Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

চিনকে টক্কর দিতেই ত্রাণের বান নেপালে

ভুকম্প বিধ্বস্ত নেপালের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে প্রথম রাউন্ডে চিনকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে অদূর ভবিষ্যতেই চিনা ড্রাগন যে আরও আগ্রাসী ভাবে নেপালের মাটিতে ফিরে আসতে চাইবে— সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ মোদী সরকার। আর তাই এই দুর্দিনে কাঠমান্ডুর পাশে সর্বাত্মক ভাবে থাকার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু করেছে নয়াদিল্লি।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪১
Share: Save:

ভুকম্প বিধ্বস্ত নেপালের পাশে দাঁড়ানোর প্রশ্নে প্রথম রাউন্ডে চিনকে পিছনে ফেলে দিয়েছে ভারত। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে অদূর ভবিষ্যতেই চিনা ড্রাগন যে আরও আগ্রাসী ভাবে নেপালের মাটিতে ফিরে আসতে চাইবে— সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ মোদী সরকার। আর তাই এই দুর্দিনে কাঠমান্ডুর পাশে সর্বাত্মক ভাবে থাকার জন্য যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু করেছে নয়াদিল্লি।

গত কালের বিপর্যয়ের পর রেকর্ড সময়ের মধ্যে ত্রাণ-সামগ্রী পাঠিয়েছিল ভারত। সেই সাহায্যের গতি আরও বাড়িয়ে দেওয়া হল আজ। প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার পর নরেন্দ্র মোদী জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর বিদেশনীতিতে কাঠমান্ডু অগ্রাধিকার পেতে চলেছে। বিদেশ মন্ত্রকের মতে, চিনের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে এগিয়ে থাকাটা অত্যন্ত জরুরি সাউথ ব্লকের কাছে। আর সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ছ’মাসের মধ্যেই দু-দু’বার কাঠমান্ডু সফরে গিয়েছেন মোদী। এ দিন ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানেও মোদী বলেন, ‘‘নেপালের প্রত্যেক দুর্গত মানুষের চোখের জল আমরা মুছিয়ে দেব।’’ আর আজ এই আপৎকালীন সময়ে গোটা মন্ত্রিসভা একজোট হয়ে নেপালের পাশে। বিকেলে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ডাকেন মোদী। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, বিদেশমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা, বিদেশসচিব, এনডিআরএফ-এর কর্তা-সহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন সেখানে।

পরে বিদেশ, স্বরাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সচিব একত্রে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করে নেপালের ত্রাণ এবং পুর্নবাসনে ভারতের ভূমিকার ব্যাখ্যা করেছেন। জানানো হয়েছে, গত কালের পর আজ আরও ১৩টি ত্রাণবোঝাই সামরিক বিমান নেপালে পাঠানো হয়েছে। গিয়েছে ৩টি অসামরিক বিমান এবং ছ’টি হেলিকপ্টারও। যে কোনও সময় উড়ে যাওয়ার জন্য তৈরি রাখা আছে ৪টি মিগ ১৭। পাঠানো হয়েছে এনডিআরএফ (ন্যাশনাল ডিসাস্টার রিলিফ ফোর্স)-এর আরও তিনটি প্রতিনিধি দল। ৩১ জনের একটি মেডিক্যাল দলও কাঠমান্ডু পৌঁছেছে। পাঠানো ত্রাণ-সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ১০ টন কম্বল, ৫০ টন জল (রেল মন্ত্রকের দেওয়া), ২২ টন খাদ্যদ্রব্য। বিদেশসচিব জয়শঙ্করের কথায়, ‘‘আমাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য, নেপালের দুর্গতদের যত দ্রুত সম্ভব সহায়তা করা। পাশাপাশি ওখানে আটকে পড়া ভারতীয়দেরও আমরা পর্যায়ক্রমে ফিরিয়ে আনছি।’’ জানানো হয়েছে, মোট ৫৫০ জন ভারতীয়কে আজ কাঠমান্ডু থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। চেষ্টা চলছে বাসে করেও যাতে মানুষকে ফেরানো যায়। ভারত থেকে সড়কপথে ৩৫টি বাস পাঠানো হচ্ছে নেপালে। খুব শীঘ্রই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল কাঠমান্ডু রওনা হবে, যার প্রতিনিধিত্ব করবেন বিভিন্ন মন্ত্রকের শীর্ষ পর্যায়ের অফিসারেরা। অকুস্থলে দাঁড়িয়ে ত্রাণ এবং উদ্ধার কার্য সমন্বয়ের কাজ করবে এই দলটি।

কূটনৈতিক শিবিরের বক্তব্য, দিল্লির এত সাজ সাজ রব ত্রাণকাজে বেজিংকে হারিয়ে নেপালের মন পাওয়ার জন্যই। এই ধরনের ত্রাণ কূটনীতিকে ব্যবহার করে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রভাব অবিশ্বাস্য রকম বাড়িয়ে তুলেছে বেজিং। বিধ্বস্ত নেপালের পরিকাঠামো অনেকাংশেই নতুন করে তৈরি করা প্রয়োজন এ কথা সত্যি। আর সেই কাজে চিন যে বিপুল অঙ্কের অর্থসাহায্য নিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রীর দরবারে হাজির হবে, এমনটাই আঁচ করছে বিদেশ মন্ত্রক। আর তাকে সত্য প্রমাণ করে নেপালের ত্রাণের জন্য এ দিনই প্রাথমিক ভাবে ২ কোটি ইউয়ান (ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ২১ কোটি টাকা) বরাদ্দ করেছে বেজিং। ৬২ সদস্যের একটি উদ্ধারকারী দলও কাঠমান্ডুতে পাঠিয়েছে চিন। ভারতের আশঙ্কা, নতুন করে পরিকাঠামো গড়ে দেওয়ার নামে তারা নিজেদের কৌশলগত ঘাঁটি তৈরি করার একটা সুযোগও পেয়ে যাবে। ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রশ্নে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অন্য দিকে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসান হওয়ার পর থেকে কাঠমান্ডুও বার বারই বেজিং এবং নয়াদিল্লি— তার এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলেছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সুশীল কৈরালা তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘‘চিন এবং ভারত— এই দুই দেশই আমাদের বিদেশনীতির প্রথম দুই অগ্রাধিকার।’’ ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, চিন টাকা দিয়ে আনুগত্য কেনায় বিশ্বাসী এবং সে কাজে অনেকাংশে সফলও। এই ক্ষেত্রেও তাদের কাছে অর্থই হল নেপালের উপর আধিপত্য বাড়ানোর প্রধান হাতিয়ার। নেপালকে দেওয়া আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ গত দশ বছরে প্রায় পনেরো গুণ বাড়িয়েছে চিন। সদ্য শেষ হওয়া আর্থিক বছরে সেই সাহায্যের পরিমাণ প্রায় ৭ কোটি ডলার ছুঁয়েছে। তাৎপযর্পূর্ণ ভাবে এই বিপুল অর্থসাহায্যের বেশির ভাগটাই দেওয়া হয়েছে নেপাল সেনা এবং পুলিশকে। পাশাপশি অবশ্যই চিনা পণ্যের ঢল নেমেছে নেপালের বাজারে। সে দেশে যেমন চিনা ভাষার প্রসার বেড়েছে, তেমনই সাধারণ মানুষের মধ্যে বেড়েছে ভারত বিদ্বেষও।

অবশেষে নিঃশর্ত ভাবে সহায়তায় ঝাঁপিয়ে পড়ার একটি সুযোগ যখন এসেছে, তখন সরকারকে ঠিক সেটিই করার নির্দেশ দিয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। এর পর চিন যদি নেপালের পরিকাঠামো পুনর্গঠনে বিপুল ভাবে এগিয়ে আসে, তা হলে ভারতও যে পিছিয়ে থাকবে না সেই ইঙ্গিতও দিয়েছেন জয়শঙ্কর। তিনি বলেছেন, ‘‘নেপাল আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। এখন উদ্ধার এবং পুর্নবাসনের কাজটাই জরুরি। সেই পর্ব চুকলে, ভবিষ্যতে কী করা যায়— সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE