Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সঙ্ঘ-সীমা লঙ্ঘন না করেই মুসলিম মন ছোঁয়ার চেষ্টায় মোদী

সরাসরি বলছেন না। তবে বার্তা একটা আছেই। কী সেটা? ‘সমঝদারো কো ইশারা হি কাফি!’ প্রধানমন্ত্রীর সদ্যসমাপ্ত রিয়াধ সফরের পর এমনটাই বলছেন নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠরা। এই সফরে সৌদি আরবের সঙ্গে নিরাপত্তা ও বাণিজ্য— দু’ক্ষেত্রেই সূচনা হল বেশ কিছু নতুন উদ্যোগের।

সৌদির রাজার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এএফপি।

সৌদির রাজার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি: এএফপি।

অগ্নি রায়
শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:১৩
Share: Save:

সরাসরি বলছেন না। তবে বার্তা একটা আছেই। কী সেটা?

‘সমঝদারো কো ইশারা হি কাফি!’ প্রধানমন্ত্রীর সদ্যসমাপ্ত রিয়াধ সফরের পর এমনটাই বলছেন নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠরা। এই সফরে সৌদি আরবের সঙ্গে নিরাপত্তা ও বাণিজ্য— দু’ক্ষেত্রেই সূচনা হল বেশ কিছু নতুন উদ্যোগের। এরই পাশাপাশি মোদীর এই সফর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বিশেষ বার্তা দিল বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

• মুখে ঘটা করে না বলেও দেশের সংখ্যালঘু সমাজকে একটা সদর্থক বার্তা দেওয়া, তাঁদের কাছে পৌঁছনো।

• পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়ার অস্থির পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে নরমপন্থী মুসলিম সমাজকে এক ছাতায় নিয়ে আসার কাজ— একই সঙ্গে সারার চেষ্টা করেছেন মোদী।

বিরোধী রাজনীতিকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর কুর্সির নাম বাবাজি! পাঁচ বছর আগেই গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় যে মোদী একটি গ্রামের দরগা থেকে দেওয়া ফেজ টুপি পরতে অস্বীকার করেছিলেন, দু’দিন আগে তাঁকেই দেখা গেল মক্কা-মদিনার দেশে ইমামের সঙ্গে বৈঠক করতে। রাজা সালমান বিন আব্দুলাজিজ আল সৈয়দ থেকে শুরু করে যুবরাজ শেখ সালেহ বিন মহম্মদ— সব নেতার সঙ্গে মোদী যথেষ্ট উষ্ণতা বিনিময় করেছেন স্বল্পমেয়াদি এই সফরে।

সৌদি আরবের সঙ্গে এই সখ্যের পিছনে আমেরিকার চাপ কতটা?

এটা ঘটনা, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি নিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর পর গোটা পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য কায়েমের প্রশ্নে শিয়া-সুন্নি সংঘর্ষের আশঙ্কা বেড়েছে। রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে আইএস জঙ্গি গোষ্ঠী। ঠিক এমন একটা অবস্থায় সুন্নিপ্রধান সৌদি আরবের সঙ্গে ভারতের মতো দেশের ঐক্যবদ্ধ থাকাটা পশ্চিম বিশ্ব তথা আমেরিকার জন্য প্রয়োজনীয়।

তবে রাজনীতির লোকজন কিন্তু মনে করছেন, শুধুই আমেরিকার চাপ নয়। নিজের একটা নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন মোদী। তবে খুব সতর্ক ও নিয়ন্ত্রিত ভাবে। রাজনীতির লাভক্ষতির অঙ্ক কষেই তিনি আরএসএস এবং অমিত শাহের হিন্দুত্ব লাইন বজায় রাখছেন। আবার খুব মন্থর গতিতে হলেও মুসলিম মনকে ছোঁয়ার চেষ্টা শুরু করেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক কর্তার মতে, ‘‘মোদী জানেন যে মক্কা-মদিনার দেশে গিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে রুটি ভাগ করে খাওয়ার অর্থ দেশের সুন্নি সম্প্রদায়ের মুসলিমদের কাছে বার্তা যাওয়া। এটা মনে রাখতে হবে যে ভারতের ১৭ কোটি মুসলিমের মধ্যে প্রায় ১২ কোটিই সুন্নি সম্প্রদায়ের।’’

মোদী-ঘনিষ্ঠ রাজনীতিকরা অবশ্য এ-ও বলছেন, মুসলিম মনের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা করলেও বিষয়টি এমন নয় যে, প্রধানমন্ত্রী আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের লাইন ভেঙে বেরিয়ে আসছেন। সম্প্রতি দুর্গাপুরে আজানের সময় বক্তৃতা থামিয়েছিলেন মোদী। তাঁরই সরকারই কিন্তু আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সংখ্যালঘু’ তকমা ঘোচানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করছে, যাতে সেখানে সংখ্যালঘুদের জন্য অর্ধেক আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা বাতিল করে তফসিলি জাতি, উপজাতি এবং ওবিসি-দেরও সংরক্ষণের সুবিধা দেওয়া যায়। দাদরি-কাণ্ডের পর ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে দেশ যখন উত্তাল, পাথুরে নীরবতা বজায় রেখেছিলেন মোদী। এখন সঙ্ঘের নিয়ন্ত্রণরেখায় থেকেও যতটা সম্ভব সংখ্যালঘুদের মনের কাছাকাছি পৌঁছনোর একটা রাজনৈতিক চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী।

কয়েক বছর আগেও যা নাকি ছিল অভাবনীয়।

এরই সঙ্গে নরমপন্থী মুসলিম সমাজকে এক ছাতায় আনার চেষ্টাও চালাচ্ছেন মোদী। এই সূত্রেই আরও একটি ঘটনার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা। ব্রাসেলসে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার এক সপ্তাহ আগে দিল্লিতে বিশ্ব সুফি সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন মোদী। সেখানে তিনি ‘শান্তিপূর্ণ ইসলাম’ ও সুফি সম্প্রদায় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনাও করেন। বলেন, ‘‘আল্লার ৯৯টি নাম রয়েছে। কিন্তু কোনওটিই হিংসা বা শক্তি প্রদর্শনের কথা বলে না। বরং প্রথম দু’টি নামের মানে দয়া ও সহমর্মিতা। আল্লা হলেন সেই রেহমান ও রহিম।’’ সুফি-মতে বিশ্বাসীদের উদ্দেশে বলেন, ‘‘সন্ত্রাসের ছায়া যখন লম্বা হচ্ছে তখন আপনারাই আশার আলো। সুফিবাদ ভারতীয় ইসলামের মুখ হয়ে উঠেছে।’’

এরও আগে নয়াদিল্লিতে আবু ধাবির যুবরাজ শেখ মহম্মদ বিন জায়েদের সঙ্গে বৈঠকেও মোদী এই নরমপন্থার ইসলাম নিয়ে চর্চা করেছিলেন। তাঁদের আলোচ্য ছিল, সুন্নি অধ্যুষিত পশ্চিম এশিয়ায় নরমপন্থী ইসলামের আদর্শকে পুরোপুরি হাইজ্যাক করা হচ্ছে চরমপন্থা ও সন্ত্রাসবাদের মাধ্যমে। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং ভারতের সঙ্গে জোট বাঁধতে প্রস্তুত সংযুক্ত আরব আমির শাহি। মোদীর সফরে সৌদি আরবের সঙ্গে যে যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতেও সন্ত্রাস দমনের প্রশ্নে এই অংশীদারিত্বের কথাই বারবার বলা হয়েছে। এটাও কিন্তু দেখা যায়নি ক’বছর আগে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE