অঙ্কন: সুমন চৌধুরী।
মন্ত্রিসভার বৈঠকেও ‘জিরো আওয়ার’ চালু করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। লক্ষ্য, মন্ত্রীরা যাতে নিজেদের মধ্যে কথা বলে সমস্যা দ্রুত মিটিয়ে ফেলতে পারেন।
তার ফলও মিলতে শুরু করেছে। মন্ত্রিসভার প্রতিটি বৈঠকে সূচি অনুসারে আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই মন্ত্রীরা অনেকেই নিজেদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে খোলাখুলি বিতর্ক শুরু করে দিচ্ছেন। এমনিতেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এক মন্ত্রকের সঙ্গে অন্য মন্ত্রকের ঝগড়া লেগেই থাকে। এখন প্রধানমন্ত্রীর সামনে এবং তাঁরই নির্দেশে ওই সব বিষয় নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ হচ্ছে। তুমুল ঝগড়াঝাটির মধ্য দিয়ে বহু ক্ষেত্রে ওখানেই সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসছে। প্রয়োজনে বিভাগীয় সচিবরা ফাইল এনে তথ্য সরবরাহ করছেন। দুই বা ততোধিক মন্ত্রীর মধ্যে এই ঝগড়ার মীমাংসা সম্ভব না হলে হস্তক্ষেপ করছেন প্রধানমন্ত্রী নিজেই।
গুজরাতেও মন্ত্রিসভার বৈঠকে মোদী এই ‘জিরো আওয়ার’ চালু করেন। ওখানে মোদী নিজে উপস্থিতও থাকতেন না। প্রথম আধ ঘণ্টা, এমনকী কখনও এক ঘণ্টা ধরে একাধিক মন্ত্রী বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কার্যত ফ্রি স্টাইল কুস্তি লড়তেন! দিল্লিতে অবশ্য পরিস্থিতিটা এখনও পর্যন্ত অন্য রকম। এখনও পর্যন্ত ‘জিরো আওয়ারে’র ওই ঝগড়ায় মোদী নিজেই হাজির থাকছেন। তবে তিনি মন্ত্রীদের জানিয়ে দিয়েছেন, এই পরীক্ষা সফল হলে কিছু দিন পরে তিনি নিজে আর আগেভাগে উপস্থিত থাকবেন না। গুজরাতে এই মডেল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ক্ষিপ্রতা আনতে সাহায্য করেছিল। তাই দিল্লিতেও আবার একটি গুজরাত মডেল বাস্তবায়িত করতে চাইছেন মোদী।
এই তো ক’দিন আগে মন্ত্রিসভার বৈঠকে মানেকা গাঁধীর সঙ্গে রবিশঙ্কর প্রসাদের তুলকালাম বেধেছিল। মহিলা ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী মানেকার প্রস্তাব ছিল, মহিলা কমিশনের হাতে আরও ক্ষমতা দিতে হবে। যৌন হেনস্তার শিকার নারীদের কল্যাণে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা কমিশনকে দিতে হবে। না হলে কমিশন ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সংসদে বিল আনার দাবিও জানান তিনি। মানেকার এই লিখিত প্রস্তাব কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ খারিজ করে দেন। রেগে গিয়ে মানেকা আবার তাঁকে চিঠি পাঠান। মন্ত্রিসভার বৈঠকে দুই মন্ত্রীর মধ্যে বিবাদ জমে ওঠে। ‘জিরো আওয়ারে’ এই সমস্যার সমাধান কিন্তু এখনও হয়নি।
কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির কথাই ধরা যাক। মিড-ডে মিল নিয়ে ক্যাবিনেট নোট জমা দিয়েছিলেন তিনি। ক্যাবিনেট সচিব প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি জানান। কিন্তু যে হেতু বিষয়টি নিয়ে ‘জিরো আওয়ারে’ আলোচনা হয়নি, তাই একে মন্ত্রিসভার আলোচ্যসূচিতে এখনই না রাখার পরামর্শ দিয়েছেন মোদী।
মনমোহন সিংহ যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে সবচেয়ে বেশি তর্ক হতো প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং পি চিদম্বরমের মধ্যে। দু’জনেই প্রচুর হোম ওয়ার্ক করে আসতেন। প্রণববাবু শুধু নিজের দফতর নয়, অন্য দফতরেরও ফাইল বৈঠকের আগের দিন বাড়িতে রাত জেগে পড়ে ফেলতেন।
অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় লালকৃষ্ণ আডবাণীর সঙ্গে ব্রজেশ মিশ্র আর বিদেশ মন্ত্রী যশোবন্ত সিংহের প্রচুর বাগবিতণ্ডা হতো। বেশির ভাগ সময়ই তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ উপ প্রধানমন্ত্রী আডবাণীকে সমর্থন করতেন। কার্গিল যুদ্ধের সময়ও মন্ত্রিসভার বৈঠকে রণকৌশল নিয়ে প্রচুর বিবাদ হয়েছে। মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠকেও তর্কাতর্কি কম হয়নি।
মোদী আসলে মন্ত্রিসভার বৈঠককে সুকৌশলে দু’টি পর্বে ভাগ করে দিতে চাইছেন। যার শুরুতেই জিরো আওয়ার। যেখানে মন্ত্রীদের খোলামেলা মত বিনিময়ের মধ্য দিয়ে অনেক বিষয়ে দূরত্ব কাটানোর ও সঠিক পথে পৌঁছনোর সুযোগ থাকছে। বাজপেয়ী বা মনমোহন সিংহ, যার আমলই হোক না কেন, বিতর্কিত বিষয়ের ফয়সালা করতে মন্ত্রিগোষ্ঠীর বিশেষ ভূমিকা ছিল। যে কোনও ধরনের বিবাদ হলে মীমাংসাসূত্র বার করার দায়িত্ব মন্ত্রিগোষ্ঠীকে দেওয়া হতো। বাজপেয়ীর আমলে আডবাণী এবং মনমোহন জমানায় প্রণববাবু মূলত এই সব মন্ত্রিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিতেন। মন্ত্রিগোষ্ঠী গড়ার সেই সংস্কৃতি লোপ পেয়েছে মোদীর আমলে। ফলে এখন মন্ত্রিসভার বৈঠকেই দুই বা তার বেশি মন্ত্রকের বিবাদ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। তা সে বিদেশি লগ্নির শতকরা পরিমাণই হোক বা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি পিছিয়ে দেওয়া।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে কী হয়, তা নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তাঁর মন্তব্য, অর্থমন্ত্রীকে একটু কথা বলতে হয়ই। কারণ, সেই নেহরুর আমল থেকে সব অর্থমন্ত্রীই আক্রমণের লক্ষ্য হয়েছেন। সব দফতরই বরাদ্দ পায় অর্থ মন্ত্রক থেকে। তাই সবার ব্যাপারেই শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীকে কথা বলতে হয়।
সংসদে জিরো আওয়ার শুরু হয়েছিল ১৯৬০ সালে। সকালে প্রশ্নোত্তর পর্বের পর এই সময় দলমত নির্বিশেষে সব সাংসদ তাঁদের অভাব অভিযোগের কথা জানানোর সুযোগ পাবেন, এটাই ছিল উদ্দেশ্য। তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘জিরো আওয়ার’ নামটা দেওয়া হয় নবম লোকসভায়। তখন স্পিকার ছিলেন রবি রায়। অভিধান অনুসারে ‘জিরো আওয়ার’ শব্দটির অর্থ, একটা গুরুত্বপূর্ণ সংক্ষিপ্ত সময়, অথবা সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রহর। সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্ব এবং সাধারণ কার্যাবলীর মাঝের সময়টিকে জিরো আওয়ার বলা হয়। মোদী মন্ত্রিসভার বৈঠকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘জিরো আওয়ার’ নামটি দেননি। কিন্তু মন্ত্রীদের মুখে মুখে এখন ফিরছে ‘জিরো আওয়ার’-এর কাহিনি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy