Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
National News

বিচারে দেরি আটকাতে নয়া লড়াই

সাত বছর তিন মাস হয়ে গিয়েছে। ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির ২৩ বছরের ফিজিওথেরাপির ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনা। ২৯ ডিসেম্বর নির্ভয়ার মৃত্যু হয়।

ছবি: সংগৃহীত।

ছবি: সংগৃহীত।

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০২০ ০৪:২১
Share: Save:

তিনতলার ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই একটা বাচ্চাদের প্লে-স্কুল দেখা যায়। পাশেই পলিক্লিনিক। অনেক ডাক্তার বসেন।

বাড়ির বড় মেয়ে বেঁচে থাকলে হয়তো এমনই কোনও পলিক্লিনিকে কাজ করতেন। আশা সিংহ বলেন, ‘‘আমাকে এখন সবাই নির্ভয়ার মা বলে। মেয়ে বেঁচে থাকলে আমাকে হয়তো সবাই ডাক্তারের মা বলে ডাকত। মা হিসেবে আজ আমার ধর্ম পালন করলাম।’’

দক্ষিণ দিল্লির দ্বারকার ১৯ নম্বর সেক্টরের এই আবাসনের ফ্ল্যাটের দেওয়ালে অবশ্য আশাদেবীর মেয়ের কোনও ছবি নেই। শুধু একটা জ্বলন্ত শিখার ছবি।

সাত বছর তিন মাস হয়ে গিয়েছে। ২০১২-র ১৬ ডিসেম্বর দিল্লির ২৩ বছরের ফিজিওথেরাপির ছাত্রীর গণধর্ষণের ঘটনা। ২৯ ডিসেম্বর নির্ভয়ার মৃত্যু হয়। তার পরে ২০১৩-র মার্চে সরকারের দেওয়া দ্বারকার ফ্ল্যাটে দুই ছেলেকে নিয়ে উঠে এসেছিলেন আশা ও বদ্রীনাথ। বৃহস্পতিবার আদালতে যাওয়ার আগে মেয়ের ছবির সামনে হাতজোড় করে প্রণাম করেছিলেন আশাদেবী। তার পরে সারাদিন প্রথমে দিল্লি হাইকোর্ট, তার পরে রাত পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টে দৌড়ে বেড়ালেন দু’জনে। নির্ভয়া-কাণ্ডের অপরাধীদের আইনজীবীরা শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত ফাঁসি ঠেকানোর চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। সারা রাত চোখের পাতা এক করতে পারলেন না আশাদেবীও।

আরও পড়ুন: ‘সে দিন যা হয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি’

লড়াই শেষ হল বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে তিনটেয়। নির্ভয়ার অপরাধীদের আইনজীবী এ পি সিংহ মাঝরাতে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের বাড়ি পৌঁছন। রাত আড়াইটের সময় আদালত খুলে বিচারপতি আর ভানুমতীর নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ শুনানিতে বসে। এক ঘণ্টা শুনানির পরে আদালত অপরাধীদের আর্জি খারিজ করে ফাঁসি বহাল রাখল।

নির্ভয়ার মৃত্যুর পর আইন সংশোধন

ক্রিমিনাল ল’অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ২০১৩ বা নির্ভয়া অ্যাক্ট
• ২০১৩ সালের ৩ এপ্রিল থেকে আইন কার্যকর
• মেয়েদের উপর অত্যাচার, বিশেষত ধর্ষণ, যৌন-হেনস্থা, অ্যাসিড ছোড়ার মতো আইনের সংশোধন
বিশেষ পরিবর্তন ১৬-র বেশি বয়সিদের জন্য
• ধর্ষণ, খুনের মতো ‘ঘৃণ্য’ অপরাধের ঘটনায় ১৬-১৮ বছর বয়সের কিশোরদের ‘সাবালক’ হিসাবে বিচার

এজলাসের মধ্যেই আশাদেবীর চোখ ভিজে উঠল। বেরিয়ে বলেন, ‘‘আদালতে আর কত দলিল পেশ করবেন অপরাধীদের আইনজীবীরা? আর দু’ঘণ্টা বাকি রয়েছে। এর মধ্যে ওরা যা করার করে নিক। তার পরে সাড়ে পাঁচটায় ফাঁসি হয়ে যাবে।’’ সুপ্রিম কোর্ট থেকে বেরিয়ে দক্ষিণ দিল্লির এক প্রান্তে দ্বারকায় পৌঁছতে পৌঁছতে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করল। আশাদেবী বললেন, ‘‘আমাদের দেশের মেয়েদের আগামিকাল সকালে নতুন সূর্য উঠবে। আমার নির্ভয়ার জন্যও নতুন সূর্য উঠবে। অবশেষে ইনসাফ পেলাম।’’ সারা রাত তো দু’চোখের পাতা এক করলেন না? আশাদেবী উত্তর দিলেন, ‘‘পুরো দেশ তো জাগছে আমাদের সঙ্গে।’’

ফ্ল্যাটে ফিরেই মেয়ের ছবি ফের জড়িয়ে ধরলেন আশাদেবী। বলেন, ‘‘আজ মেয়ের ছবি জড়িয়ে ধরে বলেছি, মা, এত দিনে তুই বিচার পেলি। আমাদের মেয়ে আর কোনও দিন ফিরবে না। কিন্তু আজকের পর দেশের অন্য মেয়েরা নিজেদের কিছুটা নিরাপদ বোধ করবে।’’

গত পাঁচ মাস ধরে এই ফাঁসি নিয়ে টালবাহানা চলছে। এমন কোনও শুনানির দিন বাদ যায়নি, যেখানে আশাদেবী হাজির ছিলেন না। বদ্রীনাথ আসতে না পারলেও, আশাদেবী রোজ আদালতে হাজির হয়েছেন। আইনজীবী জিতেন্দ্রকুমার ঝার থেকে বুঝে নিয়েছেন আদাতে কী হচ্ছে। তাঁকে আগলে রেখেছেন আশাদেবীর আইনজীবী সীমা সমৃদ্ধি কুশাওয়াহা।

রাত সাড়ে তিনটের সময় যখন সুপ্রিম কোর্ট অপরাধীদের যাবতীয় আর্জি খারিজ করে দিচ্ছে, তখন সীমারও চোখ ভিজে উঠল। সীমা বলেন, ‘‘আমি তো কোনও দিন আশাদেবীর মেয়েকে দেখিনি। কিন্তু ওঁর যন্ত্রণাটা বুঝতে পারি। যে দিন এই ঘটনা ঘটেছিল, সে দিনই যন্ত্রণা হয়েছিল। আশাদেবী যখন আমাকে প্রথম বার বর্ণনা করেছিলেন, উনিও কেঁদেছেন, আমিও কেঁদেছি। নির্ভয়া আজ বিচার পেল।’’

২০১৩-র ১৭ জানুয়ারি থেকে সাকেতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মামলার শুনানি শুরু হয়। সে দিন থেকেই আদালতে আদালতে চক্কর কাটার শুরু। বদ্রীনাথ-আশার বড় ছেলে এখন পাইলট। ছোটটি পড়াশোনা করছে। এখন সংসারে অভাব নেই। বদ্রীনাথ বলেন, ‘‘তখন এমন অবস্থা ছিল না। কেউ জানে না, আদালতে যেতে হয়েছে বলে কাজে যেতে পারিনি, মাইনে কেটে নিয়েছে। কী করে দুই ছেলেকে নিয়ে সংসার চালিয়েছি, আমিই জানি।’’

আশা-বদ্রীনাথ এখনই লড়াই শেষ করছেন না। শেষ বেলায় তাঁর মেয়ের অপরাধীরা যে ভাবে ফাঁসি দেরি করতে নানা পন্থা নিয়েছে, তা যেন ভবিষ্যতে আর কেউ না করতে পারে, তা নিশ্চিত করতে চান আশাদেবী। বলেন, ‘‘২৩ মার্চই সুপ্রিম কোর্টে এ বিষয়ে শুনানি রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানাব, রায় সংশোধনের আর্জি, প্রাণভিক্ষার আর্জি জানানোর জন্য সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। একই ঘটনায় একাধিক ফাঁসির সাজাপ্রাপ্ত অপরাধী থাকলে তাদের একই সঙ্গে রায় সংশোধনের আর্জি, প্রাণভিক্ষার আর্জি জানাতে হবে। আলাদা করে আর্জি জানিয়ে দেরি করা চলবে না।’’ আশাদেবীর প্রতিজ্ঞা— ‘‘আমার মেয়ের জন্যই এই লড়াইটা করতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Nirbhaya Case Nirbhaya Crime Crime Cases
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE