শিলচর বিমানবন্দর। ছবি: সানি গুপ্ত
সড়কপথে চলা দায়। রেলপথেও বরাক উপত্যকার সঙ্গে বাইরের যোগাযোগ বন্ধ। বাধ্য হয়ে এখানকার মানুষকে বিমানের কথা ভাবতে হয়। কিন্তু সে সুযোগও নেই বললেই চলে।
শিলচরে যাতায়াত করে দু’টিমাত্র এয়ারলাইন্স— এয়ার ইন্ডিয়া ও জেট এয়ারওয়েজ। এয়ার ইন্ডিয়া শিলচর-কলকাতা বিমান চালায়। জেট এয়ারওয়েজ কলকাতার সঙ্গে গুয়াহাটিতেও যাতায়াত করে। যে এয়ারলাইন্স-ই হোক, কোনও রুটে ভাড়া মাথাপিছু ৬-৭ হাজার টাকার কম নয়।
এত চাহিদায় বিমান বাড়ে না কেন, কেন আসে না অন্যান্য এয়ারলাইন্স— সে সব প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব নেই কারও কাছে। সবাই অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপান। এয়ারলাইন্সগুলির অভিযোগ, শিলচরে রাতে বিমান ওঠা-নামার সুযোগ নেই। রয়েছে অন্যান্য পরিকাঠামোগত সমস্যাও।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, অসামরিক বিমানের নৈশ অবতরণে আপত্তি রয়েছে ভারতীয় বিমানবাহিনীর। তাদেরই নিয়ন্ত্রণে শিলচরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল। কর্মী-অভাবের কথা বলে তাঁরা ওয়াচ-আওয়ার বাড়াতে চায় না।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পাল্টা প্রশ্ন, কর্মী কম বা ওয়াচ-আওয়ারের কথা কেন? রাতে বিমান ওঠা-নামার অনুমতি কেউ চেয়েছে কি এখনও পর্যন্ত?
এয়ারপোর্ট অথরিটি অব ইন্ডিয়ার শিলচর ডিরেক্টর নন্দকিশোর দেউলি জানান, তিনি এখানে কাজে যোগ দিয়েই নৈশ অবতরণ নিয়ে কথা বলে চলেছেন। কিন্তু বিমানবাহিনী ওয়াচ-আওয়ার বাড়াতে রাজি নয়। ফলে বিকেল ৪টের মধ্যে শিলচরে বিমানের ওঠা-নামা বন্ধ করে দিতে হচ্ছে।
এ নিয়ে বেশ লেখালেখি করেছেন সাংসদ সুস্মিতা দেবও। গত বছরের ৯ মার্চ অসামরিক বিমান পরিবহণ প্রতিমন্ত্রী মহেশ শর্মা লোকসভায় তাঁকে জানিয়েছিলেন, ২০০৯ সালে তাঁরা শিলচর বিমানবন্দরে নৈশ অবতরণ ব্যবস্থা চালু করেছেন। সে-দিনই তা ভারতীয় বিমান বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। অসামরিক বিমানের নৈশ অবতরণেও সব ধরনের সহায়তা করতে বলা হয়েছিল তাদের। ২৬ এপ্রিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পরীর্কর সুস্মিতাদেবীকে চিঠি লিখে বলেন, ‘‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি, এ পর্যন্ত কোনও এয়ারলাইন্স নৈশ অবতরণের জন্য বিমানবাহিনীর কাছে অনুমতি চায়নি।’’ চাইলে ওয়াচ-আওয়ার বাড়াতে সমস্যা নেই, সে-কথাও তিনি জানিয়ে দেন শিলচরের সাংসদকে।
সেই সূত্রে সুস্মিতা দেব অতিরিক্ত বিমানের জন্য চাপ দেন অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রককে। গত বছরের ১৬ জুলাই বিভাগীয় মন্ত্রী পি অশোক গজপতি রাজু তাঁকে জানান, এয়ার ইন্ডিয়ার সহযোগী সংস্থা অ্যালায়েন্স এয়ারের একটিই এটিআর রয়েছে এই অঞ্চলে। দ্রুত সূর্যাস্ত এবং নৈশ বিমান অবতরণের সুবিধা না-থাকায় একে খুব বেশি ওড়ানো যায় না। ফলে শিলচর-গুয়াহাটি, শিলচর-ইম্ফল বিমান চালানো এখনই সম্ভব নয়।
বিস্মিত সুস্মিতাদেবী। দুর্ভোগে বরাকের মানুষ। সকলের প্রশ্ন, তবে সমাধানটা কী? ডিরেক্টর দেউলি-র কথায়, ‘‘একটাই রাস্তা। নতুন টার্মিনাল তৈরি করা। যেখানে নতুন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল হবে। নিয়ন্ত্রণ থাকবে এয়ারপোর্ট অথরিটির হাতে।’’
সেখানেও অবশ্য নানা জটিলতা রয়েছে। রাজ্য সরকার তাদের দুটি জমি দেখিয়েছে। দুই জায়গায় দুই ধরনের সমস্যা। কুম্ভীরগ্রাম চা বাগানের জমি বিমান ওঠানামার উপযোগী নয়। খরিল বাগান এলাকায় বহু বিতর্ক। ফলে এখনও কোনও কিছু চূড়ান্ত হয়নি।
বরাক উপত্যকায় তিন জেলা জুড়ে একটিই বিমানবন্দর। শিলচরের কুম্ভীরগ্রাম। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব এয়ার ইন্ডিয়া রবি, সোম, বুধ, শুক্র— চারদিন ১৪৪ আসনের বড় বিমান চালায়। বাকি তিন দিন ৬৮ আসনের এটিআর। জেটের দুই রুটে প্রতি দিনই ছোট বিমান। যাত্রী-চাহিদার তুলনায় নেহাতই নগণ্য। ফলে অত্যধিক ভাড়া। বাধ্য হয়ে অনেকে ১০-১২ ঘণ্টা ট্রেনে চড়ে আগরতলা গিয়ে ২-৩ হাজার টাকার টিকিটে কলকাতায় যান।
এয়ার ইন্ডিয়া সূ্ত্র জানান, বিমানবন্দরে পরিকাঠামোগত সমস্যাও কম নয়। একটিমাত্র বেল্ট, শুধু পাঁচটি কাউন্টার। দুই সংস্থার দুই বিমানের যাত্রী যখন একই সময়ে আসেন, সকলকে হিমসিম খেতে হয়। তার ওপর নেই কোনও ক্যান্টিন।
জেট এয়ারওয়েজের শিলচর স্টেশন ম্যানেজার দেবাশিস বরঠাকুর বলেন, ‘‘আমরা বিমান বাড়াতে চেয়েছিলাম। ১৮ জুন থেকে শিলচর-গুয়াহাটি আরেকটি বিমান চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অসামরিক বিমান পরিবহণের ডিরেক্টর জেনারেল এবং এয়ারপোর্ট অথরিটির অনুমতি আদায়ের পর বুকিংও শুরু হয়েছিল। পরে বিমানবাহিনীর আপত্তিতে পিছিয়ে যেতে হয়।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতার জন্যও বিমান কমেছে। এক বার এয়ারপোর্ট অথরিটি চিঠি দিয়ে জানায়, রি-কার্পেটিংয়ের জন্য বেলা ১২টার পর বিমানবন্দর ব্যবহার করা যাবে না। সেই অনুসারে আমরা দুপুরের বিমানগুলি তুলে নিই। পরে তারা সিদ্ধান্ত বদলায়, বর্ষায় কাজ হবে না। কিন্তু আমাদের তখন করার কিছু ছিল না। এক বার সূচি বদলে গেলে ছ’মাস অপেক্ষা করতে হয়। কারণ একটা বিমান চালানোর সঙ্গে বিভিন্ন পক্ষের নানা বিষয় জড়িয়ে থাকে।’’
দেবাশিসবাবু জানান, এরই মধ্যে তাঁরা শিলচর থেকে ভিন্ন রুট ও অতিরিক্ত বিমান চেয়েছেন। শিলচরের সঙ্গে ইম্ফল এবং যোরহাটের আকাশযোগও চেয়েছেন। উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ সেই প্রস্তাব নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন।
ডিরেক্টর নন্দকিশোর দেউলি সব সমস্যা মেটানোর জন্য নতুন টার্মিনাল চান। তিনি বলেন, ‘‘৫-৭শো একর জমি পেলে আমরা সব কিছু করার জন্য তৈরি রয়েছি।’’
আরও এক দিকে তিনি রাজ্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দেউলি বলেন, ‘‘নতুন বিমাননীতিতে রিজিওনাল কানেকটিভিটি-র উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার কিছু শর্ত মেনে নিলে শিলচরও আড়াই হাজার টাকা ভাড়ার হিসেবে ঢুকতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিলচরে যাত্রীসংখ্যা হুহু করে বেড়ে যাবে। পর্যটনে গতি আসবে।’’
সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের প্রতি তাঁর পরামর্শ, ‘‘ভোরে পাহাড় ফুঁড়ে সূর্যের বেরিয়ে আসা, সন্ধ্যায় অপরূপ সূর্যাস্ত, চা বাগান, গাছ-গাছালি ইত্যাদি প্রাকৃতিক সুষমার সঙ্গে চাই ভাল থাকা-খাওয়া, ভাল ভাবে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ। খাসপুর, শনবিলের মত দর্শনীয় স্থানগুলিকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলা গেলে পর্যটক আকর্ষণে শিলচর শিলংকেও ছাড়াবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy