Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Political News

শশিজীবনের উত্থানকাহিনি: ভিডিও পার্লারের ব্যবসা থেকে জয়ার ক্ষমতাবৃত্তে

উচ্চাকাঙ্ক্ষা! এই একটি শব্দ তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্রে এনেছিল। এবং সেই শব্দই তাঁকে ওই বৃত্ত থেকে বের করে দিল।

পুরনো সেই দিনের কথা: জয়ললিতা এবং শশিকলা।—ফাইল চিত্র।

পুরনো সেই দিনের কথা: জয়ললিতা এবং শশিকলা।—ফাইল চিত্র।

সংবাদ সংস্থা
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ১৭:১৭
Share: Save:

উচ্চাকাঙ্ক্ষা! এই একটি শব্দ তাঁকে ক্ষমতার কেন্দ্রে এনেছিল। এবং সেই শব্দই তাঁকে ওই বৃত্ত থেকে বের করে দিল।

ভিকে শশিকলা। সরকার থেকে পরিবার, জেল থেকে দল— সর্বত্রই যিনি ছিলেন তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার একমাত্র ছায়াসঙ্গী। ‘আম্মা’র সঙ্গে দীর্ঘ কয়েক দশকের সম্পর্ক তাঁকে ‘চিন্নাম্মা’ করে তুলেছিল।

জয়া বেঁচে থাকাকালীন শশী ছিলেন পর্দার আড়ালে। সেখান থেকেই সামলাতেন সব। কিন্তু, ‘আম্মা’ মারা যেতেই ক্ষমতার মূল বৃত্তে ঢুকে পড়েন তিনি। দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে পরিষদীয় দলনেতা— অল্প দিনের মধ্যেই ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠেন শশিকলা। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আশায় যখন সকল বাধা ঠেলে দৌড়চ্ছেন কৌশলী শশী, তখনই বড় ধাক্কাটা এল। আদালতের রায়ে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে এক্কেবারে ছিটকে গেলেন!

আরও পড়ুন: মসনদ নয়, জেলেই যেতে হচ্ছে শশিকলাকে

জয়া-শশীর সম্পর্কের শুরু বছর চল্লিশেক আগে। তখন সবে অভিনয় জগত্ ছেড়ে এম জি রামচন্দ্রনের হাত ধরে রাজনীতিতে এসেছেন জয়া। একে সুন্দরী, তায় ফিল্মস্টার। কাজেই তাঁকে মূলত প্রচারের কাজেই ব্যবহার করা হত। তরুণী জয়া সেই সময় এআইএডিএমকে-র প্রচার সচিব। বিভিন্ন জায়গায় দলের হয়ে প্রচার করে বেড়াচ্ছেন। এমনই একটা সময়ে শশিকলার সঙ্গে পরিচয় হয় জয়ার।

শশির তখন সবে বিয়ে হয়েছে। সাধারণ গৃহবধূ। থাকেন মান্নারগুড়িতে। ফিল্ম বিষয়ে বিস্তর আগ্রহ। পাশাপাশি, স্বপ্ন দেখেন সুপার স্টার হওয়ার। তাই, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে একটি ভিডিও পার্লার খুলে ফেললেন। কিনলেন একটি ভিডিও ক্যামেরাও। এলাকায় কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান হলে তার ভিডিওগ্রাফিও করতে শুরু করেন পেশাদার শশী।


নিজের দলের বিধায়কদের মুখোমুখি শশিকলা। পিটিআইয়ের তোলা ফাইল চিত্র।

শশীর স্বামী এম নটরাজন তখন রাজ্য সরকারের জনসংযোগ আধিকারিক পদে কাজ করেন। কেউ কেউ বলেন, সেটা নাকি অস্থায়ী চাকরি। কিন্তু, উচ্চ মহলে তাঁর ভালই যোগাযোগ। আইএস অফিসার ভি এস চন্দ্রলেখার সঙ্গেও তাঁর ভাল সম্পর্ক। চন্দ্রলেখা আবার ছিলেন ডিএমকে নেতা করুণানিধির ঘনিষ্ঠ।

সেটা ১৯৭৬। মান্নারগুড়িতে দলীয় সভা করতে আসার কথা জয়ললিতার। জানতে পেরে জয়ার একটি ভিডিও ফুটেজ রেকর্ডিং করার পরিকল্পনা করেন শশী। স্বামীকে সে কথা জানাতে তিনি জেলাশাসক চন্দ্রলেখাকে বলে সব ব্যবস্থা করে দেন। সভার দিন জয়ার সঙ্গে শশীর পরিচয়ও করে দেন চন্দ্রলেখা। এর পর গোটা অনুষ্ঠানের ভিডিও করেন শশী। জয়ার ভাল লেগে যায় শশীকে দেখে। সেই দু’জনের সম্পর্কের শুরু। এর পর যেখানেই জয়া যেতেন, শশীও দৌড়তেন ক্যামেরা নিয়ে।

আরও পড়ুন: ধর্মের জয় হবে, সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে প্রতিক্রিয়া শশিকলার

১৯৮৭তে মারা গেলেন এমজিআর। রাজনীতিতে তখন একাই লড়াই চালাচ্ছেন জয়া। এমজিআর-এর স্ত্রী জানকী তাঁকে নানা ভাবে হেনস্থা করছেন। কিন্তু, দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছিলেন জয়া। পাশে ছিলেন শশী। শেষমেশ ১৯৮৯-এ পাকাপাকি ভাবে মান্নারগুড়ি থেকে জয়ার পোয়েস গার্ডেনে উঠে আসেন তিনি। অনেকে বলেন, সেই সময় পোয়েস গার্ডেনের সমস্ত কর্মচারী, মালি থেকে রাঁধুনী, গাড়ির চালক থেকে পরিচারিকা, সকলকেই নিয়োগ করতেন শশী। প্রায় চল্লিশ জনকে এই সমস্ত কাজে নিয়োগ করেন শশিকলা। এই কর্মচারীদের বেশির ভাগই ছিলেন মান্নারগুড়ির বাসিন্দা।

শশীর সঙ্গে পোয়েস গার্ডেনে চলে আসেন তাঁর পরিবারের একাধিক সদস্য। তার মধ্যে এম নটরাজনও ছিলেন। ১৯৯১তে রাজ্যে বিপুল জনাদেশ নিয়ে সরকার গঠন করেন জয়া। কাজেই শশীর ক্ষমতা একপ্রস্ত বাড়ে। সরকার থেকে দল— সর্বত্রই তখন তাঁর আধিপত্য। জয়ার ছায়াসঙ্গী বলে কথা! এর পরের পাঁচ বছরে ফুলে ফেঁপে ওঠে শশীর পরিবার। তত দিনে শশিকলার ভাইপো সুধাকরণকে জয়া দত্তক নিয়েছেন। ১৯৯৬তে পালিত ছেলের বিয়েতে প্রচুর টাকা খরচাও করেছেন। এই সময়েই তাঁর বিরুদ্ধে তত্কালীন জনতা দলের নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী একটি মামলা দায়ের করেন। অভিযোগ, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর হিসাববহির্ভূত সম্পত্তির পরিমাণ ৬৬.৬৫ কোটি টাকা!

আরও পড়ুন: সে বার জয়ার সঙ্গী, এ বারের জেলযাত্রায় তিনিই নজরের কেন্দ্রবিন্দু

তত দিনে শশীর পরিবারের গায়ে ‘মান্নারগুড়ির মাফিয়া’ তকমা সেঁটে গিয়েছে। ৯৬-এর বিধানসভা নির্বাচনে হেরেও গেলেন জয়া। সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর করা মামলার প্রেক্ষিতে ওই বছরেরই ৭ ডিসেম্বর গ্রেফতার করা হয় জয়ললিতাকে। পরে ছাড়া পান। সেই সময়ে জয়ার সঙ্গে শশীও জেলে গিয়েছিলেন।

২০০১-এ ফের ক্ষমতায় আসেন জয়া। কিন্তু, ২০০৬-এ ক্ষমতা হারান। আবার ২০১১তে তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হন। ওই বছরের ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতির অভিযোগে দল এবং পোয়েস গার্ডেন থেকে শশিকলাকে বের করে দেন জয়া। শুধু শশী নন, সঙ্গে তাঁর স্বামী এম নটরাজন-সহ আরও অনেকের সঙ্গেই একই ব্যবহার করেন তিনি। কিন্তু, কয়েক মাস পরেই মার্চে ফের মুচলেকা দিয়ে জয়াকে চিঠি লিখে শশী ফিরে আসেন দলে। এবং পোয়েস গার্ডেনেও। তবে, বাকিদের আর কখনও জয়ার আশপাশে দেখা যায়নি।

আপাতত এ দৃশ্য হয়তো আর দেখা যাবে না।—ফাইল চিত্র।

২০১১-য় জিতে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন জয়া। ওই দফাতেই ২০১৪ সালে তিনি ওই একই মামলায় ফের ২১ দিন জেলে গিয়েছিলেন। এ বারও সঙ্গী ছিলেন শশী। এর বছরখানেকের মধ্যেই বিধানসভা নির্বাচনে ফের জেতেন জয়া। ২০১৫-র মে মাসে শপথ নেন। কিন্তু, সেপ্টেম্বরে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। আর ফেরেননি। ৫ ডিসেম্বরে সেখানেই মারা যান তিনি।

এত দিন জয়ার ক্ষমতার আড়াল থেকেই রাজপাট সামলাতেন শশী। সরকার হোক বা দল, তাঁর হাত ছিল অনেক বড়। রাজ্যের মন্ত্রী থেকে আমলা— অনেকের ভাগ্যই নির্ধারিত হত শশীর ইচ্ছেয়। এমনকী, হাসপাতালে চিকিত্সাধীন জয়ার সঙ্গে কে বা কারা দেখা করবেন, সেটাও ঠিক করতেন তিনি। সম্প্রতি একদল চিকিত্সককে দিয়ে তামিলনাড়ু সরকার একটি সাংবাদিক সম্মেলন করায়। ওই চিকিত্সকেরা শেষ দিন পর্যন্ত জয়ার চিকিত্সা করেছেন। সেখানে তাঁরা বলেন, জয়ললিতার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রতি দিন শশীকেই জানানো হত। অভিযোগ, জয়ার ভাইজি দীপা জয়াকুমারী হোক বা দলের দু’নম্বর ও পনীরসেলভমকেও হাসপাতালে শশী দেখা করতে দেননি জয়ার সঙ্গে।

আরও পড়ুন: জেলে ঢোকার আগে মরিয়া শশি, পনীরকে ‘তাড়িয়ে’ বাছলেন নতুন দলনেতা

জয়া মারা যেতেই পর্দার আড়াল থেকে সরে আসেন শশী। তড়িঘড়ি দলের সাধারণ সম্পাদক পদে নিজেকে বসিয়ে দেন। জয়া মারা যেতেই দীর্ঘ দিন পর প্রকাশ্যে দেখা যেতে থাকে শশীর স্বামীকে। এর পর পনীরকে সরিয়ে নিজে মুখ্যমন্ত্রী হতে পরিষদীয় দলের নেত্রী নির্বাচিত হন শশী। শুরু হয় রাজ্যপালের উপর চাপ বাড়ানো। কিন্তু, রাজ্যপাল বিদ্যাসাগর রাও সে পথে হাঁটেননি। কিছু না জানিয়েই অপেক্ষা করেছেন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের।

এ দিন সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেয়, জয়া এবং তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধে বেআইনি সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলায় কর্নাটক হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতের রায় বহাল রাখা হল। অর্থাত্ চার বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ ফের শশীর উপর চাপল। আর সরকারি কোনও পদে বা ভোটে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে শশী পিছিয়ে গেলেন ১০ বছর। যদিও তিনি রায় পুনর্বিবেচনার জন্য শীর্ষ আদালতে আবেদন জানাতে পারেন। জানাবেনও। কিন্তু, তাতে যদি কাজ না হয়? ছিটকে গিয়ে আপাতত ক্ষমতার বৃত্তের বাইরেই থাকতে হচ্ছে শশিকলাকে।

‘উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ শশিকলাকে আবারও জেলে নিয়ে গেল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE