Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

যুগ্ম নোবেলে শান্তির মঞ্চে ভারত-পাক

হিন্দু ও মুসলিম। প্রৌঢ় ও কিশোরী। পুরুষ ও নারী। ভারতীয় ও পাকিস্তানি। কৈলাস সত্যার্থী ও মালালা ইউসুফজাই। ২০১৪-র শান্তির নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে এই দু’জনকে নির্বাচন করে ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ ও জাতিসত্তার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন করল নোবেল কমিটি। এবং একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাল উপমহাদেশের দুই পরমাণু শক্তিধর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে। শান্তির বার্তা। সমঝোতার বার্তা।

কৈলাস সত্যার্থী ও মালালা ইউসুফজাই

কৈলাস সত্যার্থী ও মালালা ইউসুফজাই

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:০৩
Share: Save:

হিন্দু ও মুসলিম। প্রৌঢ় ও কিশোরী। পুরুষ ও নারী। ভারতীয় ও পাকিস্তানি। কৈলাস সত্যার্থী ও মালালা ইউসুফজাই।

২০১৪-র শান্তির নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে এই দু’জনকে নির্বাচন করে ধর্ম, বয়স, লিঙ্গ ও জাতিসত্তার এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন করল নোবেল কমিটি। এবং একটি স্পষ্ট বার্তা পাঠাল উপমহাদেশের দুই পরমাণু শক্তিধর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে।

শান্তির বার্তা। সমঝোতার বার্তা।

আজ অসলোতে পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা করে নরওয়ের নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান থরবিয়র্ন ইয়াগল্যান্ড বলেন, “বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে ও শিক্ষার দাবিতে যে লড়াই, সেই লড়াইয়ে এক হিন্দু ও এক মুসলিম, এক ভারতীয় ও এক পাকিস্তানিকে একসূত্রে বেঁধে ফেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে নোবেল কমিটি।”

নোবেল শান্তি পুরস্কার এ ভাবে প্রতিবেশী দুই রাষ্ট্রে ভাগাভাগি করে দেওয়ায় প্রশ্ন উঠছে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে কি আন্তর্জাতিক কূটনীতির কোনও অচেনা অঙ্ক রয়েছে? রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অসলো সফরের ৪৮ ঘণ্টা আগে নরওয়ের নোবেল কমিটির এই ঘোষণা স্বভাবতই জল্পনা উস্কে দিয়েছে! তার আরও একটা কারণ, বিশ্বজুড়ে আঞ্চলিক সংঘর্ষ ও উত্তেজনা কমাতে নরওয়ে বরাবরই ইতিবাচক ভূমিকা নিয়ে থাকে।

কূটনৈতিক স্তরে আপাতত দু’দেশের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর গুলির শব্দ থামছেই না। অশান্তির এই আবহেই আজ শান্তির মঞ্চে একই সঙ্গে ঠাঁই পেল ভারত-পাকিস্তান। এ বছরের দুই নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপকের যোগসূত্র একটাই শিশুর অধিকার। শিক্ষার অধিকার। বোরখার আবডালে, শিশুশ্রমের অতলে বা নিষিদ্ধপল্লির গলিতে নয়, একটি শিশুর আসল ঠিকানা তার স্কুল।

এই দাবি তুলেই সাড়ে তিন দশক ধরে কাজ করে চলেছেন ৬০ বছর বয়সি কৈলাস সত্যার্থী। জন্ম মধ্যপ্রদেশের বিদিশায়। পেশায় ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ার। সব ছেড়েছুড়ে দিল্লি চলে যান ১৯৮০ সালে। ঠিক করেন, শিশুশ্রম বন্ধ করতে কিছু একটা করবেন। তাঁর হাত ধরেই শুরু হয় ‘বচপন বাঁচাও আন্দোলন’ সংস্থাটি। শিশুশ্রমিক থেকে শুরু করে স্কুলছুট, পাচার হয়ে যাওয়া কিশোরী থেকে পথশিশু, কৈলাসের উদ্ধার-তালিকায় রয়েছে প্রায় ৮০ হাজার শিশু। এখন অবশ্য পাকাপাকি ভাবে দিল্লিরই বাসিন্দা। সেখানেই তাঁর সংগঠনের মূল দফতর। বেশ কিছু বিদেশি পুরস্কার তাঁর ঝুলিতে থাকলেও কোনও বড় মাপের ভারতীয় খেতাব বা সরকারি স্বীকৃতি তাঁর জোটেনি। আদতে গাঁধীবাদী কৈলাসের আজ একটাই আক্ষেপ, “নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় যদি মহাত্মা গাঁধীরও নাম থাকত, তা হলে আরও অনেক বেশি খুশি হতাম আমি।”

মালালা ইউসুফজাইয়ের নাম গত দু’বছর ধরেই সম্ভাব্য পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় ঘোরাফেরা করছিল। পাকিস্তানের সোয়াট উপত্যকায় তালিবানি অত্যাচার নিয়ে এগারো বছর বয়সে বিবিসি-উর্দুতে ব্লগ লেখা শুরু। বছর তিনেকের মধ্যেই মালালার ঝুলিতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এবং পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকা তালিবানি হুমকি। ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর স্কুল থেকে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মালালার স্কুল বাসে উঠে পড়ে তালিবান জঙ্গিরা। ‘কে মালালা, না বললে বাসশুদ্ধ সবাইকে খতম করে দেব,’ এই হুমকির সামনে চুপ থাকেনি সাহসিনী। তার ‘আমিই মালালা’-র উত্তরে তালিবানি গুলি মেয়েটির মুখের এক পাশ ফুঁড়ে চলে যায়।

প্রথম ছ’দিন রাওয়ালপিন্ডিতে, পরে ব্রিটেনের বার্মিংহামে চিকিৎসায় প্রাণে বেঁচে যায় কিশোরী। তারপর দুনিয়াজোড়া কুর্নিশ, মার্কিন প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে পা। আজ যখন নোবেলের খবর আসে, তখন বার্মিংহামের স্কুলে ছিল মালালা। এক সহপাঠিনী ডেকে নিয়ে তাকে খবরটা দেয়। নোবেল প্রাপকদের তালিকায় ১৭ বছরের মালালাই সর্বকনিষ্ঠ।

পুরস্কার প্রাপকদের নাম ঘোষণা করে নোবেল কমিটি বলে, “শিশু ও কিশোরদের অধিকারের জন্য লড়াই আখেরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে আত্মীয়তা বাড়াতে সাহায্য করে। শান্তি পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকেও মাথায় রাখার কথা আলফ্রেড নোবেল তাঁর উইলে লিখে গিয়েছেন।” কৈলাস ও মালালাকে বেছে নেওয়াটাই দক্ষিণ এশিয়ায় যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। কিন্তু প্রশ্ন হল, শান্তির মঞ্চে দুই রাষ্ট্রের এই সহাবস্থান কি ভবিষ্যতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলবে? তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, গত ন’দিনের ধারাবাহিক সংঘর্ষের পরে আজ নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। সাউথ ব্লকের কূটনীতিকরা অবশ্য খুব বেশি আশাবাদী নন। বরং তাঁদের মতে, কট্টরপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এখনও অনেকটা পথ হাঁটা বাকি। সীমান্তের দুই পারের মানুষদের মধ্যে সৌহার্দ্যের ভাবনা অনেক দিন ধরেই রয়েছে। কিন্তু তালিবানি মানসিকতা ও পাকিস্তানের কট্টরপন্থী মোল্লাতন্ত্র প্রতিবেশী দুই দেশকে কাছাকাছি আনার পথে এখনও বড় বাধা। তবে ইতিবাচক হল, পাকিস্তান ও আফ-পাক সীমান্তে মালালারা এখন সাহস দেখাতে শুরু করেছেন। যাঁরা সমানাধিকারের কথা বলছেন, শিশু শিক্ষার কথা বলছেন। নয়াদিল্লি চাইছে পাকিস্তানের মাটিতে এই কণ্ঠস্বর আরও জোরালো হোক। এই কারণে গোড়া থেকেই মালালার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে নয়াদিল্লি।

ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন পাশে সরিয়ে রেখে যে এখন রাজনীতিবিদ হতে চায়, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে কী বলছে সেই মালালা? আজ এক সাংবাদিক বৈঠকে পাক কিশোরী বলে, “আমি চাই, উন্নয়ন ও শিক্ষার বিষয়ে হাত মিলিয়ে কাজ করুক দু’দেশ। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সৌহার্দ্যের সম্পর্ক তৈরি করতে আমি ও সত্যার্থী এক সঙ্গে কাজ করব।” দুই রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে মালালার আর্জি, “ডিসেম্বরে আমরা যখন অসলোতে পুরস্কার নিতে যাব, প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও যেন আমাদের সঙ্গে আসেন।”

আর সত্যার্থী? প্রচারের আলো থেকে বরাবর যিনি একটু দূরেই থেকেছেন, মালালা প্রসঙ্গে তিনি শুধু বলেন, “সাহসী যাত্রাপথ এই পাকিস্তানি কিশোরীর।” প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে সি ভি রমন, মাদার টেরিজা থেকে অমর্ত্য সেন ভারতীয় নোবেলপ্রাপকদের বঙ্গ-সূত্র বহু দিন ধরেই সুবিদিত। সেই তালিকায় ব্যতিক্রম কৈলাস সত্যার্থী। ভারতে ফের নোবেলের খবরে চার দিকে যখন খুশির হাওয়া, তখন অনেক বাঙালির তির্যক প্রশ্ন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলায় উৎকর্ষের মরুভূমি কি ছড়িয়ে পড়ছে মগজে আর মননেও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE