বিধায়কের সঙ্গে দেখা করতে গেলে পুলিশ ঢুকতে দেবে না, এ আবার কেমন কথা! বরং উল্টো দৃশ্যই নজরে পড়ে শিলচরে, দিলীপকুমার পালের বাড়িতে। সামনে এতদিন যেখানে ছোটখাট বাগান ছিল, সেখানেই এখন ‘ভিজিটর্স রুম’ তৈরি হয়েছে। পাতা হয়েছে সোফা-সেট, রয়েছে একাধিক পেডেস্ট্রিয়াল ফ্যান।
দিলীপবাবু এ বার শুধু শিলচরের বিধায়ক নন, বিধানসভারও ডেপুটি স্পিকার। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে। দিসপুরে নিয়মিত অফিস যেতে হয়। ফলে এখন আর এলাকায় খুব বেশি সময় দিতে পারেন না। যে দু-চারদিন শিলচরে থাকেন, ভিড় বেড়ে যায় বাড়িতে। তাই বলে বিধায়ক-সাক্ষাতে গিয়ে হতাশ হয়ে ফেরার আশঙ্কা নেই। ডেপুটি স্পিকার হওয়ার পরও নয়।
তার চেয়েও বড় কথা, দর্শনার্থীদের সকলের নিজের কথা বলা হোক বা না হোক দিলীপবাবুর বাড়িতে গিয়ে কারও খালিমুখে ফেরার সুযোগ নেই। যে ঘরে গিয়েই বসুন, বা জায়গা না পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন, লাড্ডু খেতেই হবে। কিন্তু শুধু বাড়িতে বসতে দিয়ে আর লাড্ডু খাইয়েই কি মানুষের মন রাখা সম্ভব? ২০১১-র নির্বাচনে শিলচর আসনে সুস্মিতা দেব বিধায়ক হয়েছিলেন। তার আগে ছিলেন বীথিকা দেব। ২০১৪-র উপনির্বাচনে সেই আসন নিজের দখলে নেন দিলীপবাবু। কংগ্রেস আমলেই তাদের জেলা সভাপতি অরুণ দত্তমজুমদারকে ৩৭ হাজার ভোটে হারিয়ে ছিলেন। ১৬-র ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বীথিকাদেবী। ব্যবধান এ বার আরও বাড়ান তিনি।
তাঁর প্রতি মানুষের এই যে আস্থা, তার চাপ আগামী পাঁচ বছর তাঁর পিছু ছাড়বে না। আর সব মানুষের প্রত্যাশা পূরণ কী আর সম্ভব! বিষয়টি যে বড় কঠিন, বোঝেন দিলীপবাবুও। বললেন, এলাকার সমস্যা সমাধানে তিনি সারাক্ষণ কাজ করে যাবেন। ব্যক্তিগত ভাবে প্রতিটি ভোটারের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন সে সব মিটিয়ে দিতে। তবে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজের বৃহৎ অংশের মানুষের উপকারেই তিনি বেশি আগ্রহী।
দিলীপবাবু জানান, প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্ত রাস্তাঘাট মেরামতির জন্য প্রয়োজনীয় তদ্বির করে চলেছেন। পুরনো সরকার এ নিয়ে অনেক অনিয়ম করে গিয়েছে। ফলে কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। অধিকাংশ রাস্তার জন্য নতুন করে এস্টিমেট করতে হচ্ছে। প্রোজেক্ট রিপোর্ট তৈরি, বিভিন্ন সরকারি প্রক্রিয়া মেনে অর্থ মঞ্জুরি—এতসবের জন্য দু’-তিনমাস মোটেও যথেষ্ট নয় বলে জানান দিলীপবাবু।
রাস্তার পরই তাঁর লক্ষ্য পানীয় জল সমস্যার সমাধান। সকলের জন্য পানীয় জল নিশ্চিত করতে চান তিনি। সঙ্গে যে সব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানোরও পরিকল্পনা তাঁর। জানান, সেই লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। দীনদয়াল উপাধ্যায় বিদ্যুৎ যোজনায় প্রতিটি বাড়িতে তিনি আলো জ্বালানোর অঙ্গীকার করেন। সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চান। দিলীপবাবু জানান, ইতিবাচক চিন্তাভাবনার, স্বচ্ছ ভাবমূর্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের তিনি সর্ব ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেওয়ার পক্ষপাতী। তাঁর কথায়, ‘‘সরকারি স্কুলগুলিতে সরকার সব ধরনের সুযোগসুবিধে দিচ্ছে। কিন্তু এক দল মানুষের আন্তরিকতার অভাবে ভাল ফল মিলছে না। রাজনৈতিক চাপও সেজন্য কম দায়ী নয়।’’ এই অবস্থার পরিবর্তন চান তিনি। শিলচর জেলা গ্রন্থাগার আধুনিকীকরন, নিউ শিলচরে প্রেক্ষাগৃহ তৈরি, খেলার মাঠ ও পার্ক তৈরি-সহ বিভিন্ন পরিকল্পনার কথাও শোনান দিলীপবাবু।
দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁরা যে সরকারে এসেছেন, সে কথা তিনি নিজেই উল্লেখ করেন। তাঁর দাবি, সে দিকে তিনি সতর্ক। দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ মিললে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দিলীপবাবুর বিশ্বাস, পাঁচ বছরে জনগণের জন্য প্রচুর কাজ করা সম্ভব। পছন্দের বিধায়ক ডেপুটি স্পিকার হওয়ায় তাঁর ঘনিষ্টজনদের মুখ ভার ছিল বেশ কয়েকদিন। দিলীপবাবুকে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে তাঁদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকেও দলীয় নেতৃত্ব অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে বলে আশঙ্কায় ছিলেন তাঁরা। তবে সাংগঠনিক নির্বাচনের সময় তিনি তাঁদের বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রোটোকল মেনেও সব সময় তিনি ঘনিষ্টজনদের পাশেই থাকবেন। এর যেমন ইতিবাচক দিক রয়েছে, তেমনই একটা নেতিবাচক চর্চাও শোনা যাচ্ছে। সাংগঠনিক নির্বাচনে তাঁর পছন্দের প্রার্থী শহর কমিটি ও ব্লক কমিটি দুই জায়গাতেই পরাস্ত হয়েছেন। অনেকের বক্তব্য, সংগঠনে দিলীপবাবু কোণঠাসা। নইলে কি আর মন্ত্রিত্বের বদলে ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়!
দিলীপবাবুর বক্তব্য ভিন্ন। তাঁর সোজা কথা, দলের ভিতরে কি বাইরে, দুর্নীতিগ্রস্তদের সঙ্গে তিনি নেই। ফলে তাঁদের সঙ্গে ব্যবধান বাড়লেও চিন্তিত নন তিনি। দুই জায়গাতেই তাঁর ঘনিষ্ঠরা পরাস্ত হলেও তিনি নিজেকে কোণঠাসা বলে মানতে যে রাজি নন, তা ইঙ্গিতেই স্পষ্ট করে দেন। তাঁর মন্তব্য, ‘‘সাংগঠনিক নির্বাচন দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এ নিয়ে বাইরে মুখ খুলব না।’’
আর মন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে নানা কথায় শিলচরের বিধায়ক স্মরণ করিয়ে দেন, ভোট গণনার দিনেই তিনি বলেছিলেন, চারবারের বিধায়ক পরিমল শুক্লবৈদ্যই মন্ত্রী হবেন। তাঁর দাবি, ‘‘মন্ত্রিত্বের জন্য লালায়িত ছিলাম না। এখনও নই।’’ ডেপুটি স্পিকার হওয়াটাই তাঁর কাছে বিরাট প্রাপ্তি বলে মনে করেন দিলীপবাবু। অতীত আউড়ে তিনি বলেন, ‘‘মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম। বড় ছেলে হিসেবে ছাত্রাবস্থায়ই দোকানে বসতে হয়েছে। এর মধ্যেই স্নাতক হই।’’ তাঁর কথায়, ‘দলের প্রতি শুরু থেকেই অনুগত ছিলাম। এরই সুবাদে ভোটের রাজনীতিতে প্রথমে পুরসভার সদস্য হই। সবাই মিলে সে বার বিরোধী দলনেতা মনোনীত করেন। ২০১৪-র উপনির্বাচনে প্রথম বিধায়ক। দু’বছরের মধ্যে ফের জিতে ডেপুটি স্পিকার।’’ দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘গুরুদেব, সাধুসন্ত ও গুরুজনদের আশীর্বাদ আমার ওপর রয়েছে বলেই তা সম্ভব হয়েছে।’’ স্ত্রী, কন্যা, ভাইদের সাহায্যের কথাও উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, ‘‘তাদেরও এ ব্যাপারে বিরাট দান রয়েছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy