Advertisement
E-Paper

‘ঐতিহ্য’! লড়াইয়ে টান পড়ছে পেটে

জম্মু-কাশ্মীর হয়ে উত্তর ও মধ্য ভারত পিছনে রেখে পৌঁছনো গিয়েছে তিরুঅনন্তপুরমে।

অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯ ০২:১১
পথে: ঐতিহ্যের সমর্থক পি কে মানিমেগালাই। নিজস্ব চিত্র

পথে: ঐতিহ্যের সমর্থক পি কে মানিমেগালাই। নিজস্ব চিত্র

এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পরে বাতাসে এখন মশলার গন্ধ! রোদের তেজটাও কম। দু’পাশে গভীর বনরাজি হাত উপুড় করে সবুজ ঢালছে। এমন আবহাওয়া নাকি স্থানীয় হাতিদের চলাচলের জন্য প্রশস্ত! যে কোনও সময়ে দেখা মিলতে পারে গজদেবতাদের।

‘ঈশ্বরের নিজের দেশ’ বলে কথা!

জম্মু-কাশ্মীর হয়ে উত্তর ও মধ্য ভারত পিছনে রেখে পৌঁছনো গিয়েছে তিরুঅনন্তপুরমে। সেখানে বুড়ি ছুঁয়ে ৬০ কিলোমিটার উজিয়ে চলে এসেছি কেরলের পাত্থানামথিত্তা নির্বাচনী কেন্দ্রে যেখানে শবরীমালার মন্দির। পূর্ণ সাক্ষরতা, উন্নয়নের সূচকে এগিয়ে থাকা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে শান্তিপূর্ণ ভারসাম্য তৈরি করে চলা রাজ্যটির এই জনপদকে গত বছরের শেষে অভূতপূর্ব হিংসার সাক্ষী হতে হয়েছিল। এখন ভোট। এখন যুদ্ধবিরতি।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

তবু সেই হিংসার রেখে যাওয়া চিহ্নগুলিকে খুঁজতে এই আয়াপ্পা মন্দিরের দ্বারপ্রান্তে আসা। এসে দেখছি, এই সেই চিহ্ন, যা দক্ষিণ কেরলের এই নির্বাচনী ক্ষেত্রে ভোটের আগে বিজেপি-কে এক ধাক্কায় অনেকটাই সুবিধা দিয়ে দিয়েছে। আয়াপ্পা স্বামীর গৌরব এবং ব্রহ্মচর্য যাপনের ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রচার কৌশলে মিশে যাচ্ছে বিজেপির ভোট প্রচারে। কমিউনিস্টদের মুখ গম্ভীর করে দিয়ে স্থানীয় মানুষের (মহিলাদেরও) সাড়া মিলছে যথেষ্ট! চলছে এক অন্য নকশার মেরুকরণের প্রয়াস।

সফর শুরু করেছিলাম দেশের উত্তর থেকে। শুনেছিলাম, জঙ্গি আতঙ্কের ফলস্বরূপ পেটে টান পড়ার হাহাকার। আর এখন ভারতের দক্ষিণ বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দেখছি, ভারতবাসীর বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ভৌগোলিক বিভেদ নেই। “যা কাণ্ড ঘটল, তার পরে কেউ আর এ দিকে বিশেষ আসছে না। দোকান এ বার তুলে দিতে হবে। কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না।” রাস্তায় চা ব্রেক নিতে গিয়ে আলাপ হল আয়াপ্পা মন্দিরের সন্নিকটে হোটেলের মালিক জাফর নাসার সঙ্গে। এক গাড়ি চাল, আলু, নারকোল, লাল কলার কাঁদি টেনে নিয়ে আসছেন তিরুঅনন্তপুরম থেকে। এটাই তাঁর বচ্ছরকার দস্তুর। সরকারকে লাইসেন্স দিয়েও পুষিয়ে যেত বেশ। ঋতুযোগ্য মহিলাদের অরণ্যাবৃত পাহাড়ের মাথার এই মন্দিরে যাওয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরে আয়াপ্পা ভক্তদের তুমুল বিক্ষোভ প্রতিরোধ এবং হিংসার ঘটনার জেরে পরিস্থিতি বদলেছে। পুলিশি প্রহরা টানটান, কিন্তু পুণ্যার্থীর সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে বলেই জানাচ্ছেন জাফর।

‘ভৃচিকা’ (মালয়ালি ক্যালেন্ডারের প্রথম মাস) থেকে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত আয়াপ্পা মন্দিরের তীর্থযাত্রীদের সংখ্যা তুঙ্গে থাকে। এটাই সব চেয়ে শুভ সময়। এ ছাড়া প্রত্যেক মালয়ালি মাসের প্রথম পাঁচ দিন খোলা হয় আয়াপ্পা স্বামীর মন্দির তাঁর ভক্তদের জন্য। পিনাক্কেল বেস ক্যাম্প ছাড়িয়ে আরও এগোনোর পাস সংগ্রহ করে পম্পা (যেখানে পর্যন্ত বাস যাচ্ছে এখন)। সন্ধ্যা থেকে মন্দির খোলা হবে, তাই ধু ধু মাঠের মধ্যে একটি-দু’টি করে বাস আসছে। ইরুমোদি মাথায় নিয়ে (চাল, খুচরো পয়সা আর নারকোল ভরা ছোট ব্যাগ) খালি গায়ে রুদ্রাক্ষ পরিহিত তামিল, তেলুগু, মালয়ালি কিছু পুরুষ নামলেন। বয়স্ক মহিলারাও আছেন, তবে সংখ্যায় খুবই কম।

“ঋতুযোগ্য মহিলাদের আয়াপ্পা মন্দিরে প্রবেশ নিয়ে এত ঝড় বয়ে গেল। কী মনে হয় আপনার?” উত্তর দিতে সময় নিলেন না জন্মসূত্রে তামিল কিন্তু কর্নাটকে বেড়ে ওঠা অর্থনীতির প্রাক্তন অধ্যাপিকা পি কে মানিমেগালাই। “বয়স হয়ে যাওয়ার পর থেকে প্রত্যেক বারই মন্দিরে আসছি। এখানকার যে নিয়ম ও ভক্তদের তৈরি করা নিষেধাজ্ঞা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে, তাকে পাল্টে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। সুপ্রিম কোর্টেরও নয়। এর বিরোধিতা করি।”

অন্ধ্রপ্রদেশের এক বিদূষী নারীরই শুধু নয়, এটা কেরল রমণীদেরও অনেকের স্বর। তাঁদের বক্তব্য, যে দু’জন মহিলা জোর করে মন্দিরে ঢুকেছিলেন তাঁরা বিচ্ছিন্ন। স্থানীয় ঐতিহ্যের প্রতীক নন। তাঁদের দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে অতি বামে (মাওবাদী) ঝোঁকা আন্দোলকারী হিসাবে। পম্পায় পৌঁছনোর দশ কিলোমিটার আগে হোটেল শ্রী আয়াপ্পন-এর অল্পবয়সী মালয়ালি মালকিন সিন্ধু তো লম্বা চর্চা ধর্ম ব্যাখ্যা করলেন সম্বর এবং ইদিয়াপ্পম আসার ফাঁকে। জানালেন, কোর্টের এই রায়ে তাঁর সায় নেই। এত দিনের সংস্কার কেন ভাঙা হবে? তাঁর বাড়তি ব্যাখ্যা, এই অরণ্যাবৃত পাহাড়ের টঙে হাজার হাজার অচেনা পুরুষের সঙ্গে অল্পবয়সি মহিলাদের সহাবস্থান ঘটলে, নিরাপত্তার প্রশ্নও নাকি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে!

সৈয়দ মুজতবা আলি বলতেন, স্থানীয় বাজার হল সেখানকার সব চেয়ে বড় সংবাদপত্র। আলি সাহেবের তত্ত্ব মেনে পাত্থানামিত্তায় পা দিয়েই পৌঁছেছিলাম সেখানকার সব চেয়ে বড় আয়ুর্বেদিক বাজার, খাদ্যপণ্য, বিভিন্ন মশলা আর আনাজের হাটে। দেখা গেল সাক্ষরতায় এগিয়ে থাকা, শিক্ষা সচেতন এই জনপদ আয়াপ্পা স্বামীর ঐতিহ্যকে আঁকড়ে আছে মনেপ্রাণে।

নির্বাচন কমিশন নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যে, আয়াপ্পা প্রসঙ্গ নির্বাচনী প্রচারে তোলা যাবে না। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা বাঁচিয়ে বিজেপি যে প্রবল ভাবে অন্য মেরুকরণের খেলায় নেমেছে, তা স্পষ্ট। আয়াপ্পা মন্দির এবং বাবর মসজিদের সুপ্রাচীন সহাবস্থান বা হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের অটুট ঐক্যের কারণে সাম্প্রদায়িক বিভেদ তৈরির প্রশ্ন এখানে ওঠে না। কিন্তু হিন্দু সংস্কার বাঁচানোর জন্য ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে (সুপ্রিম কোর্টের রায় বদল করার জন্য আবেদনপত্র বিবেচনাধীন, আবেগের অভিমুখ বুঝে ভোটের আগে এই নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছে ইউডিএফ এবং এলডিএফ) যদি জালে হিন্দু ভোট আসে!

এনডিএ তথা বিজেপির প্রার্থী কে সুরেন্দ্রন হাজতবাস করেছেন সেই সংঘর্ষের সময়। তিনি এখন হিন্দু সেনানী। প্রচারে খোলাখুলি বলছেন, ‘চিরাচরিত ঐতিহ্য বজায় রেখে চলার জন্য লড়াই বজায় চলবে। জিতে এলে কেন্দ্রকে চাপ দেব মন্দিরের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য আইন আনতে।’

সাড়ে তেরো লাখের এই নির্বাচনীক্ষেত্র আয়াপ্পার সম্মান রক্ষার আবেগে বিভোর। আর সেই আবেগে পদ্মফুল ফোটাতে স্থানীয় সমীক্ষা অনুযায়ী অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছে গত বছর মাত্র সওয়া লাখ ভোট পাওয়া বিজেপি। যা শুধু একটি নির্বাচনী ক্ষেত্রের হিসাব মাত্রই নয়, এই রাজ্যে দাঁত ফোটাতে বহুদিন ধরে চেষ্টা করা সংঘ পরিবারের কাছে আশীর্বাদের মতোই।

Lok Sabha Election 2019 Sabarimala BJP শবরীমালা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy