতিমতো কম্পমান হাতে ফোন ধরেছিলেন। তবে ফোন যখন ছাড়লেন, মুখে জড়িয়ে নিবিড় প্রশান্তি। উদ্বেগের লেশমাত্র নেই!

টেবিলের উল্টো দিকে বসে বড় কর্তার চোখ-মুখের দিকে নজর রাখছিলেন মেজ, সেজ, ছোট কর্তারা। ফোনালাপ শেষে ওঁরা জানতে চাইলেন, কী হয়েছে?

‘‘অভাবিত ব্যাপার। ভাবা যায় না!’’— জবাব দিলেন বড়কর্তা। অধস্তনদের বিস্ময়ের পারদ আরও চড়ল। এ বার কর্তা খোলসা করলেন। বললেন, ‘‘ম্যানেজার জানাচ্ছেন, কাস্টমারেরা ব্যাঙ্কের সমস্যা বুঝে সহযোগিতার চূড়ান্ত করেছেন। অনেকে টাকা পাননি। তা সত্ত্বেও গোলমাল বাধাননি। বরং অনেকে টবদলের টাকা ভাগ বাঁটোয়ারা করে নিয়েছেন।’’ কী রকম?

জানা গিয়েছে, চার হাজার টাকা দু’জন দু’জন করে ভাগ করে নিয়েছেন। এবং বলেছেন, রবিবার ফের আসবেন। ফের টাকা ভাগ করে নেবেন। ‘‘ব্রাঞ্চ ম্যানেজার ভাবতে পারেননি, এমনও হতে পারে। সেটা জানাতেই ফোন করেছিলেন।’’— বললেন বড় কর্তা।

সাতসকালে লাইন দিয়ে, এত দুর্ভোগ পুইয়েও প্রাপ্য না-পেলে তো ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার কথা! উল্টে এ হেন গাঁধীগিরি?

বেসরকারি ব্যাঙ্কের বড় কর্তাটির উপলব্ধি, ‘‘পাঁচশো-হাজারের নোট বাতিলের পিছনে উদ্দেশ্যটা যে ভাল, মানুষ বোধহয় তা বুঝতে পেরেছেন।’’ ওঁর কথায়, ‘‘বৃহস্পতিবার আমি ক’টা ব্রাঞ্চে ঘুরেছি। তখন লাইনে দাঁড়ানো লোকজনের কথাবার্তা থেকে এর একটা আন্দাজ পেয়েছিলাম। আজ মনে হচ্ছে, আন্দাজটা খুব ভুল নয়।’’

বস্তুত ব্যাঙ্কের লাইনে, হাটে-বাজারে, বাসে-মেট্রোয় জনতার প্রতিক্রিয়ার মধ্যে প্রতিফলন যেন সেই মনোভাবেরই— উদ্দেশ্যটা তো ভাল! না হয় সইলামই একটু ভোগান্তি। যেমন পাইকপাড়ার বিজন সরকার। দু’দিন দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও নোটবদলের চার হাজার টাকা পাননি। বেসরকারি সংস্থার কর্মী যুবকটি এ দিন বিকেলে পাড়ার চায়ের দোকানের আড্ডায় বসে ফুঁসছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ওঁর ক্ষোভ নেই। বরং যাঁদের ‘দুষ্কর্ম’ রুখতে নরেন্দ্র মোদীকে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে হল, বিজনবাবু ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তাঁদের দিকে— ‘‘খাওয়ার পয়সা ছিল না। এখন চার-চারটে গাড়ি! ফি বছর বৌ-ছেলেমেয়ে নিয়ে ফরেন ট্রিপ! সব ক্যাশে! এ বার বোঝ ঠেলা!’’

কটাক্ষের লক্ষ্য কে?

কে কোথায় দাঁড়িয়ে

(গ্রাহকদের বিচারে)

ব্যাঙ্ক কত নম্বর (মোট ১০০)

• স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ৩০

• ইউবিআই ২০

• এইচডিএফসি ১৮

• ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া ১৮

• ইন্ডিয়ান ওভারসিজ ব্যাঙ্ক ১৭

• ব্যাঙ্ক অব বরোদা ১৫

• অ্যাক্সিস ১০

• আইসিআইসিআই ১০

আড্ডাধারীরা জানালেন, এলাকার এক ব্যবসায়ী তথা নেতার দিকে তির ছুড়েছেন বিজনবাবু। আড্ডা ছাড়ার আগে এ-ও ঘোষণা করে গিয়েছেন, ‘‘আমার টাকা সাদা। এক দিন না এক দিন ব্যাঙ্ক থেকে পাব-ই। দরকারে রোজ গিয়ে লাইন দেব।’’

বিজনবাবুর মতো অনেকেরই আশা, দু’নম্বরি টাকাওয়ালারা এ বার ‘টাইট’ খাবে। টের পেয়ে যাবে, কত ধানে কত চাল। বৃহস্পতিবার দুপুরে দক্ষিণমুখী মেট্রোর এক কামরা জুড়ে তেমনই আশাবাদের ঝলকানি। ভোরে লাইন দিয়ে বেলা দু’টো নাগাদ চার হাজার টাকা পেয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে লাফ দিয়ে কামরায় উঠলেন বছর পঞ্চান্নর শ্যামাদাস দত্ত। দরজা বন্ধ হতেই গমগমিয়ে উঠল সাউন্ডবক্স— রেলের চাকরি টাকা দিয়ে পাওয়া যায় না। কঠোর পরিশ্রম করে পরীক্ষায় পাশ করে চাকরি পেতে হয়। চাকরি পেতে দালালের কাছে যাবেন না।

আর সেই ঘোষণাই উস্কে দিল আলোচনা। শ্যামাদাসবাবুর পাশে বসা বৃদ্ধ বললেন, ‘‘দেখছেন, কী অবস্থা! দেশ দালালে ভরে গিয়েছে! বাধ্য হয়ে সরকার এখন সাবধান করছে।’’ বুকপকেটে হাত বুলিয়ে সায় দিলেন শ্যামাদাসবাবু— ‘‘এই যে রাত থাকতে উঠে লাইনে দাঁড়িয়ে টাকা তুললাম, কেন? আমরা সংসার চালাতে পাগল হচ্ছি। আর কিছু লোকের আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছে! এর শেষ হওয়া দরকার।’’ চার দিকে সমর্থনের ঝড়। এক যাত্রী মানুষের হয়রানির প্রসঙ্গ তুলতেই তাঁকে সপাটে থামিয়ে এক জন প্রায় ধমক দিলেন, ‘‘কাউকে না-জানিয়েই তো করেছে। ঠিক করেছে। একটু অসুবিধে হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু ভাল’র জন্য সেটুকু মানব না?’’ লেডিস সিট থেকেও উড়ে এল মতামত— ‘‘ছোটবেলায় আধখানা ডিম খেয়ে কত দিন কাটিয়েছি! আর ক’দিন না হয় তা-ই খাব। শেষটা তো ভাল হবে।’’এত ভাল-মন্দের কচকচানিতে অবশ্য যেতে নারাজ ফুলবাগানের গৃহবধু সুস্মিতা সরকার। কাঁকুড়গাছির ব্যাঙ্কের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে যাঁর সোজাসাপ্টা ভাষ্য, ‘‘টাকা দরকার। পাঁচশোর নোটও বদলাতে হবে। তাই লাইন দিয়েছি। সবাই কষ্টটা মেনে নিয়েছে। আমিও নিচ্ছি।’’

বৃহত্তর উদ্দেশ্যের কথা ভেবে হোক, কিংবা সকলের দেখাদেখি— গ্রাহকদের ‘মেনে নেওয়া’র চরিত্র

দেখে ব্যাঙ্ক অবাক। মুগ্ধও। বিকেলে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের এক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সহকর্মীকে বলছিলেন, ‘‘দুপুরে টাকা নিয়ে বেরনোর আগে এক বৃদ্ধ আমার চেম্বারে ঢুকে ধন্যবাদ দিয়ে গেলেন। উনি কিন্তু সকালে লাইন দিয়েছেন।’’ তা ম্যানেজারকে ধন্যবাদ কেন?

‘‘উনি বলে গেলেন, কালো টাকা ধরার প্রক্রিয়ায় জনতাকে এই ভাবে সামিল করায় ব্যাঙ্কের সাধুবাদ পাওয়া উচিত।’’— উত্তর ব্রাঞ্চ ম্যানেজারের।

ওঁদের মতে, রাসবিহারীর বৃদ্ধের মুখের কথাই এখন সকলের মনের কথা। তবে রোজকার এমন ভোগান্তি ধৈর্য্যের বাঁধে ফাটল ধরবে কিনা, তা ভেবেও চিন্তায় রয়েছেন ব্যাঙ্ককর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ATM bank banned notes
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE