Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
National

নোট বাতিলে কালো টাকার যত্সামান্যই যায় আসে

পাঁচশো বা হাজারের নোট বাতিল নীতি হিমশৈলের মাথা থেকে এক চিমটে বরফ তোলা ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না। তা হলে প্রশ্ন তোলাই যায় যে, এই নীতি গ্রহণের আগে কি তবে কতটা ত্যাগ করে কতটা পাওনা হবে তার হিসেব কষা হয়নি? নাকি পাওনার হিসেবটা অন্য কোনও ভাবে কষা হয়েছে?

সৌম্য চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০১৬ ১৬:১৬
Share: Save:

৮ নভেম্বর ২০১৬। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা – ওই দিনই রাত ১২টা থেকে ৫০০ টাকা আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল (মুদ্রারহিতকরণ নীতি)! রাজনৈতিক বাদানুবাদ, ব্যাহত ব্যাঙ্কিং পরিষেবা, এলডোরাডো খুঁজে পাবার মত টাকাভর্তি এটিএম যন্ত্র খুঁজে ফেরা, সোশাল মিডিয়ায় ঝড়, ১০০ টাকার নোট নিয়ে কালোবাজারি, মেয়ের বিয়ে বন্ধ, চিকিৎসা স্তব্ধ, বাজারের মাছি তাড়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি। সরকারের পক্ষ থেকে রাখা হল দুটি যুক্তি – প্রথমটা কালো টাকা উদ্ধারের আর দ্বিতীয়টা নকল বা জাল নোটকে অর্থনীতি থেকে মুছে ফেলার। গোয়েবলসীয় প্রচারের দৌলতে আমাদের মধ্যে অনেকেই মেনে নিয়েছি যে এই নীতি বেশ কিছু রাঘব বোয়ালকে জালে ফেলে ল্যাম্পপোস্টে ঝোলালো বলে।

আসলে নিজেদের দুর্দশার কারণ হিসাবে আমরা এখন আর ভাগ্যবিপর্যয়কে দায়ী করি না। দুর্দশার কারণ খুঁজি পাশের বাড়িতে। অমুকবাবু ভাল থাকার কারণ তার ‘সাইড ইনকাম’, তমুকবাবুর ছেলের চাকরি পাবার কারণ তার রাজনৈতিক পরিচয় ইত্যাদি। এক কথায়, আমরা অনেকে আমাদের দুর্দশার কারণকে দুর্নীতির মধ্যে খুঁজে পাই কিন্তু দুর্নীতির আসল মুখগুলো দেখতে না পেয়ে পাশের বাড়ির লোকটার সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ চালাই। মুদ্রারহিতকরণ নীতির সমর্থকরা ঠিক এই পরিস্থিতির শিকার, বা বলা ভাল সরকার বাহাদুর খুব দক্ষতার সঙ্গে আমাদের এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়েছে।

সরকারের দেওয়া যুক্তিগুলোকে ধরেই আলোচনার মধ্যে ঢুকে পড়া যাক। নোট বদলের স্বপক্ষে দেওয়া দ্বিতীয় যুক্তিটাকে বেশ ধারালো মনে হয়। এই নীতি একেবারে সরাসরি আঘাত করবে জাল নোটের ব্যবসায়ীদের। কিন্তু এই জাল টাকা আমাদের অর্থনীতির ঠিক কতটা অধিকার করে আছে এটা সঠিক ভাবে জানলে এত বড় সিদ্ধান্ত হঠকারী আখ্যা পেতেই পারে। কারণ নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে সমাজের মাঝের আর নীচের অংশের যে শ্রেণি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, যাঁরা এক বা তার বেশি দিনের মজুরির ত্যাগ স্বীকার করে সারা দিন লাইনে দাড়িয়ে পুরোন নোট বদলে নতুন নোট নেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের সংখ্যাটা বিপুল।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ৪০০ কোটি টাকার জাল নোট আমাদের অর্থনীতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্য ভাবে বললে প্রতি ১০ লক্ষ নোটে ২৫০টি নোট জাল। উল্টো দিকে, ২০১২ সালের হিসেবও যদি ধরা হয়, তবে ভারতে মোট শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি এবং গড় সর্বনিম্ন মজুরি দৈনিক ৪০০ টাকার কাছাকাছি। এই অবস্থায় একজন শ্রমিক এক দিন লাইনে দাঁড়ালে সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশে সর্বনিম্ন প্রায় ১২০ কোটি টাকার উপার্জনের সুযোগ নষ্ট হয়।

এবারে আসা যাক প্রথম যুক্তিটাতে। অর্থাৎ কালো টাকা উদ্ধারের যুক্তিতে। কালো টাকা কী? টাকা বাতিলের আগে আর পরে খুব সচেতনভাবে এমন ভাবে প্রচার চালানো হল যেন মনে হয় সঞ্চিত বিপুল অর্থ মানেই কালো টাকা যেটা নাকি বালিশের খোলে বা স্নানঘরে লুকিয়ে রাখা হয়। কিন্তু অর্থনীতি তো অন্য কিছু বলে। কোন শিক্ষক যদি শিক্ষকতার পাশাপাশি প্রাইভেট টিউশন করে অতিরিক্ত অর্থ উপার্জন করেন, এবং প্রাইভেট টিউশান থেকে উপার্জিত অর্থ যদি তিনি সরকারের কাছে প্রকাশ না করেন, তবে সে অর্থ অবশ্যই কালো। আবার কেউ যদি অনৈতিক বা বেআইনি কোনও কাজের মাধ্যমে কোনও অর্থ উপার্জন করেন তবে সেটাও কালো টাকা। যেমন কেউ যদি ড্রাগের চোরাচালান বা নারী পাচারের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থেকে অর্থ উপার্জন করেন তবে সেই উপার্জনের রঙও কালো। জেনে রাখা ভাল, বর্তমান সরকারের সংজ্ঞা অনুযায়ী, অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে থাকা লাইসেন্সবিহীন হকার, রাস্তায় বসে ব্যবসা করা সবজি বা মাছ বিক্রেতাও কালো টাকার মালিক, কেননা এঁরাও এঁদের রোজগারের হিসেব সরকারের কাছে দাখিল করেন না। এই সংজ্ঞা শুধু বিপজ্জনক নয়, অ্থনীতির তত্ত্ব অনুসারে ভীষণ ভাবে ভ্রান্তও।

আরও পড়ুন: ‘অপপ্রচারে কান দেবেন না, আমরা পারবই’

যাই হোক, প্রচারের ঠ্যালায় মনে হচ্ছে যেন সাদা ব্যবসায় পুরোটা চেকের মাধ্যমেই লেনদেন হয়, তরল অর্থ হাতে রাখার প্রয়োজনই হয় না। আবার উল্টো দিকে কালো টাকার কারবারীদের সব অর্থই তরল আকারে ধরে রাখা থাকে।

সাদা টাকার ব্যবসায়ীরা যদি তাঁদের ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ করতে পারেন তবে কালো টাকা কালো (বা সাদা) ব্যবসায় পুনরায় বিনিয়োগ হবে না কেন? কেন সেটা তরল আকারে বালিশের খোলের মধ্যে ঢুকে থাকবে? আর যদি কালো টাকা ব্যবসার মধ্যেই ঢুকে থাকে তবে তাকে নিষ্ক্রিয় করতে গেলে তো কালো টাকার উৎসে আঘাত হানতে হবে – কালো ব্যবসাগুলোকে বন্ধ করতে হবে, পাঁচশো বা হাজারের নোট বাতিল করে তা হওয়া সম্ভব নয় (পাঁচশো বা হাজারের নোট বাতিল করলে নারী পাচার বন্ধ হয়ে যাবে – এমন কথা বললে কাটা ছাগলেও মুখ ভ্যাঙচাবে)। মুশকিল হল ভারতে ভিতরে এবং বাইরে ঠিক কত পরিমাণ কালো টাকা আছে তার সাম্প্রতিক হিসাব আমাদের কাছে নেই। ২০০৭ সালে অধ্যাপক বৈদ্যনাথন হিসেব করেছিলেন ভারতের বাইরে প্রায় ৭০টি ট্যাক্স হাভেনে ভারতের প্রায় ৭০ লক্ষ কোটি কালো টাকা পড়ে আছে আর এই সময় ভারতের স্থূল অভ্যন্তরীন উৎপাদন ছিল মাত্র ৪৩ লক্ষ কোটি টাকা। আর ২০০৬ সালে অধ্যাপক ফ্রেড্রিক স্নাইডারের করা হিসেব অনুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরীন কালো টাকা ভারতের স্থূল অভ্যন্তরীন উৎপাদনের ২৩% থেকে ২৬%। এর বেশিরভাগটাই আছে তরল অর্থ হিসেবে নয়তো স্থায়ী সম্পদ হিসাবে। আয়কর দফতরের হিসেবে ভারতের মোট কালো টাকার মাত্র ৬% নাকি তরল অর্থ হিসাবে অর্থনীতির মধ্যে আছে।

পাঁচশো বা হাজারের নোট বাতিল করে তা হলে কী হল? কোটি কোটি সাধারণ মধ্যবিত্ত চাকুরিজীবী, পেনশানভোগী যাঁরা মাস পয়লা বেতন বা পেনশনের টাকা ঘরে এনেছিলেন (বেশিরভাগই পাঁচশো বা হাজারের নোটে), খাবারের জন্য, সন্তানের স্কুলে বেতন দেবার জন্য, দুধওয়ালার পাওনা মেটানোর জন্য, তাঁদের অপরিসীম দুর্ভোগ পোহাতে হল। অন্তর্জাল নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা এই কয়েক দিনে ফুলে ফেঁপে জয়ঢাক হয়ে গেল। বেশ কিছু কালো পাঁচশো বা হাজারের নোট সাধারণ মানুষের হাত দিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে বদল হয়ে এল। পাশাপাশি প্রতি হাজারে বাট্টা হিসাবে গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার নতুন কালো টাকা উদ্ভুত হল।

পাঁচশো বা হাজারের নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত তা হলে কি অর্থনীতিতে কোন প্রভাবই ফেলবে না? হ্যাঁ, এক শ্রেণির মধ্যস্বত্ত্বভোগী, সেই সমস্ত ডাক্তার যাঁরা ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে মোটা অর্থ নিয়ে প্রেস্ক্রিপশান লেখেন, উকিল সিন্ডিকেট, প্রাইভেট টিউশান পড়ানো শিক্ষক বা অধ্যাপক, রাস্তার ধারের ব্যবসায়ী এঁরা সাময়িক ভাবে অস্বস্তিতে পড়বেন। কিন্তু তাঁরাও তাঁদের যে পরিমাণ অর্থ বাড়িতে তরল আকারে রেখেছেন সেটা নিয়েই মুশকিলে পড়বেন, যে অর্থ বাজারে বিনিয়োগ করা আছে সেটা কিন্তু অক্ষতই থাকবে। কিন্তু কালো বাজারের রাঘব বোয়ালেরা যাঁরা তাঁদের কালো সম্পদকে রাতারাতি বিদেশে পাঠানোর ক্ষমতা রাখেন কিংবা রাজনীতির সেই সব সেজো, মেজো বা ছোট নেতারা যাঁরা কালো টাকাকে স্থায়ী সম্পদে (জমি, সোনা, চালকল ইত্যাদি) পরিণত করে রাখার ক্ষমতা রাখেন তাঁদের গায়ে আঁচরটিও পড়বে না। মানে পাঁচশো বা হাজারের নোট বাতিল নীতি হিমশৈলের মাথা থেকে এক চিমটে বরফ তোলা ছাড়া আর কিছু করতে পারবে না। তা হলে প্রশ্ন তোলাই যায় যে, এই নীতি গ্রহণের আগে কি তবে কতটা ত্যাগ করে কতটা পাওনা হবে তার হিসেব কষা হয়নি? নাকি পাওনার হিসেবটা অন্য কোনও ভাবে কষা হয়েছে?

আরও পড়ুন: হিসেব কষেই হাহাকার, লক্ষ্য ডিজিটাল লেনদেন

অনেকে বলছেন আসন্ন উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে বেকায়দায় ফেলাটা নাকি এই অন্য পাওনার হিসেবের মধ্যে পড়ে। রাজনৈতিক দল রাজনৈতিক পাওনা বুঝে নেবে এর মধ্যে অন্যায় কিছু দেখছি না। কিন্তু পাওনাটা যদি অন্য রকম হয়, মানে পাওনার রংটা যদি কালো হয় তবে...? স্পেনসার বা রিলায়েন্সের মত খুচরো ব্যবসা চালানো দোকানগুলো যারা ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমে ব্যবসা চালায়, এই কয়েক দিনে তাদের লাভের অঙ্কটা দেখলে সন্দেহবাতিক মনের মধ্যে কুচিন্তা উঁকি দেয়!

বাজারে হাত বদল হতে থাকা মোট অর্থজোগানের ৮৪% বর্তমানে ৫০০ টাকা আর ১০০০ টাকার নোটের আকারে আছে বা বলা ভাল ছিল। হঠাৎ করে এই ৮৪% অর্থ ছেঁড়া কাগজের টুকরোতে পরিণত হবার পর অর্থজোগান কমে যাওয়ার ফলাফল কী হবে? অর্থনীতিতে যে কোনও কর্মসূচির ফলাফল দু’দিক থেকে বিচার করা হয় - স্বল্পকালীন ফল আর দীর্ঘকালীন ফল।

স্বল্পকালে, অর্থজোগান কমে যাওয়ায়, দৈনিক মজুরি প্রাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। যেমন - জমির মালিকের হাতে টাকা না থাকায়, দিনমজুর সাময়িকভাবে তার মজুরি থেকে বঞ্চিত হবেন। অর্থজোগানের সঙ্গে সঙ্গে সঙ্কুচিত চাহিদার কারণে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের স্বনিযুক্ত ব্যক্তিরা (যেমন রাস্তার হকার) ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। একই ভাবে, সঙ্কুচিত চাহিদার কারণে, দেশের দ্রব্য আর সেবাসামগ্রীর চাহিদা কমবে। ফলে উৎপাদন আর কর্মসংস্থান কমবে – এটা একরকম নিশ্চিত। আমরা মুদ্রারহিতকরণ নীতি চালুর আগে থেকেই সঙ্কুচিত চাহিদার সমস্যার মধ্যে ঢুকে রয়েছি। হঠাৎ করে অর্থজোগান কমে যাওয়ায়, এই সমস্যা আরও প্রকট হবে। যাঁরা পচনশীল দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করেন (মাছের আড়তদার, সবজির পাইকারী বিক্রেতা ইত্যাদি), তাঁরা ক্রমাগত দাম হ্রাসের সমস্যার সম্মুখিন হবেন, হচ্ছেনও।

মনে রাখতে হবে, সপ্তাহে টাকা তোলার সর্ব্বোচ্চ সীমা কিন্তু মাত্র চব্বিশ হাজার। সুতরাং কার্যকরী পুঁজির অভাবে ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা বাজারে পণ্য জোগান কমাতে বাধ্য হবেন। এই জোগান অপ্রতুলতার কারণে, প্রান্তিক ক্রেতার দল, যাঁরা পাঁচশো বা হাজারের নোটে কেনাকাটা করেন না, তাঁরাও তাঁদের প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন।

সম্ভবত, পণ্য এবং যাত্রী পরিবহণ শিল্প, যেখানে প্রায় ৮০% লেনদেন তরল অর্থের মাধ্যমে হয়, সাংঘাতিক ভাবে প্রভাবিত হবে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রত্যেক পণ্যবাহী ট্রাক পথখরচা হিসাবে প্রত্যেক দিন ৩৫ হাজার টাকা খরচা করতে পারে। তা হলে একজন পরিবহণ ব্যবসায়ীর ১০টা ট্রাক থাকলে সেই ব্যবসায়ীর দৈনন্দিন খরচ হয় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ওঠানোর ঊর্ধ্বসীমার নিরিখে টাকার অঙ্কটা অনেকটাই বেশি। তাই সাধারণ মানুষকে তৈরি থাকতে হবে খুব তাড়াতাড়ি সেই দিনের মুখোমুখি হবার জন্য, যে দিন হয়ত সকালে দুধ বা সব্জি বাজারে আসবে না, পাম্পগুলোতে তেল মিলবে না বা রান্নার গ্যাসের জোগান কমে আসবে আর এই সবের হাত ধরে আসবে ফাটকা কারবার। এক কথায় সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি সংকুচিত হবে। এই ভাবে অর্থনীতির আকস্মিক সংকোচনের প্রভাব কতটা গভীর হবে এটা নির্ভর করবে অর্থজোগান আবার স্বাভাবিক হতে কতটা সময় নেবে তার উপর। দেশের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে থাকা দুই লক্ষাধিক এটিএম মেশিনের সফটওয়ার এবং হার্ডওয়ারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করে মুদ্রা জোগানকে আবার স্বাভাবিক করার কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন ও সময় সাপেক্ষ।

গোয়েবলসীয় প্রচার বলছে এতে দীর্ঘকালে দেশের ভাল হবে। কিন্তু কী ভাবে সে ব্যাপারে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য বাখ্যা মিলছে না। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনস তাঁর ‘দ্য ট্র্যাক্ট অন মনিটরি রিফর্ম’ (১৯২৩) প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “এই দীর্ঘ মেয়াদ ব্যাপারটা হল বর্তমান ঘটনাপ্রবাহকে বিপথগামী করা এক গাইড। দীর্ঘ মেয়াদে আমরা সবাই মৃত।” আসলে এই দীর্ঘ কাল ব্যাপারটা ঠিক কবে যে আসবে কেউ জানে না। কোনও না কোনও দিন দেশের অর্থজোগান স্বাভাবিক হবে; ব্যাঙ্কগুলোতে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু হবে; এটিএম মেশিনগুলো থেকে আবার টাকা বেরোতে শুরু করবে; পাঁচশো টাকা হাজার টাকার সঙ্গে দুহাজারি নোটে বাজার ভর্তি হবে; বেআইনি ব্যবসা থেকে কালো টাকার স্রোত অর্থনীতিতে যথা নিয়মে অবিরত বইতে থাকবে; দেশ থেকে কালো টাকা বিদেশ পাড়ি দেবে; হাওলা, কয়লা, টেলিকমের মত কেলেঙ্কারি মাঝে মাঝে আমাদের চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলবে; সীমান্তপারের জাল নোটের কারবারীরা তাদের উৎপাদন প্রকৌশলকে আধুনিকতর করে নতুন নোটের জাল করবে ইত্যাদি। মানে এক কথায় দেশে কিছুই হবে না।

আরও পড়ুন: ছুটি নেই রবিবার, শালবনি টাকা ছাপছে ২৪ ঘণ্টা

সব শেষে একটা ছোট প্রশ্ন। ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে এবং গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিগত মালিকানার অধিকার স্বীকৃত। ব্যাঙ্কে গচ্ছিত সাধারণের কষ্টার্জিত অর্থকে এই ভাবে আটক করে রাখা (যেটা চাওয়ামাত্র পাওয়ার অধিকার দ্বারা সুরক্ষিত), যথেষ্ঠ মাত্রায় নোটের জোগানকে নিশ্চিত না করে মুদ্রা বদলের সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করে জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলা, মানুষের ন্যূনতম জীবন ধারনের অধিকারকে অসুরক্ষিত করার অধিকার কি আদৌ একটা গনতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের আছে?

(লেখক বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation Black Money
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE