Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Demonisation

নোট বাতিলে আর্থিক উন্নতি কী ভাবে হবে, আমার মাথায় ঢুকছে না

টিভি খুললেই প্রত্যহ দেখা যায় ব্যাঙ্কগুলোর সামনে লাইনের অজগর। ভোর পাঁচটা থেকে অসংখ্য মানুষের ভিড়। কেউ টাকা পাচ্ছেন, কেউ না পেয়ে পরের দিন আবার ফিরে আসছেন, প্রয়োজনে দশ কিলোমিটার হেঁটে। এঁদের অধিকাংশই গ্রামের মানুষ। হাতে সার কেনার টাকা নেই, কাজেই চাষ হবে কেমন করে?

অর্থনৈতিক উন্নয়নের নোট বাতিল তত্ত্ব

অর্থনৈতিক উন্নয়নের নোট বাতিল তত্ত্ব

দীপংকর দাশগুপ্ত
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৬ ১৫:৪৫
Share: Save:

টিভি খুললেই প্রত্যেক দিন দেখা যায় ব্যাঙ্কগুলোর সামনে লাইনের অজগর। ভোর পাঁচটা থেকে অসংখ্য মানুষের ভিড়। কেউ টাকা পাচ্ছেন, কেউ না পেয়ে পরের দিন আবার ফিরে আসছেন, প্রয়োজনে দশ কিলোমিটার হেঁটে।

এঁদের অধিকাংশই গ্রামের মানুষ। হাতে সার কেনার টাকা নেই, কাজেই চাষ হবে কেমন করে? সংসার চলবে কী করে? তবু আশায় বাঁচে চাষা, ঘুরে ঘুরে আসেন রোজ। কষ্ট হচ্ছে খুব? সাংবাদিকেরা জিজ্ঞেস করেন। হ্যাঁ, হচ্ছে তো কষ্ট, কিন্তু ও কষ্ট মেনে নিতে আপত্তি নেই। দেশের ভালর জন্য আমরা সকলে কিছু দিন কষ্ট মেনে নিতে রাজি। আর কেবল গ্রাম থেকে আগত প্রবীণ চাষিই যে এমন কথা বলছেন তা নয়। অনেক শহরবাসীর মুখেও একই বার্তা শোনা যাচ্ছে। দেশের উন্নয়নের জন্য সকলেই স্বার্থ ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এঁরা কেউ রাজনীতি করেন না, রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব কষেন না। একেবারেই সরল বিশ্বাসের জোরেই কথা বলেন।

তাই একটা অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে। দেশের ঠিক কী ধরনের উন্নতি আমরা আশা করছি?

বলাই বাহুল্য, অর্থনৈতিক উন্নতির কথাই নিশ্চয়ই এখানে চিন্তা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক উন্নতি বলতে কীসের কথা আমরা ভাবব? আমাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার কি বাড়বে? আমাদের কর্মসংস্থানের হার কি ঊর্ধ্বমুখী হবে? আমাদের দেশের আয়বৈষম্য কি কমে যাবে? আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে চলতি খাতে ঘাটতির কি সুরাহা হবে? আমাদের দেশের নিরক্ষরতা সমস্যা দূর হয়ে সাধারণ মানুষের আয় ক্ষমতা কি জোরদার হবে? দেশের কোন উন্নতির ছবি এঁরা দেখছেন? একটু চিন্তা করলেই দেখা যাবে এত গুরুতর কোনও আলোচনা তাঁদের চিন্তায় জায়গা পায়নি। তাঁরা দেশের মঙ্গল বলতে বোঝেন, চোর ধরা। যেমন পাড়ায় চোর ধরা পড়লে সকলেই দু-চার ঘা লাগিয়ে দিয়ে মনে খুশির ছোঁওয়া পান, সে রকমই কোনও একটা মানসিকতা থেকে এঁরা নোট বাতিলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাচ্ছেন। দেশে চোর-ডাকাত কমাটা মঙ্গল সংবাদ। কিন্তু, চোর ডাকাত কমার সঙ্গে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ঠিক কী যোগাযোগ, তা নিয়ে কারওরই হয়তো খুব স্পষ্ট ধারণা নেই। আর তাঁদের ধারণা যতটা অস্পষ্ট থাকে রাজনীতির দুনিয়ার ততই সুবিধা।

নোট বাতিল হলে কি চুরি কমে?

এখন আমরা সকলেই জানি যে, তেমনটা বোধহয় মনে করার কারণ নেই। এক দল নতুন দালাল জুটেছে, যারা নোট বদল করে দিয়ে আয় করতে শুরু করেছে। ৫০০ টাকার নোট তারা কিনছে হয়তো বা ৩০০ বা ৪০০ টাকায়। আর তাদের লাভের গুড় কিন্তু কালো টাকা। অর্থাৎ পুরনো কালো টাকার নোট বদলে কড়কড়ে নতুন ছাপানো কালো টাকা তৈরি হয়ে চলেছে। আর কালো টাকা যদিও বা নাকচ হয়ে যাচ্ছে, কালো কারবারি কিন্তু ধরা পড়ছে না। মাঝখান থেকে বাজারে কেনাকাটা বন্ধ। না পারছে বিক্রেতা পুরনো নোট গ্রহণ করতে, না পারছে ক্রেতা পুরনো নোট ব্যবহার করতে। কাজেই সাধারণ খুচরো বাজারে বেচাকেনা বন্ধ। ফলে পাইকারি বাজারেও কেনাবেচা বন্ধ। এই সমস্ত বাজারে যে অতি সাধারণ মুটে-মজুররা কাজ করেন, তাঁদের দৈনিক আয়ের পথ বন্ধ। তাঁদের দিন কেমন করে কাটছে সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু কালো টাকার মালিকদের কি খাওয়া দাওয়ায় কোনও ঘাটতি হচ্ছে? যদি ধরা পড়েও, তা হলেও তো কর ও পেনাল্টি দিয়ে তাদের দায়িত্ব শেষ। ১০০ কোটি টাকার মালিকের যদি ১০ কোটি টাকাও পকেটে থেকে যায়, তার অবস্থা কি ঠিক গরিব রিকশাওয়ালার সমতুল্য হবে কখনই?

বাজারে নতুন ২০০০ টাকা নোট নিয়ে এল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক

তবে সে কথা যাক। আমাদের জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার কি বাড়তে চলেছে? অদূর ভবিষ্যতে সেটা কেমন করে সম্ভব? সাধারণ সব্জি থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বিক্রিই যদি কমে যায়, তা হলে তো জাতীয় উৎপাদন কমে, বাড়ে না। জাতীয় উৎপাদনের সংজ্ঞাটা তো তাই বলে। সমস্ত পণ্য মিলিয়ে এক বছরের মোট বিক্রির অঙ্কটাই তো জাতীয় উৎপাদন। অন্য দিকে, এই জাতীয় উৎপাদনই তো জাতীয় আয়, কারণ বিক্রির টাকাটাই তো বিভিন্ন আকারে মানুষের পকেটে যায়। কেউ পায় মুনাফা, কেউ পায় মজুরি, কেউ পায় ভাড়ার টাকা এমন কত কী! তা হলে কেনাবেচার পথ যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তবে জাতীয় উৎপাদনটা সৃষ্টি হবে কেমন করে। যদি আগামী তিন চার মাসের বিক্রি অকস্মাৎ তার আগের তিন চার মাসের তুলনায় কমে যায় তবে জাতীয় উৎপাদন তো কমে গেল। অর্থাৎ ত্রৈমাসিক হিসাব ধরে এগোলে জাতীয় উৎপাদনের বৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। এমনিতেই এপ্রিল থেকে জুন মাস অবধি আমাদের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল। তাই বাকি বছর বৃদ্ধির হার বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। এ দিকে, নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের ফলে আর যাই হোক বৃদ্ধির হারে গতি ফিরে আসার তো কোনও সম্ভাবনাই নেই।

কাজেই জাতীয় উৎপাদনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে আম জনতার খুশি হওয়ার কোনও কারণই নেই। তা হলে কি আমাদের কর্মসংস্থানের হার বাড়তে চলেছে? সেটাই বা কেমন করে সম্ভব? কোনও উৎপাদক বিক্রির হার কমে যাচ্ছে দেখে হঠাৎ অনেক কর্মী নিয়োগ করবেন এমন ভাবার কি কোনও কারণ আছে? অবশ্যই না। তা হলে এই কারণেও সাধারণ মানুষের খুশি হওয়ার বিশেষ কোনও অর্থ নেই। তবে কি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে আমরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাব? যদিও ব্যাঙ্কের সামনে অপেক্ষারত লোকজনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ে বিশেষ চিন্তাভাবনা নেই। তবুও ঠিক কী কারণে নোট বাতিল করে দিলে আমাদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গতি আসবে সেটা হয়তো কোনও জটিল তত্ত্ব দিয়ে প্রমাণ করা যেতেও পারে। কিন্তু সেই তত্ত্ব ঠিক কি ভুল কে বিচার করবে? নিরক্ষরতা দূর হবে কি? এটা স্কুলের টিচারদের জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। তাঁরা কি সাদা টাকায় প্রাইভেট টিউশন দিতে শুরু করবেন?

এ দিকে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়ে চলেছে। তার উপর তো ব্যাঙ্কগুলোকে সুদ গুণতে হবে। কাজেই সুদের হার কমতে বাধ্য। সুদের হার কমলে আবারও সুদের আয় থেকে যে বৃদ্ধের সংসার চলে তিনি পড়বেন বিপদে। এটা নোট বাতিলের সমস্যা নয়। এটা হল আয় কমে যাওয়ার বিপদ। যদি আয় না থাকে তবে বড় ছোট কোনও নোটই তো মানুষের হাতে আসবে না। আর অন্য দিকে গ্রামাঞ্চলে, যেখানে ব্যাঙ্ক নেই বললেই চলে, সেখানে গরিব লোকের টাকা কে জোগাবে? হয়তো বা মহাজন আর সেই মহাজন কিন্তু সুদ কমাবেন না। বরং নোটের ঘাটতির সুযোগ নিয়ে তিনি হয়তো বিপুল সুদে টাকা ধার দেবেন। এমন কাণ্ড যদি মাস কয়েকও চলে তবে গরিব চাষির ঋণের বোঝা তো আরও অনেক বেড়ে যাবে। সেই ঋণ শোধ হবে কেমন করে?

তাই বোঝা কঠিন ঠিক কোন জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটাবে নোট বাতিল সিদ্ধান্ত। তবে আশা করতে ক্ষতি কি? আগেই তো আমরা বলেছি, আশায় বাঁচে চাষা।

লেখক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonisation Black Money Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE