কথা হচ্ছিল বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের সদস্যদের সঙ্গে। খুবই উদ্বিগ্ন তাঁরা। এনআরসি যেখানে বাঙালি-অসমিয়ার বিভেদটাকে বাড়িয়ে দিয়েছে, নাগরিকত্ব বিল নতুন করে বিভেদ বাড়িয়েছে বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। এনআরসি-র উদ্দেশ্য বাংলাদেশ থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানো, যাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশ মুসলিম। কিন্তু এনআরসি-র ড্রাফট বেরোলে দেখা গেল, মাঝখান থেকে বাদ পড়েছেন বিরাট সংখ্যার হিন্দু বাঙালি। সুতরাং এ বার হিন্দু বাঙালি ক্ষোভ ঠেকিয়ে হিন্দু ভোট নিশ্চিত করতে বিজেপি সরকারকে আনতে হল নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল বা ‘ক্যাব’ (সিটিজ়েনসিপ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল)। বলতে হল, এনআরসি-ছুট হলেও ‘হিন্দু বাঙালি’দের ‘কোনও ভয় নেই’।
আর মুসলিমরা? সাম্প্রতিক কালে যাঁরা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছেন, তাঁদের কত শতাংশ মুসলিম? সমিতির সদস্যরা দ্বিমত। কারও মতে, এখন আসেন প্রধানত হিন্দুরাই, বাংলাদেশ ছেড়ে বাঙালি মুসলিমরা আসবেন কেন। আবার কারও মতে, সে কথা ঠিক নয়, অর্থনৈতিক সুযোগসুবিধার লোভে আজও এসে পড়েন দলে দলে মুসলিম বাঙালি। এবং ঘটনা হল— তাঁদের কাগজপত্র বেশির ভাগ সময়েই ঠিকঠাক থাকে। কাগজপত্র নেই বলে যাঁরা বাদ পড়ছেন, তাঁদের মধ্যে তাই বিরাট সংখ্যক হিন্দু বাঙালি। এই সব রাগ থেকেই তো
বাঙালি মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ করে অমিত শাহরা হাঁক ছাড়েন— ঘুসপেটিয়া!
নাগরিকত্ব বিলটি এ বার লোকসভায় পাশ হয়েছে, রাজ্যসভায় তা ওঠেনি। যদি উঠত সেই বিল, যদি পাশ হয়ে যেত, তা হলে তো হিন্দু বাঙালিদের আর ভয়ের কারণ ছিল না? এনআরসি বলছে— ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের পর যাঁরা ভারতে ঢুকেছেন, তাঁরা নাগরিক নন, আর নাগরিকত্ব বিল বলছে— ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর অবধি যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অমুসলিমরা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন, ... তাই তো? না, আরও মুশকিল আছে। সম্মেলনের সদস্যরা বুঝিয়ে বললেন, হিন্দুরা অতটা নিশ্চিন্ত হতে পারেন না, কারণ এই বিল তো সোজাসুজি নাগরিকতা ‘পাওয়া’র কথা বলেনি, ‘আবেদন করা’র কথা বলেছে কেবল। আবেদনপত্র এ দেশের সরকারি মতে গ্রাহ্য হলে তার পর পাঠানো হবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশে, তারা জানাবে ওই নামের মানুষ ওই সময়ে সে-দেশ ছেড়েছিল কি না। এ সব সারা হলে তবে তো নাগরিকত্বের প্রশ্ন! কিন্তু অর্থনৈতিক কিংবা সামাজিক কারণে যাঁরা রাতারাতি ঘর ছেড়ে দেশ ছেড়ে বেআইনি ভাবে সীমান্ত পেরিয়ে ঢুকেছেন, তাঁদের নাম আজ হঠাৎ ছেড়ে-আসা-দেশের সরকারি নথিতে মিলবে কী করে?
আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সম্মেলনের কাছাড় জেলা সভাপতি, একটি স্থানীয় দৈনিকের মালিক-সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরি বললেন, তাঁরা এই বিলকে সমর্থন করেন, কিন্তু ‘উইথ মডিফিকেশনস’, কিছু সংশোধন-সমেত। মানুষ যাতে শেষ পর্যন্ত বিলের মাধ্যমে উপকৃত হন, সেটা তো দেখতে হবে।
ঠিক। এতগুলি এনআরসি-ছুট মানুষের তো একটা কোনও ব্যবস্থা চাই। শিলচরের আইনজীবী ধর্মানন্দ দেবের সঙ্গে কথা হচ্ছিল আদালত চত্বরে। তিনি বলছিলেন, ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ নামক যে জেলে রাখা হচ্ছে এই মানুষগুলিকে, তাঁরা থাকছেন ক্রিমিনাল বা অপরাধীদের সঙ্গে। এমনটা তো অনির্দিষ্ট কাল ধরে চলতে পারে না। তাদের অন্য দেশে পাঠানোর প্রস্তাবও অবাস্তব। এখানেই নাগরিকত্ব বিলের গুরুত্ব।— কিন্তু মুসলিমরা যে বাদ পড়লেন এই বিলে? এটা কি সংবিধানসম্মত?— আইনের যুক্তি দিয়ে বোঝালেন আইনজীবী, সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় যে সাম্যের অধিকারের কথা বলা হয়েছে, তার ব্যতিক্রম যে সম্ভব, সে কথাও তো আইনেই আছে। ব্যতিক্রমের জন্য চাই ‘রিজনেবল ক্লাসিফিকেশন টেস্ট’। নাগরিকত্ব বিলে অ-মুসলিমদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব কিন্তু সেই ‘পরীক্ষা’টিতে উতরে যায়। দেশভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে, আর তাই দেশভাগ-পরবর্তী অমুসলিম উদ্বাস্তুদের জন্য ১৯৫৫ সালে সংসদে পাশ হওয়া আইনের সংশোধনী এই ‘ক্যাব’। মোট কথা, এই বিলে বিরাট পরিমাণ দেশহারাদের অন্তত কিছু লোককে বাঁচানোর একটা মানবিক পথ পাওয়া সম্ভব।
শুনতে শুনতে ভাবছিলাম, সেই দেশভাগ! কামরূপ-প্রাগ্জ্যোতিষপুরের দুর্ভাগ্য, ওই মাটিতে আজও প্রতি দিনের জীবন্ত সঙ্কট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাতচল্লিশের দেশভাগ। ধর্ম নিয়ে নেতাদের রাজনীতির আসল দামটা সে দিনও যাঁরা চুকিয়েছেন, আজও ভোটের দামামা বেজে উঠলে সরে যাচ্ছে তাঁদেরই পায়ের তলার মাটি। মানুষের অসহায়তায় ছলছল করে উঠছে দেশ। আর প্রস্তুত হচ্ছে ইভিএম।