সদ্য কুড়িতে পা দেওয়া ছটফটে তরুণীর জন্য বোয়িং ৭৮৭ ছিল স্বপ্ন-উড়ান। প্রথম বার দূরপাল্লার বিমানে লন্ডন পাড়ি। পেশাদারি আদবকায়দা, ধোপদুরস্ত ইউনিফর্মে চাপা পড়েনি সেই উচ্ছ্বাস। ড্রিমলাইনারে উঠেই বাবা-মা, দিদি-বোন, বন্ধুদের দেখানোর জন্য সেলফি, ভিডিয়ো তোলায় ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন ইম্ফলের নানথোই শর্মা কোংব্রাইলাতপাম। মেইতেই সম্প্রদায়ের মেয়ে।
সোনায় সোহাগা! একই বিমানে ছিলেন নিজের পাড়াতুতো দিদি লালনুনথিয়েম সিংসন। কুকি। তবে ইম্ফলেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তাই মেইতেই ভাষায় চোস্ত। দুই তরুণী অতএব উড়ানে নিজেদের ভাষায় কথা বলার সঙ্গী পেয়েছিলেন। মণিপুরে সংঘর্ষ ছড়ানোর পরে সিংসনের পরিবার ইম্ফলের পাট চুকিয়ে সদর হিলের কাঙ্গুইতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু সেই আগুনের আঁচ পড়েনি নানথোই আর সিংসনের সম্পর্কে। যাত্রীরা ওঠার আগে সিংসন-ও নানথোইয়ের মতোই মোবাইলে ভিডিয়ো তোলায় ব্যস্ত ছিলেন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে মুখোমুখি ধাক্কা দু’জনের। হেসে মেইতেই ভাষায় ঠাট্টা ছুড়ে দিয়ে ফের স্ক্রিনে নজর দেন তাঁরা। তখনও জানা নেই, এটাই তাঁদের শেষ ছবি হতে চলেছে!
বিমান দুর্ঘটনার পরে মণিপুরের পাহাড় ও সমতল, দুই জায়গাতেই শোকের ছায়া। রাজ্যে সংঘর্ষ ও সাম্প্রদায়িক দ্বেষ থাকলেও ভিন্ রাজ্যের কর্মক্ষেত্রে কুকি-মেইতেইদের মধ্যে কখনও হিংসা, রেষারেষির ঘটনা সামনে আসেনি। এয়ার ইন্ডিয়ার দুই কেবিন ক্রু সিংসন আর নানথোই-ও একসঙ্গে উড়ানে যাত্রী সামলাতেন। সিংসনের জন্ম ১৯৯৯ সালে, নানথোইয়ের জন্ম ২০০৫ সালে। বয়সে ছোট নানথোইকে বোনের মতোই দেখতেন সিংসন। লন্ডনগামী এআই ১৭১ ড্রিমলাইনার বিমানের অভিশপ্ত যাত্রাতেও তাঁরা কাছছাড়া হলেন না।
মণিপুরের থৌবালে নানথোইয়ের বাড়িতে এখন শুধুই কান্নার রোল। বিমান ভেঙে পড়ার খবর আসতেই পাড়ার লোক একে একে জড়ো হতে থাকেন বাড়িতে। নানথোইয়ের বাবা ঘটনার পর থেকেই একই জায়গায় চুপ করে বসে। মা কেঁদে চলেছেন অঝোরে। বোন খবর শুনে জ্ঞান হারিয়েছিল। একই ছবি সিংসন পরিবারে। সংঘর্ষে ঘরবাড়ি হারানোর পরে কোনও মতে নতুন আস্তানায় থিতু হয়েছিল পরিবারটি। ভরসা ছিল দিল্লিতে থেকে বিমানসংস্থায় চাকরি করা মেয়ের রোজগারই। তা-ও চলে গেল। অবশ্য এয়ার ইন্ডিয়ার তরফে মৃতদের প্রত্যেকের পরিবারের জন্য ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ ঘোষণা হয়েছে।
নানথোই ও সিংসন তাঁদের সহকর্মী জীবনে যে মৈত্রীর বার্তা দিয়ে গেলেন, শোকের সিঁড়িতে পা রেখেই মণিপুরের পাহাড় ও সমতলের মধ্যে তা নতুন সেতু গড়বে কি?
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)