ছবি: এএফপি।
কলকাতা শহরতলির ট্রেনের যাত্রীদের মতো মুম্বইয়ের নিত্যযাত্রীরা কিন্তু এমন ‘কালিদাস’ নন!
ওয়েস্টার্ন রেল, সেন্ট্রাল রেল আর হারবার রেল যে ‘মুম্বইয়ের জীবনপথ’, তা সেখানকার নিত্যযাত্রীরা জানেন। কথায় কথায় অবরোধ আর স্টেশন ভাঙচুরে যে আসল ক্ষতিটা তাঁদেরই সেটা বোঝেন বলেই পারতপক্ষে সে পথে হাঁটেন না তাঁরা।
তবে কালেভদ্রে রাজনৈতিক দলের বিক্ষোভে ট্রেন আটকে গেলে যাত্রীরা নিজেরাই ওই অবরোধ সরিয়ে দিতে নেমে পড়েন লাইনে। প্রযুক্তিগত কারণে ট্রেন আটকে যাওয়ার ঘটনাও বড় একটা ঘটে না।
আদতে কলকাতার বাসিন্দা হলেও চাকরি সূত্রে আমি মুম্বই চলে আসি ১৯৭৯ সালে। প্রায় ৩০ বছরেরও বেশি আমি মুম্বইয়ের শহরতলির ট্রেনের নিত্যযাত্রী। অফিস যাতায়াতের এটাই ছিল আসল মাধ্যম। শহরতলির রেল ব্যবস্থা এতটাই মসৃণ যে কখনও সড়কপথে অফিস যাওয়ার কথা ভাবিওনি। যদিও আমাকে অফিস যেতে হলে দু’বার ট্রেন বদলাতে হত।
বুধবার মাতৃভূমি লোকাল ঘিরে পুরুষ ও মহিলা যাত্রীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ এবং তার জেরে ভাঙচুর ও বিভিন্ন জায়গায় রেল অবরোধের কথা শুনে আমি অবাক। মুম্বইয়ে এমনটা ভাবাই যায় না। প্রথমত ওখানে কেউই নিজেদের ক্ষতি করতে এমন হঠকারী কাজ করব না। মুম্বইয়ে নিত্যযাত্রীদের মানসিকতাই এমন যে এই ধ্বংসাত্মক পথে তাঁরা যাবেন না। আর এর জন্য কড়া পুলিশি ব্যবস্থাও মানুষকে সচেতন করতে অনেকটা সাহায্য করেছে।
স্টেশনে পানের পিক ফেলব, সিগারেট-বিড়ি ধরাব, জোর করে মহিলা কামরায় উঠব— এমন সব কথা কেউ ভাবনাতেও আনবেন না। কারণ, জিআরপি কিংবা আরপিএফ মুম্বইতে বড্ড কড়া। ঠিক ধরে ফেলবে এবং চালান করে দেবে। কাউকেই রেয়াত করে না তারা। বুধবার শিয়ালদহের বনগাঁ শাখার বিভিন্ন স্টেশনে যা হল, তাতে দেখলাম পুলিশ নীরব দর্শক। পুলিশকে কেউ পাত্তাই দিচ্ছে না। আইন যে যার নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। মুম্বইতে এমনটা ভাবতেও পারতাম না। পুলিশ দুষ্কৃতীদের ডান্ডা মেরে ঠাণ্ডা করে দিত।
যদিও মুম্বইয়ে শহরতলি শাখায় রেলের পরিকাঠামো কলকাতার থেকে অনেক ভাল। বেশির ভাগ ট্রেনই বারো কামরার। কিছু কিছু নয় কামরার ট্রেনও আছে। যেগুলি মূলত হারবার লাইনে চলে। হারবার লাইনে অনেক দিন ধরেই বারো কামরার ট্রেন চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু এই লাইনে ব্রিজগুলি ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়ায় প্ল্যাটফর্ম বড় করার কিছু অসুবিধা রয়েছে বলে সেই কাজ আটকে রয়েছে।
সমস্ত বারো কামরার ট্রেনেই তিনটি করে এবং নয় কামরার ট্রেনে দুটি করে কামরা মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। তা ছাড়া শুধু মহিলাদের জন্যও ট্রেন রয়েছে। তা নিয়ে পুরুয যাত্রীদের কোনও আন্দোলনে কখনও যেতে দেখিনি। পুরুয যাত্রীরা জানেন, ওই ট্রেন তাঁদের জন্য নয়। তাই ট্রেনের কাছেই এগোন না তাঁরা।
মুম্বইয়ে সারাদিনই অসংখ্য মানুষ ট্রেনে যাতায়াত করেন। ভিড়ও হয় মারাত্মক। কিন্তু শিয়ালদহ শাখার মতো একে অন্যকে ঠেলে-গুঁতিয়ে ট্রেনে ওঠবার দরকার পড়ে না। কারণ ওয়েস্টার্ন, সেন্ট্রাল এবং হারবার রেলওয়ের প্রত্যেকটি শাখাতেই পাঁচ থেকে দশ মিনিট অন্তর ট্রেন আছে। এখানে যে ট্রেনগুলি সব স্টেশনে দাঁড়ায় সেগুলিকে বলে ‘স্লো’ ট্রেন আর যে সব ট্রেন শুধুমাত্র নির্ধারিত স্টেশনে দাঁড়ায় সেগুলির নাম ‘ফাস্ট’ ট্রেন। রাত আড়াইটে থেকেই শুরু হয়ে যায় ট্রেন চলাচল এবং শেষ ট্রেন প্রান্তিক স্টেশনে পৌঁছয় রাত একটা-দেড়টা নাগাদ। ফলে প্রথম ট্রেন ও শেষ ট্রেনের মধ্যে ব্যবধান মাত্র ঘণ্টাখানেকের।
রাতের এবং ভোরের দিকের ট্রেনের মহিলা কামরাগুলিতে সবসময়ই পুলিশ থাকে। আগে দু’-এক বার রাতের মহিলা কামরায় চুরি, ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠার পর মুম্বই রেল পুলিশ এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।
এখানকার স্টেশনগুলিও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সিডকো (সিটি অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন) এবং রেলের যৌথ উদ্যোগে স্টেশনগুলির দেখভাল করা হয়। হকারের সংখ্যাও খুবই কম। রেলের অনুমোদিত হকার ছাড়া অন্য কোনও হকার প্ল্যাটফর্মে বসতে পারে না।
আসলে কথা হল, মুম্বইবাসী জানেন এই রেলের ওপরেই কিন্তু মুম্বইয়ের প্রধান যাতায়াত ব্যবস্থা নির্ভর করে। তাই নিজেদের ভালর জন্যই রেল অবরোধ বা ভাঙচুরের কথা ভাবতেও পারেন না তাঁরা। তাঁরা বোঝেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করা যায় না।
(লেখক মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেনের যাত্রী)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy