Advertisement
E-Paper

নেপাল নিমেষে মৃত্যুর দেশ, ত্রাস ভারতেও

যেন ফিরে এল ৮১ বছর আগে জানুয়ারির সেই দুপুর! ১৯৩৪-এর এই ভরদুপুরে নেপাল কেঁপে উঠেছিল এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৮.১। নেপাল ও বিহার মিলিয়ে মারা গিয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। শনিবার দুপুরে নেপালে জন্ম নেওয়া ভূমিকম্প অবশ্য সেই মাত্রা পেরোতে পারেনি।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২৭
ভূকম্পের বলি। কাঠমান্ডুতে বাড়ি ধসে মৃত্যু। ছবি: রয়টার্স।

ভূকম্পের বলি। কাঠমান্ডুতে বাড়ি ধসে মৃত্যু। ছবি: রয়টার্স।

যেন ফিরে এল ৮১ বছর আগে জানুয়ারির সেই দুপুর!
১৯৩৪-এর এই ভরদুপুরে নেপাল কেঁপে উঠেছিল এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে। রিখটার স্কেলে তার মাত্রা ছিল ৮.১। নেপাল ও বিহার মিলিয়ে মারা গিয়েছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। শনিবার দুপুরে নেপালে জন্ম নেওয়া ভূমিকম্প অবশ্য সেই মাত্রা পেরোতে পারেনি। মার্কিন ভূতত্ত্ব সংস্থা (ইউএসজিএস) জানিয়েছে, এ দিন ভারতীয় সময় বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে পোখরার লোপজাঙে জন্ম নেওয়া ভূমিকম্পটির মাত্রা ছিল ৭.৯। মূল ভূমিকম্পের পরে অন্তত ১৬ বার আফটার-শকে কেঁপে উঠেছে মাটি। এ দিনের ঘটনার পরেই ভারতের ন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট দাবি করেছে, ১৯৩৪ সালের পর নেপালের ইতিহাসে এটাই সব থেকে বড় ভূমিকম্পের ঘটনা।

এ দিনের ভূমিকম্পে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাঠমান্ডু-সহ নেপালের বহু এলাকা। সংবাদ সংস্থার খবর, রাত পর্যন্ত নেপালে অন্তত ১৫০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এঁদের মধ্যে দু’জন ভারতীয়। আহত কয়েক হাজার। ভারতে মোট ৫১ জনের মৃত্যুর খবর জানিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার, যাঁদের মধ্যে বিহারেই মারা গিয়েছেন ২৫ জন। কাঠমান্ডুতে ইউনেস্কো স্বীকৃত ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ দরবার স্কোয়ার চুরমার হয়ে গিয়েছে। ভেঙে গিয়েছে দু’শো বছরের পুরনো ধরহরা মিনার। তার ভিতরেও অনেকে আটকে ছিলেন। তবে ঐতিহ্যশালী পশুপতিনাথ মন্দিরটি সম্পূর্ণ অক্ষত আছে। উত্তর বিহারের বিভিন্ন জেলায় বহু ঘরবাড়িও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভূকম্প মালুম হয়েছে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং চিনের তিব্বতেও। ভরদুপুরে কলকাতারও বুক কেঁপেছে ভূকম্পে। উত্তরবঙ্গে মারা গিয়েছেন ৩ জন। উত্তরপ্রদেশে ৮ জন মারা গিয়েছেন। পূর্ব উপকূলের ওড়িশা থেকে পশ্চিম উপকূলের মুম্বই পর্যন্ত কেঁপে উঠলেও সেখানে কোনও ক্ষয়ক্ষতির খবর নেই। ভূমিকম্পের জেরে এ দিন মাউন্ট এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে ভয়াবহ তুষার ধস নামে। সেখান থেকে রাত পর্যন্ত ৮ জন অভিযাত্রীর দেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ১২ জন বাঙালি অভিযাত্রী তুষার ধসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছেন। আটকে পড়া ভারতীয়দের উদ্ধারের চেষ্টা শুরু করেছে দিল্লি।
ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, হিমালয় পর্বতমালার ভূস্তরের নীচে ভারতীয় ও ইউরেশীয় পাত রয়েছে। সেই পাতের ঠোকাঠুকিতে মাঝেমধ্যেই ভূমিকম্প হয়। তার মধ্যে কয়েকটি অঞ্চল সব থেকে বেশি ভূকম্পপ্রবণ বলে চিহ্নিত। এ দিন ওই দুই পাতের সংঘাতেই কেঁপে উঠেছে পোখরা উপত্যকা। ভূমিকম্পের উৎসস্থল ছিল মাটির ১১ কিলোমিটার নীচে। ভূকম্পের কেন্দ্রস্থল অগভীর হওয়ায় কাঁপুনির তীব্রতা ছিল অনেক বেশি।
তবে বিজ্ঞানীদের একাংশ বলছেন, পোখরার ওই লাপজাঙ এলাকায় জনবসতি খুবই কম। তা সত্ত্বেও এত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর বদলে ভূকম্পের উৎসস্থল কাঠমান্ডুর মতো জনবহুল এলাকায় হলে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়ত।
সংবাদ সংস্থা সূত্রের খবর, ভরদুপুরে নেপালে তখন রাস্তাঘাটে লোক গিজগিজ করছে। হঠাৎই থরথর করে কেঁপে ওঠে চারপাশ। একের পর এক বাড়ি, পাঁচিল ভেঙে পড়তে থাকে। ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসা ধুলোয় ভরে যায় আকাশ। ভূকম্পের অভিঘাতে ব়ড় বড় ফাটল ধরে যায় রাস্তায়! নেপালের প্রশাসন জানিয়েছে, ঘটনার পরেই সেনা, পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে নামানো হয়। ধ্বংসস্তূপ থেকে আহতদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয় বিভিন্ন হাসপাতালে। মৃতদেহগুলি পৌঁছনো হতে থাকে নির্দিষ্ট স্থানে। ভূকম্পের আতঙ্ক নিয়েই মানুষজন লেগে পড়েন প্রিয়জনের খোঁজে। অনেকেই প্রিয়জনকে খুঁজে পেয়েছেন নিথর অবস্থায়, অনেকে রাত পর্যন্ত হাতড়ে ফিরেছেন বিভিন্ন হাসপাতাল-মর্গে। বহু মানুষই গৃহহীন হয়ে পড়েছেন। তাঁদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মূল ভূকম্পের পরে ১৬ বার আফটার-শকেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই ভয়ে ছুটোছুটি করতে থাকেন। ইতিমধ্যেই নেপাল প্রশাসন জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না। তবে দুপুরে বন্ধ করে দেওয়া ত্রিভুবন বিমানবন্দর সন্ধ্যায় খুলে দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ ও উদ্ধারকারী দল নিয়ে পৌঁছেছে ভারতীয় বায়ুসেনার চারটি বিমান।
নেপালের পরেই ভূমিকম্পে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিহারের উত্তর অঞ্চল। ভূতত্ত্ববিদেরা বলছেন, নেপাল সীমান্তে অবস্থিত উত্তর বিহার দেশের সব থেকে বেশি ভূকম্পপ্রবণ এলাকাগুলির মধ্যে রয়েছে। তাই সেখানে ক্ষয়ক্ষতি বেশি হয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার জানান, ভূকম্পের জেরে বিহারে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃতদের পরিবারকে ৪ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। বিহার প্রশাসনের কর্তারা জানান, পূর্ব চম্পারণ জেলায় ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৬ জন মারা গিয়েছেন সীতামঢ়ীতে। মৃত্যুর খবর মিলেছে পশ্চিম চম্পারণ, সারন, মধুবনী, দ্বারভাঙা, আরাড়িয়া, শিওহর, সুপলে। প্রশাসনিক কর্তারা জানান, মৃতদের বেশির ভাগই বৃদ্ধ অথবা শিশু। মাটির কিংবা পুরনো বাড়ির দেওয়াল ভেঙেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাচক্রে, গত বুধবারই প্রবল ঝড়বৃষ্টিতে পূর্ণিয়া, মাধেপুরা, ভাগলপুরে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ক্ষত শুকোনোর আগেই ফের বিহারকে কাঁপিয়ে দিল প্রকৃতি। উত্তরপ্রদেশেও মৃতদের পরিবারকে ৫ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিংহ যাদব।

এ দিন দুপুরে দিল্লির বিহার ভবনে ছিলেন নীতীশ। সেখানেই ভূকম্প টের পেয়ে বেরিয়ে আসেন। রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের কাছ থেকে পরিস্থিতির খোঁজ নেন। তার পরেই দিল্লি থেকে পটনায় ফিরে আসেন। তিনি জানান, ভূকম্পবিধ্বস্ত এলাকায় রাতে সরকারি অফিসারেরা থাকবেন। এ দিন ভূকম্পের পরে দেখা যায়, পটনার সঙ্গে বৈশালীর সংযোগকারী গাঁধী সেতুর অন্তত ৬টি স্তম্ভে ফাটল ধরেছে। ভূকম্পের পরেই পটনা-সহ বিহারের বিভিন্ন জায়গায় মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে রাস্তা নেমে আসেন। স্তব্ধ হয়ে যায় যানবাহনও। বিহারে টেলি-পরিষেবাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় টেলিকম মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ মন্ত্রকের কর্তাদের তা দ্রুত ঠিক করার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ দিন ভূমিকম্পের পরে দেশজুড়ে মোবাইল ফোনের যোগাযোগের সমস্যা দেখা দেয়। তা চলে অন্তত ৩০ থেকে ৬০ মিনিট। যদিও টেলিকম সংস্থাগুলি জানিয়েছে, এটি কোনও পরিকাঠামোগত সমস্যার জন্য হয়নি। প্রচুর গ্রাহক এক সঙ্গে মোবাইলে ফোন করতে থাকায় লাইন জ্যাম হয়ে গিয়েছিল। এটি অল্প কিছু ক্ষণের মধ্যেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল বলে টেলিকম কর্তাদের দাবি। বিএসএনএল জানিয়েছে, আগামী তিন দিন তাঁদের গ্রাহকেরা লোকাল কলের খরচেই নেপালে ফোন করতে পারবেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মৃত ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে রবিবার তিনি উত্তরবঙ্গে যাবেন। ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে রিপোর্ট পাঠাবেন। ইতিমধ্যেই তিনি রাজ্যে সঙ্কট মোকাবিলা দল গড়েছেন। ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করতে মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যের কমিটিও গড়া হয়েছে। কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে। তার নম্বর ১০৭০ এবং ২২১৪৩৫২৬। মুখ্যমন্ত্রী জানান, মৃতের পরিবার ও আহতরা সরকারের ক্ষতিপূরণ পাবেন। ভূমিকম্পে ম়ৃত্যুর জন্য কলকাতায় নিযুক্ত বাংলাদেশের ডেপুটি হাই-কমিশনার জকি আহাদ মুখ্যমন্ত্রীকে সমবেদনা জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীও বাংলাদেশের মানুষ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাল্টা ধন্যবাদ জিনিয়েছেন।

ধ্বংসস্তূপের ছবি: এপি, এফপি, রয়টার্স ও পিটিআই।

Nepal Darbar Squar Kathmandu Dharhara earthquake India abpnewsletters
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy