Advertisement
E-Paper

২৬ ঘণ্টা যন্ত্রণার যাত্রায় উপরি ‘লাফরা পুরি’

এ-ও জীবনের এক বিরল অভিজ্ঞতা। শিবগঙ্গা এক্সপ্রেসে বারাণসী থেকে দিল্লি আসতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। আজ ট্রেনটা দেরি করল ২৬ ঘণ্টা! সৌজন্যে উত্তর ভারতের কুয়াশা।

প্রজ্ঞা দাশগুপ্ত

শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৪:০১

এ-ও জীবনের এক বিরল অভিজ্ঞতা।

শিবগঙ্গা এক্সপ্রেসে বারাণসী থেকে দিল্লি আসতে সময় লাগে ১২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। আজ ট্রেনটা দেরি করল ২৬ ঘণ্টা! সৌজন্যে উত্তর ভারতের কুয়াশা। ভেবেছিলাম ট্রেনে রাতটা কাটিয়েই বাড়ি পৌঁছে যাব সকাল সকাল। বারাণসীর কাছে মান্ডুয়াভী স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ট্রেনে ওঠার কথা ছিল সন্ধ্যা ৭ টা ৩৫ মিনিটে। ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়বে কি না, সেটা জানাও এক মস্ত বড় সমস্যা। রেলের এনকোয়ারির ফোন পাওয়া যায় না। ইন্টারনেটে জানানো হচ্ছে, কুয়াশার জন্য কিছু সময় দেরি হতে পারে।
আর না ভেবে স্টেশনে পৌঁছে গেলাম। থিকথিক করছে লোক। বসার জায়গা তো দূর অস্ত্, দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। এক কুলিকে থামিয়ে কোনও ক্রমে জানতে পারলাম, দিল্লি থেকে শিবগঙ্গা এখনও এসে পৌঁছয়নি। কাজেই ট্রেন ছাড়তে দেরি হবে। ‘‘পহেলে তো আনে দিজিয়ে’’— বিরক্তি প্রকাশ করে ভ্যানিশ হয়ে গেল কুলি।

শীতের রাত। ট্রেন ছাড়ল ভোর তিনটেয়। যাত্রা শুরু। সহযাত্রী এক জাপানি মহিলা পর্যটক। সারনাথে বুদ্ধের প্যাগোডা দেখে এক চরম সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় তিনি অবতীর্ণ। আমি বললাম, ‘‘বাবা বিশ্বনাথের যদি দয়া হয়, তবে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব।’’ সুপার ফাস্ট ট্রেন। ইলাহাবাদ, কানপুর— মাঝে শুধু দু’টি স্টেশন। এসি টু টায়ারে কাছাকাছি অন্য দুই সহযাত্রী প্রবীণ ভারতীয়— তাঁদের এক জন আবার রেলের অফিসার। কর্মসূত্রে প্রায়ই দিল্লি-বারাণসী যাতায়াত করেন। তিনি পর্দা টেনে, লাইট অফ করে সবাইকে ‘গুডনাইট’ বলে শুতে যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘কাল সকাল আটটা না হোক, লাঞ্চের আগে পৌঁছে যাব।’’

ঘুম যখন ভাঙল, তখন ট্রেনটা দাঁড়িয়ে। সকাল নটা বেজে গিয়েছে। কোথায় এল? কাচের জানলা দিয়ে দেখলাম, সবে ইলাহাবাদ। এর পর সারা দিন এক ভোগান্তির চিত্রনাট্য। চা-চা করছে মনটা। কিন্তু চা আসছে না। জলের বোতল চাইছে সকলে। কোথায় জল? চাতক পাখির মতো যাত্রীরা বসে। কোনও ঘোষণা নেই, কেউ জানে না, ইলাহাবাদে কেন দু’ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রইল ট্রেনটা। পৃথুল শরীর নিয়ে রেল অফিসার প্রকাশ দুবে দোতলার বিছানা থেকে নামলেন। ব্যাজার মুখ, গত কালের ভবিষ্যৎবাণী যে ব্যর্থ হতে চলেছে, সেটা বুঝে নীরবতাই বেছে নিয়েছেন। এর পর ঢিকঢিক করে ট্রেন চলতে লাগল। থেমে যাচ্ছে যখন তখন। দুবেজি বললেন, ‘‘আসলে এক বার লেট হয়ে গেলে সিগন্যাল পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। অন্য ট্রেনগুলিকে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়।’’ আমাদের রেল সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞানের উৎস তখন তিনিই।

এর পর ২৬ ঘণ্টা লেট করে
ট্রেনটা আজ যদিও বা পৌঁছল, দীর্ঘ সময় ধরে না ছিল খাবাবের সুষ্ঠু ব্যবস্থা, না ছিল টয়লেটে জল। গত কাল দুপুরে যে খাবারটা দিয়েছিল, সেটা নিয়েই আজ সকালে আবার হাজির রেলের প্যান্ট্রির কর্মী। ছেলেটি বলল, ‘‘কত ক্ষণ না খেয়ে থাকবেন! নিয়ে নিন এই ‘লাফরা পুরি’।’’ জিজ্ঞাসা করলাম সেটা কী? বলল, ‘‘কাল রাতের পুরিটা যখন পর দিন সকালে দিই, তখন তাকে বলি লাফরা পুরি। খেলে পেটে লাফরা হতে পারে, কিন্তু অভুক্ত তো থাকতে পারবেন না!’’

খিদের মুখে খেয়ে ফেললাম। তার পর শুরু হল বমি। আমার মতো একই অবস্থা জাপানি সহযাত্রীর। কিন্তু ওষুধই বা পাব কোথায়? তবে সারা দিন ট্রেনে মানুষ কিন্তু চুপ করে ছিল না। দিন ভর চলেছে তর্ক-বিতর্ক। সংখ্যাগরিষ্ঠ রেলযাত্রীর আক্রমণের লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদী। এই হিন্দি বলয়ে মানুষ জানেনই না, সুরেশ প্রভু নামে এক রেলমন্ত্রী রয়েছেন! পরিষেবাহীন রেলযাত্রার দায়টা বেশির ভাগ লোকই ঠেলে দিচ্ছেন মোদীর দিকে।

ক্ষীণ কণ্ঠে দুবেজি একবার বলছিলেন, কুয়াশা হলে আর কী করা যাবে? এতে তো মোদীজির হাত নেই! প্রতিবাদে তিন জন সহযাত্রী চিৎকার করে বলে ওঠেন, কেন তিনি দেশকে ক্যাশলেস, ডিজিটাল করবেন, বুলেট ট্রেনও নাকি চালাবেন, আর ট্রেন লেট করলে বিকল্প পরিষেবার ব্যবস্থা করতে পারেন না? এক যাত্রী দিল্লির ব্যবসায়ী। তিনি রসিক মানুষ। ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘‘অতিরিক্ত সময় নিয়ে রেল সফর করেছি বলে মোদীজি আবার ট্যাক্স না বসান! কবে শুনব মিত্রোঁ বলে দেরির জন্য ট্যাক্স নিচ্ছেন। তা-ও আবার কার্ডে দিতে হবে!’’

লেখক বারাণসী থেকে দিল্লিগামী শিবগঙ্গা এক্সপ্রেসের যাত্রী।

Shivganga express Fog
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy